প্রধানমন্ত্রীর ট্রেনবহরে হামলায় আহত, অনত্যম সাক্ষি ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ এমপি বলেছেন, বিএনপি মহাসচিব চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায় নিয়ে আবারো মিথ্যাচার শুরু করেছেন। শনিবার সকালে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ১৯৯৪ সালের ২৩ শে সেপ্টম্বর বিএনপি ঈশ্বরদীতে তান্ডব চালিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। গত ৪ জুলাই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ড্যাবের সমাবেশে ট্রেনে দুটি গুলি ছোড়া, আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের গোলাগুলি, কোন প্রমাণ নেই, তড়িঘরি করে রায় ঘোষণা প্রসংগে সম্পূর্ণই মিথ্যাচার করেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। এমপি শরীফ এসময় বলেন, ঈশ্বরদীতে আওয়ামী লীগের অতীতেও দুই পক্ষ ছিলনা, আজও নেই।
বিএনপি ক্যাডাররা দিনভর তান্ডব চালিয়েছে। তিনি বলেন, সকাল ১১টার দিকে ষ্টেশনের সভামঞ্চটিও তারা ভেঙ্গে দেয়। নেত্রীর ট্রেন ষ্টেশনে ঢোকার পূর্বমূহুর্তে এবং পরে বৃষ্টির মতো গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করা হয়। আমিসহ দলীয় নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষ ছাড়াও দায়িত্বরত ম্যাজিষ্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন, পুলিশের এসআই আব্দুস সামাদ, নায়েক ফজলুল হক এবং কনেষ্টবল মতলেবুর রহমান বোমায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আহত হয়। মামলায় আঘাতপ্রাপ্ত সরকারি ওই ব্যক্তিরা এ মামলায় সাক্ষি দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, রায়ের পরদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রে ২৩ সেপ্টেম্বর ট্রেনবহরে নেত্রীর সফরসঙ্গি ঢাকার সাংবাদিকদের বক্তব্য ও নাম প্রকাশিত হয়েছে। তৎসত্বেও বিএনপি বরাবরের মতোই মিথ্যাচার করে বিচার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এমপি শরীফ বলেন, এই মামলা আওয়ামী লীগের দায়ের করা নয়। ঈশ্বরদী রেল থানার ওসি নজরুল ইসলাম মামলা দায়ের করেন। এসময় তিনি জানান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান নূরুজ্জামান বিশ্বাস আমার নির্দেশে রেল থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে ওসি মামলা গ্রহন না করে নিজেই মামলা দায়ের করেছেন বলে জানান ।
এব্যাপারে পাবনার পিপি এ্যাড. আক্তারুজ্জামান মুক্তাকে ২ দিনের মধ্যে রায় সাজিয়ে ঘোষণার অভিযোগ প্রসংগে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি মামলার বিস্তারিত বিবরণ সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করেন। পিপি জানান, রেল থানা কর্তৃপক্ষ ঘটনার ১০ দিন পর তড়িঘড়ি করে ৩/১০/৯৪ তারিখে আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করে। ২৩ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদীতে দায়িত্বপালন কালে আহত ম্যাজিষ্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনই আমলী আদালত-২ এর ম্যাজিষ্ট্রেট থাকায় এসময় তিনি বলেন, বোমার খন্ড আমার শরীরে আছে। তাই মামলাটির অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন। তিনি মামলাটি সিআইডিতে প্রেরণ করেন। সিআইডি তদন্ত শেষে ৩/৪/১৭ তারিখে ৫২ জনকে শ্রেণীভূক্ত আসামী করে চার্জশীট দাখিল করে। ৩০/৬/৯৭ তারিখে মামলা নিষ্পত্তির জন্য সিনিয়র বিশেষ স্পেশাল ট্রাইবুনালে প্রেরণ করা হয়। স্পেশাল ট্রাইবুনালে ৪/৩/৯৮ তারিখে আসামীদের বিরুদ্ধে ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩ ও ৩(ক) ধারা মতে চার্জ গঠন করা হয়।
