// আজিম উল্যাহ হানিফ
কবি আসাদ বিন হাফিজ (জন্ম: ১ জানুয়ারী ১৯৫৮- মৃত্যু ১ জুলাই ২০২৪) বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার এবং ছড়াকার হিসেবে পরিচিত। তিনি আদর্শিক দিক দিয়ে ফররুখ আহমদের (১৯১৮-১৯৭৪) অনুসারী। তাঁর সাহিত্যে বাংলার মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণ এবং বিপ্লবের অণুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সৃজনশীলতার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহারেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার সাহিত্যে বিপ্লবী চিন্তা-চেতনারও প্রকাশ ঘটেছে। তিনি ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে জড়িত আছেন। জন্ম, শিক্ষা, জীবিকাঃ আসাদ বিন হাফিজ ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারী গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার অন্তর্গত বড়গাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুহাম্মদ হাফিজউদ্দীন মুন্সী এবং মাতা জুলেখা বেগম। কবি আসাদ বিন হাফিজ ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক(সম্মান) ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়া তিনি ১৯৮৩ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তিনি বর্তমানে ‘প্রীতি প্রকাশন’ নামের প্রকাশনা সংস্থাটি পরিচালনা করছেন। জনপ্রিয় কিছু গান…
* পৃথিবী না জানুক আমি তো জানি,* আমার একটা মন ছিলো,* বিসমিল্লাহ বলো বিসমিল্লাহ,* দাও খোদা দাও আমায় আবার ,* আল্লাহ ছাড়া মাবুদ নাই ,রাসূল ছাড়া নেতা নাই,* উড়োজাহাজ উড়ু উড়ু,* তোমরা ভুলে গেছো মালেক ভাইয়ের নাম,* বই পড়ো ভাই বই পড়ো,* ছোট্ট পাখি টুনটুনি,* ডান্ডাবেড়ি বাজে,* ঈদুল আজহার বরকতে হয় বিশ্ব প্রেমময়৷,* নাই নাই নাই কিছু সবই শূন্যঘর
এরকম অসংখ্য গানের তিনি রচয়িতা। রচনাশৈলীঃ
কবির সাহিত্য রচনার ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল, দুর্বোধ্যতামুক্ত। এ কবির কাব্যসৌধ গড়ে উঠেছে সুবোধ্যতার ভিতের ওপর। কবির শ্রেষ্ঠ রচনা হল ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’। এই গ্রন্থে্র কবিতা ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’ কবিতাটি সমগ্র বাংলা সাহিত্যের মধ্যেই একটি অন্যতম সেরা কবিতা। তিনি যে-সমাজের স্বপ্ন দেখেন তার অসাধারণ এক কাব্যিক রূপ দিয়েছেন এই কবিতায়। যা বাংলা সাহিত্যে আর কোনো কবির কলমে এ রকমভাবে ফুটে উঠেনি। তার এ কবিতার কয়েকটি চরণ-
“আমি আপনাদেরকে আরেকটি অনিবার্য বিপ্লবের জন্য/
প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি।/যে বিপ্লবে প্রতিটি নাগরিকের জীবন হয়/একেকজন যোদ্ধার জীবন/প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতিটি মানুষ হয়/একেকজন আমূল বিপ্লবী/প্রতিটি যুবক/নারীর বাহুর পরিবর্তে স্বপ্ন দেখে উত্তপ্ত মেশিনগানের/আর রমণীরা/সুগন্ধি রুমালের পরিবর্তে পুরুষের হাতে তুলে দেয়/বুলেট, গ্রেনেড।
উপরিউক্ত চরণগুলোতে কবির সাহিত্যিক দ্যোতনা প্রকাশ পেয়েছে। আবার কবির আদর্শের বিপ্লবের ব্যঞ্জনা ধ্বনিত হয়েছে নিম্নোক্ত চরণগুলোতে-
আমি আমার জনগণকে/আসন্ন সেই বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।/যেখানে অন্ধকার/সেখানেই বিপ্লব/যেখানে ক্লেদাক্ত পাপ ও পঙ্কিলতার সয়লাব/সেখানেই বিপ্লব/যেখানে নগ্নতা ও বেহায়াপনার যুগল উল্লাস/সেখানেই বিপ্লব/
