— এবাদত আলী–
বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি)কর্তৃক সাংবাদিকতায় বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা হয় পাবনা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে। ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনদিনের এই প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ২৬ জন অংশগ্রহণকারি সাংবাদিকের মধ্যে আমার নামও অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাবনা প্রেসক্লাবের সদস্য হওয়ার সুবাদে আমার নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
সে মোতাবেক আমি ১২ ডিসেম্বর রোববার অগ্রহায়ণের শেষপ্রান্তে শীতের কুয়াশাঘন সকালে সাড়ে ৯টার সময় প্রশিক্ষণস্থল পাবনা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে উপস্থিত হই এবং নাম রেজিস্ট্রেশন করাই। আমার সাথে আরও যে সকল সাংবাদিক এই র্কশালায় অংশগ্রহণ করেন তাঁরা হলেন, মোস্তাফা সতেজ, ইয়াছিন আলী মৃধা রতন, এমজি বিপ¬ব চৌধুরি,আহমেদুল হক রানা, আখিনুর ইসলাম রেমন, ছিফাত রহমান সনম, জিকে সাদী, আব্দুল হামিদ খাঁন, হাসান আলী, সরোয়ার উল্লাস, কাজি মাহবুব মোর্শেদ বাবলা, সৈকত আফরোজ আসাদ, আহমেদ হুমায়ূন কবির তপু, আবুল কালাম আজাদ, আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, শাহিনুর রহমান শাহিন, জুনায়েদ হোসেন খান মামুন, আব্দুর রশিদ, আলাউদ্দ্নি আহমেদ,মাহবুবা কাজল, সৈয়দ পাপলু, মো: আব্দুল¬াহ, অজয় রায়, রফিকুল ইসলাম সুইট ও সুসান্ত কুমার সরকার।
পাবনা জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক দুলালচন্দ্র বিশ্বাস প্রধান আতিথি হিসাবে প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধন করলেন। তিনি তার উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, পাবনা অনেক দিক দিয়ে স্মরনযোগ্য। কৃষক বিদ্রোহ, পলো বিদ্রোহ ও ফরায়েজি আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধেও জেলাবাসী অবদান রেখেছেন। এখানে কৃষি উৎপাদনও ভালো। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ অঞ্চলে অনেকদিন থেকেছেন। লিখেছেন সোনার বাংলার কথা। এখানে অনেক গুণীজন আছেন। তাই বাংলাদেশের হৃদয় পাবনা। এখানকার ইতিহাস আছে, ঐতিহ্য আছে। তিনি আরো বলেন, বর্তমান সময়ে সাংবাদিকদেরকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দেশের জন্য গণমাধ্যমের যে শক্তি আছে, তথ্যের যে শক্তি আছে তা গণমানুষের জন্য ব্যবহারের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশে সাক্ষরতার হার বাড়ছে। বাড়ছে সংবাদপত্রের চাহিদা। পাশাপাশি সংবাদিকদের দায়িত্ব-কর্তব্যও বেড়ে চলেছে। মানুষের জন্য কাজ করার মানসিকতা নিয়ে সংবাদপত্রের পেশায় আসছে মানুষ। তবে মফস্বল শব্দটা না থাকাই ভালো। দুলালচন্দ্র বিশ্বাস আরো বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির ফলে সাংবাদিকতার চরিত্র এবং গনমাধ্যমের চরিত্র দিনদিন বদলে যাচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করাই সাংবাদিকদের কাজ। এই উত্তরণের প্রক্রিয়ায় পিআইবি প্রশিক্ষন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নবীন এবং প্রবীনদের সমম্বয়ে এই প্রশিক্ষণ সফল হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান তাঁর ভাষনে বলেন, প্রশিক্ষনের মাধ্যমে মেধার বিকাশ ঘটে। পিআইবির এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পাবনার সাংবাদিকদের পেশাগত মান বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। পিআইবির প্রশিক্ষক মো: আব্দুল মান্নানের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন পিআইবির সিনিয়র প্রশিক্ষক আ স ম আব্দুল হক, পাবনা পেসক্লাবের সাবেক সম্পাদক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ শিবজিত নাগ ও পেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক উৎপল মির্জা।
এরপর প্রথম কর্মদিবসে পরিচিতি পর্ব শেষে ‘সাংবাদিকতা ও রূপকল্প-২০২১’ বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করেন পিআইবির মহাপরিচালক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস। দেশ গঠন নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেন তিনি। পাল রাজত্ব থেকে হিন্দু, মুসলমান ও ইংরেজ উপনিবেশ কাল স্মরণ করে তিনি নদীর গতিপথেরও বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, বর্তমান মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকার ২০২১ রূপকল্প ঘোষণা করেছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এই রূপকল্পের কথা বলা হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা উল্লে¬খ করে বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। এই যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ রক্ত দিয়েছে, প্রায় ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই দেশকে সোনার বাংলা হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সে সপ্ন সফল হয়নি। আজ তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বগ্রহণের পর ভিশন টুয়েন্টি টুয়েন্টিওয়ান রূপকল্পের ঘোষণা দেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের আলোকে আগামি ২০২১ সালে এই দেশ ৫০ বছরে পদার্পণ করবে। ২০২১ সালের মধ্যে তাই এই দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে সবাইকে নিঃসার্থভাবে কাজ করতে হবে। তিনি আরো বলেন,বাংলাদেশ সরকারের অর্থ আছে, বিদেশী সাহায্য সহজেই পাওয়া যায়, কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকায় এ দেশ উন্নতির শিখরে উঠতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সাংবাদিকগণ তাঁদের লেখনির মাধ্যমে মানুষের আকাংখা পূরণে সহযোগির ভুমিকা পলন করতে সক্ষম। