যশোর প্রতিনিধি : অবৈধ আয় বৈধ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে যশোরের শার্শার বাগআঁচড়ার সাতমাইল পশুর হাটের প্রধান আদায়কারী জাহাঙ্গীর। প্রতি হাটে লাখ দশেক লাখ টাকা আদায় হলেও সামান্য কিছু টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া
হলেও মোটা অঙ্কের টাকা লোপাট করছে জাহাঙ্গীর চক্র। যা জায়েজ করতে শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকতাকে জড়িয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার চেষ্টা করে হাটের আদায়কারীরা। এমন বিজ্ঞাপন বিভিন্ন দৈনিকের দপ্তর গুলোতে নিয়ে আসেন
জাহাঙ্গীরের সেকেন্ড এন্ড কমান্ড ঝিকরগাছা উপজেলার শংকরপুর এলাকার জনৈক সেলিম হোসেন।
“হাট পরিচালনা এবং প্রচারে যশোর জেলার শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা” লেখা বিজ্ঞাপন অন্য উপজেলার একটি ইউনিয়ন থেকে পাঠানোর কারণে বিষয়টি নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করলে তিনি
প্রথমে বিজ্ঞাপনটি দেখতে চান। পরে তিনি কয়েকটি দৈনিকের বিজ্ঞাপন কর্মকর্তাদের সাথে ও সাংবাদিকদের সাথে মুঠো ফোনে কথা বলেন, শার্শা উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাজী নাজিব হাসান।
তিনি সাংবাদিকদের জানান, ‘বিজ্ঞাপনটি তার নয় এবং এধরণের কোন বিজ্ঞাপনের সাথে তার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।’ তিনি বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ না করার জন্য ও কয়েকজন সাংবাদিকেরকে অনুরোধ করেন। এরপর বিজ্ঞাপন প্রদানকারী সেলিম হোসেন
মুঠোফোনে জানান, এটা যশোরের শার্শার বাগআঁচড়ার সাতমাইল পশুর হাটের বর্তমান আদায়কারী জাহাঙ্গীর হোসেন বিজ্ঞাপনটি পত্রিকা দপ্তরে পাঠিয়েছেন।
এ বিষয়ে হাটের অলিখিত দায়িত্ব প্রাপ্ত স্থানীয় বাগআঁচড়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, এমন কোন বিজ্ঞাপন প্রদানের জন্য সেলিমকে বলা হয়নি। এটা সে মিসটেক করেছে। আমরা কারও নামে
বিজ্ঞাপন দিতে বলিনি। শুধু ইউএনওর নামে বিজ্ঞাপন প্রতারণা নয়। এই হাটে নিয়ে অভিযোগ রয়েছে সর্বত্রই।
স্থানীয় বাসিন্দা এবং হাটের সাথে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানান, চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল বাগআঁচড়ার সাতমাইল পশুর হাটের ইজারা শেষ হয়। এরপর ১৪ এপ্রিল থেকে সম্পূর্ণ ইজারাবিহীনভাবে একজন সাবেক সংসদ সদস্যের নির্দেশে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশেষ ব্যবস্থায় হাটটি চালাতেন বাগআঁচড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক চেয়ারম্যান ইলিয়াস কবির বকুল ও কায়বা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান হাসান
ফিরোজ টিংকু। এরা দুজনই ওই সাবেক এমপি লোক।
বকুল-টিংকুর কাছে থেকে ব্যাপারীরা ৩ হাজার টাকা দিয়ে কার্ড গ্রহণ করলেও গরুপ্রতি তাদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে আদায় করা হতো এবং সাধারণ ক্রেতাদের কাছে থেকে গরুপ্রতি ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা আদায় করা হতো। অথচ গরু হাট ইজারা না হওয়ায় সরকারি পাস মূল্য ছিল ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা।
স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে হাটটি পরিচালনায় আওয়ামী লীগের ওইসব নেতা গা ঢাকা দিলে ছাত্রজনতাকে সঙ্গে নিয়ে হাটটি দুদিন পরিচালনা করছিলেন উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন সভাপতি বকুল ও
টিংকুর কাছ থেকে করা ব্যাপারী কার্ডের কোনো সুবিধা পায়নি কার্ডধারীরা।
হাটে কার্ডধারী ব্যাপারী ও সাধারণ ক্রেতাদের একই মূল্যে প্রতিটি গরুর পাস শুরু হলে ক্ষুব্ধ হয় কার্ডধারী ব্যাপারীরা। তারা আন্দোলন শুরু করলে আইনশৃঙ্খলা অবনতির আশঙ্কায় গত ২০ আগস্ট হাটটি বন্ধ করে দেয় উপজেলা প্রশাসন। আবার মাসখানেক পরে গত ২০ সেপ্টেম্বর ফের চালু হয় হাটটি।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর হাটের অলিখিত দায়িত্ব পান স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্ততঃ ৫টি হাট পেয়েছেন। এইখানে সপ্তাহে দুইদিন মঙ্গল ও শনিবার হাট বসে।