যেখানে মিথ্যার ফানুস/সেখানেই বিপ্লব/বিপ্লব সকল জুলুম, অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে/বিপ্লব অন্তরের প্রতিটি কুচিন্তা আর কুকর্মের বিরুদ্ধে।”
সাহিত্যকর্ম:কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্য, গবেষণা, সম্পাদনা ইত্যাদি সাহিত্যের সব শাখাতেই কবি আসাদ বিন হাফিজ রেখেছেন তার অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর। তিনি প্রায় ৮১টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।কাব্যগ্রন্থ:
১. কি দেখো দাঁড়িয়ে একা সুহাসিনী ভোর (১৯৯০),২. অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার (১৯৯৬),শিশুতোষ গ্রন্থ-১. হরফ নিয়ে ছড়া (১৯৮৯),২. আলোর হাসি ফুলের গান (১৯৯০),৩. কুক কু রুকু (১৯৯২),৪. ইয়াগো মিয়াগো (১৯৯৪),৫. আল্লাহ মহান (২০০১),৬. কারবালা কাহিনী (২০০১),অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ-১. নাতিয়াতুন নবী (২০০৩),
ছড়া-১. রাজনীতি ধুমধাম (১৯৮০),২. হিরালালের ছড়া (২০০৩),
গবেষণা গ্রন্থ-১. আল-কুরআনের বিষয় অভিধান (১৯৯২),২. ইসলামী সংস্কৃতি,৩. ছন্দের আসর,ঐতিহাসিক গ্রন্থঃ১. ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস (১৯৯০),
গল্প গ্রন্থঃ ১. পনেরই অগাস্টের গল্প (১৯৯০),জীবনী গ্রন্থঃ ১. আপোষহীন এক সংগ্রামী নেতা (১৯৯২),২. নাম তার ফররুখ (১৯৯৭),কিশোর সাহিত্য সম্পাদনা-১. নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন (১৯৯২),২. আলোর পথে এসো (১৯৯৯),
ঐতিহাসিক দুঃসাহসিক অভিযান সিরিজ-১. গাজী সালাউদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান (১৯৯৭),২. সালাউদ্দীনের কমান্ডো অভিযান (১৯৯৭),৩. সুবাক দুর্গে আক্রমণ (১৯৯৭),৮. ভয়ংকর শিরযন্ত্র (১৯৯৭),৯. ভয়াল রজনী (১৯৯৮),১০. আবারো সংগ্রাম (২০০০),১১. দুর্গ পতন (২০০০),১২. ফেরাউনের গুপ্তধন (২০০১),১৩. উপকূলে সংঘর্ষ (২০০১),১৪. সর্প কেল্লার খুনী (২০০১),১৫. চারিদিকে চক্রান্ত (২০০২),১৬. গোপন বিদ্রোহ (২০০২),১৭. পাপের ফল (২০০২),১৮. তুমুল লড়াই (২০০২),১৯. উম্রু দরবেশ (২০০২),২০. টার্গেট ফিলিস্তিন (২০০২),২১. গাদ্দার (২০০৩),২২. বিষাক্ত ছোবল (২০০৩),২৩. খুনী চক্রের আস্তানায় (২০০৩),২৪. পাল্টা ধাওয়া (২০০৩),২৫. ধাপ্পাবাজ (২০০৪),২৬. হেমস এসর যোদ্ধা (২০০৪),২৭. ইহুদী কন্যা (২০০৪),২৮. সামনে বৈরুত (২০০৪),২৯. দূর্গম পাহাড় (২০০৪),৩০. রক্তাক্ত মরুভূমি (২০০৪),৩১. ছোট বেগম (২০০৬),৩২. রক্তস্রোত (২০০৬),৩৩. যাযাবর কন্যা (২০০৬),৩৪. মহাসমর (২০০৬),
পুরস্কারঃ কবি আসাদ বিন হাফিজ তার বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।১. কলম সেনা পুরস্কার (১৯৯৪),২. কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এম.ইউ আহমেদ পুরস্কার (১৯৯৭),৩. বাংলাদেশ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ পুরস্কার (১৯৯৭),৪. ছড়ার ডাক পদক ও সম্মাননা (২০০৪),৫. মেলোডি শিল্পগোষ্ঠী পদক (২০০৪),৬. কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৪),৭. গাজীপুর সংস্কৃতি পরিষদ কৃতি সংবর্ধনা (২০০৪),মৃত্যু : ১ জুলাই ২০২৪ সাল, রাত ১২.৫৫ মিনিটে রাজধানীর একটা হাসপাতালে মস্তিকে হ্যামারেজ হয়ে কবি ইন্তেকাল করেন৷
লেখক: আজিম উল্যাহ হানিফ, কবি ও কলামিস্ট। ০১৮৩৪-৩৮৯৮৭১