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দিনবদলের কর্মসূচি হাতে নিয়ে ডিজিটাল বংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এতে সাংবাদিকগণ সহায়ক শক্তি হসাবে দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের বিষয়ে লেখনির মাধ্যমে সমাজকে সচেতন করতে পারেন। ব্যক্তির জ্ঞানের পরিবর্তনের মাধ্যমে সমষ্টির জ্ঞানের পরিবর্তন আনা সম্ভব। তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞানসমাজ তৈরি করে। তথ্য জ্ঞানসমাজের মাঝে সিড়ি তৈরি করতে সক্ষম। এই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে সাংবাদিকগণ সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। এক্ষেত্রে সাংবাদিকগণ শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারে। মহাপরিচালক আরও বলেন, বর্তমান সরকার ইতোমধ্যেই দেশের ৪শ৬১টি ইউনিয়নে তথ্যকেন্দ্র চালু করেছে। যার মাধ্যমে দিনবদলের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তিনি গ্রামীণ জনপদের খবরাখবর বেশি বেশি গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান। তাঁর বক্তব্যের শেষপর্যায়ে সাংবাদিক আঁখিনুর ইসলাম রেমনের এক প্রশ্নের জবাবে বিগত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁর কারাবরণ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করেন। সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রেফতারের প্রতিবাদ করায় এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দু নেত্রীর মুক্তির দাবি করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ মিছিল করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর রোষানলে পড়েন তিনি এবং তাঁর অপর দুজন সহকর্মী গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন ও সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল¬াহ আল মামুন। তিনি তখন ছিলেন রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ২০০৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাঁদেরকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। এই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।
মধ্যাহ্ন বিরতির পর পিআইবির প্রশিক্ষক আব্দুল মান্নান সংবাদ, সংবাদের উপাদান, সংবাদ মূল্য ও সংবাদ চেতনা বিষয়ক আলোচনা করেন। পিআইবির সিনিয়র প্রশিক্ষক আসম আব্দুল হক সংবাদ সূচনা ও সংবাদ কাঠামো (ব্যবহারিকসহ) প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচিতে রিপোর্ট লেখার কলাকৌশল, সংবাদের নীতিমালা ও অনলাইন জার্নালিজম বিষয়ক আলোচনা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার পান্ডে। অনলাইন সাংবাদিকতা বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি ১৯৮০ সাল থেকে কম্পিউটারের পদযাত্রার কথা উল্লে¬খ করেন। ১৯৯২ সালে আমেরিকার শিকাগো থেকে এর বিকাশ ঘটে এবং ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর এর ব্যাপকতা ও চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে বলে জানান। তিনি বলেন, অনলাইনের মাধ্যমে সাংবাদিকতার পার্থক্য শুধু সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে। অন্য মিডিয়ার চেয়ে অনলাইনে পরিসরের ব্যপ্তি ঘটানো সম্ভব। এতে সংবাদের অডিও ভিজ্যুয়াল উপস্থানা সম্ভবপর বটে। এদিন আলোচনায় আরো অংশগ্রহণ করেন পিআইবির সিনিয়র প্রশিক্ষক আ স ম আব্দুল হক ও প্রক্ষিক আব্দুল মান্নান।
১৪ ডিসেম্বর, ২০১০ ছিল এই কর্মশালার সমাপ্তির দিন। এদিন ফিচার লেখার কলাকৌশল,সংবাদের ভাষ্য ও জেন্ডার সংবেদনশীলতা, সাক্ষাৎকার, প্রেস কন্ফারেন্স ও প্রেস ব্রিফিং ইত্যাদি বিষয়ভিত্তিক আলোচনার পর প্রশিক্ষনার্থীদের মাঝে সনদ বিতরণ উপলক্ষে এক সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি রুমি খোন্দকারের সভাপতিত্বে উক্ত সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য দেন ও সনদ প্রদান করেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোজাফ্ফর হোসেন।
এসময় পিআইবর সিনিয় প্রশিক্ষক আস ম আব্দুল হক, প্রশিক্ষক আব্দুল মান্নান ও পাবনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক উৎপল মির্জা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে মধ্যাহ্ন ভোজের পর আমরা কর্মশালা থেকে বিদায় নিলাম।( সময়কাল- ১৪-১২-২০১০) (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।