পিপি জানান, মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ম্যাজিষ্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন, পুলিশের এসআই আব্দুস সামাদ, নায়েক ফজলুল হক এবং কনেষ্টবল মতলেবুর রহমানসহ ২২ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ১৫ জন পাবলিক সাক্ষি গ্রহন করা হয়। এই সাক্ষি শেষে ৩/৮/২০১১ তারিখে কার্যবিধির ৩৪২ ধারা মতে আসামীদের পরীক্ষা করা হয়। এসময় আসামীরা বলেন, তারা সাফাই সাক্ষি দিবেন। আসামী পক্ষে ২৫জন সাফাই সাক্ষিকে আদালতে হাজির করা হয়। এই সাক্ষি শেষ হলে ২০১৭ সালে মামলার যুক্তিতর্ক শুরু হয়। এসময় আসামীপক্ষ মোকদ্দমা স্থগিত ও আরও সাফাই সাক্ষি গ্রহনের জন্য আদালতে আবেদন জানালে আদালত নামঞ্জুর করেন। এরই প্রেক্ষিতে আসামী পক্ষ হাইকোর্টে আপীল করেন। ২০১৭ সালে আপীল করা হলেও হাইকোর্ট ২০১৮ সালে একটি কার্যদিবসে ৩ জনের সাফাই সাক্ষি গ্রহন ও দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। পিপি অভিযোগ করেন, আসামীপক্ষ হাইকোর্টের আদেশ এক বছরেরও বেশী সময় ধরে গোপন রাখে। ওই আদেশের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে তীব্র প্রতিবাদ জানালে আদালত যুক্তিতর্ক শুরু করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আংশিক যুক্তিতর্ক শোনার পর আদালত আসামীপক্ষকে হাইকোর্টের আদেশ ১ মাসের মধ্যে দাখিলের জন্য সময় প্রদান করেন। এক মাস পর ২০১৮ সালে হাইকোর্টের আদেশ দাখিল করা হয়। গত ২৩ শে জুন আদালত সাফাই সাক্ষি প্রদানের জন্য ৩০ শে জুন দিন ধার্য করেন। আসামী পক্ষ ৩০ জুন সাফাই সাক্ষি দিতে না পারায় আদালত সাক্ষি গ্রহন শেষ করে গত ১লা জুলাই যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য করেন। ১লা জুলাই যুক্তিতর্ক শেষ হলে ৩রা জুলাই রায় ঘোষণা করা হয়।
রায় প্রসংগে পিপি আক্তারুজ্জামান জানান, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওইদিন যারা বোমা হামলা করেছিল, কিন্তু তা শেখ হাসিনার গায়ে না লেগে মানব ঢাল হিসেবে গঠিত জনগণের উপর পড়ে। এসময় অনেক মানুষ আহত হয়। রায়ে আদালত বলেছেন, তদান্তিন আওয়ামী লীগ নেতা শামসুর রহমান শরীফের উপর যারা বোমা নিক্ষেপ করেছিল, ১জন ম্যাজিষ্ট্রেট এবং আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্যান্য জনগণের উপরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল তাদের মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া ন্যায় সংগত বলে মনে করছি। অন্যদিকে যেসকল আসামী বোমা মেরে জনমনে আতংক সৃষ্টি করেছিল, ঘটনাস্থলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েক করেছিল এবং তাদের আক্রমনে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হওয়ায একই আইনের ৩ ধারায় যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডের সিদ্ধান্ত গ্রহন করছি। অপর শ্রেণীর আসামীদের একই ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করছি।
দীর্ঘদিন মামলা চলমান প্রসংগে এ্যাড. মুক্তা বলেন, ১৯৯৯ সাল হতে সাক্ষি গ্রহন শুরু হয়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ২০০৪ সালে ভিক্টিম, ডাক্তার ও তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষি ছাড়াই মামলাটি নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হয়। এসময় ভিক্টিম শামসুর রহমান শরীফের প্রচেষ্টায় সিনিয়র আইনজীবি গোলাম হাসনাইনের নেতৃত্বে পাবনার আইনজীবিদের সহযোগীতায় পুনরায় সাক্ষি গ্রহনের জন্য আদালতে আবেদন জানালে তদানিন্তন বিচারক আবারও সাক্ষি গ্রহনের দিন ধার্য করেন।
রায় প্রসংগে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলামের অভিযোগকে মিথ্যাচারিতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও তদান্তিন ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান হাবিবকেই জিজ্ঞেস করুন ওইদিন কি ঘটেছিল। কারণ তিনি ওই ট্রেনেই ছিলেন। গুলি ও বোমার ভয়ে তিনি সেসময় ট্রেনের সীটের নীচে শুয়ে পড়েছিলেন।