সূত্র মতে, প্রতি হাটে কমপক্ষে দশ লাখ টাকা আয় হয়। কিন্তু সরকারিখাতে জমা হয় যৎ সামান্য। সাতমাইলের হাট নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ তুলে এই বছরের ২৩ এপ্রিল যশোরের জেলা প্রশাসককে লিখিত আবেদন জানান বাগআঁচড়া ইউপি
চেয়ারম্যান মো.আব্দুল খালেক। আবেদনপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, ৯ এপ্রিল শার্শা উপজেলা অফিস সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেন, সভাপতি করা হয় বাগআঁচড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইলিয়াস কবির বকুল ও
হাসান ফিরোজ টিংকু ওই কমিটির কোনো সদস্যকে হাটে প্রবেশ করতে দেননি। তারা ইচ্ছেমতো সরকার নির্ধারিত গরু প্রতি ১৫০ টাকা ফির স্থলে ১৫শ’ টাকা পর্যন্ত আদায় করতেন। এরফলে গত ১৬ এপ্রিল সেখান থেকে আয় হয় ১২ লাখ ৬৬
হাজার টাকা। কিন্তু সরকারি কোষাগারে জমা করা হয় মাত্র দুই লাখ টাকা।
তেমনই ২০ এপ্রিল আয় হয় ৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকা এবং সরকারি কোষাগারে জমা হয় ২
লাখ টাকা। এখানে হাট আদায়ের ৫ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদ এবং ১৫ শতাংশ পশু হাট
উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। তিনি দাবি করেন, কতিপয় সন্ত্রাসী অবৈধভাবে হাট থেকে
টাকা উত্তোলন করে ভোগদখল করছে এবং সরকার বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে।
সূত্র জানায়, সেপ্টেম্বর মাসের দুই হাটে (৭ ও ১০ তারিখে) যথাক্রমে খাজনা
আদায় হয় ৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা এবং ৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এরমধ্যে যথাক্রমে
৮৫ হাজার ও ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়।
এসব বিষয়ে বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, হাটে যে অঙ্কের টাকার কথা
বলা হচ্ছে, আসলে আয় হচ্ছে তার চেয়ে কম। কতো টাকা গড়ে আয় হচ্ছে-এমন
প্রশ্নের জবাবে তিনি টাকার অঙ্ক বলতে চাননি। কতো টাকা সরকারি কোষাগারে
জমা দিয়েছেন সে বিষয়টিও বলতে চাননি তিনি।
এসব বিষয়ে শার্শা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ডা. কাজী নাজিব হাসান
সাংবাদিকদের বলেছেন, আমি মাসখানেক হলো শার্শায় দায়িত্ব নিয়ে এসেছি।
বিষয়টি আমিও অবগত। এ বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে জানতে আমি ইতোমধ্যে যশোরের
জেলা প্রশাসক মহোদয়কে লিখেছি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয়ও চেষ্টা করছেন
হাটটি বৈধভাবে কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা।
বাংলা ১৪২৮ সালে সাত মাইল পশুর হাটের ইজারা ডাক ছিল সাড়ে ৮ কোটি টাকা।
১৪২৯ সালে সাড়ে ১৪ কোটি টাকা ও ১৪৩০ সালে এ হাটের ডাক ছিল সাড়ে ১০ কোটি টাকা।
তবে, নতুন বছর ১৪৩১ সালে এ হাটের কোনো ডাক বা ইজারা হয়নি। যে কারণে আগের ইজারাদাররা সরকারি আইন অমান্য করে হাটের খাজনা আদায় করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে গা ঢাকা দিয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, এই হাটের টাকা জাহাঙ্গীর হোসেনের পকেটে যাচ্ছে বলে দৃশ্যমান হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি ঘরাণার বড় দুই নেতার পকেটেই যাচ্ছে অন্ততঃ লাখ টাকা। এমন নেতা-পাতি নেতা-সেলিম সহ
স্থানীয় সুবিধাবাদীরা হাতিয়ে নিচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা। হাটের টাকা সরকারী কোষাগারে জমা দেয়া নিয়ে চলছে বেশুমার লুটপাঠ।
প্রতি হাঠে অন্ততঃ ৭ লাখ টাকা চলে যাচ্ছে নেতা-কর্তাদের পকেটে। যা দেখার
যেন কেউ নেই। আর সে কারনেই প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতেই শার্শা ইউএনওর নামে
বিজ্ঞাপন প্রচার করে দায় সরকারি কর্তাদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা চলছে।
এদিকে, ইউএনও মহাদয় ফেসবুকে স্টাটাস দিয়ে দায় সারছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।#