বাংলাদেশের রাজনীতিতে— নাম বদলের সংস্কৃতি


— এবাদত আলী —
দেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিবর্গ বা সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ অবদান রাখার কারণে দেশের যে কোন স্থাপনা বা বিদ্যাপীঠের নামকরণ সেই সকল গুণী ব্যক্তিদের নামে রাখার একটি রেওয়াজ অতি প্রাচীন আমল থেকেই প্রচলিত আছে। বিশেষ করে যাঁরা ইসলাম ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভুমিকা রেখেছেন তাদের বেলাতেই এটা বেশী লক্ষণীয়।
তবে এই নামের পরিবর্তন যে হয়না, তা কিন্তু নয়। যেমন বংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে যখন এ দেশ পুর্ব-পাকিস্তান ছিল তখন এই দেশের বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও অন্যান্য স্থাপনা সমূহের নাম যেমন জিন্নাহ কলেজ, জিন্নাহ পার্ক, লিয়াকত আলী কলেজ, নুরুল আমিন কলেজ ইত্যাদির নাম দেশ স্বাধীনের পরে আপনা আপনাই পাল্টে যায়। কারণ যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি এই দেশের নিরীহ মানুষের উপর নির্যাতন চালিয়েছিল, এই দেশের মানুষের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছিল, মহান স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে সেই সকল ঘটনার অবসান ঘটে। ফলে এ দেশের মানুষের অধিকার হরণকারীদের কথা এবং তাদের নামে বিদ্যাপীঠ বা স্থাপনা থেকে অতি ঘৃণার সাথেই তাদের নাম মুছে ফেলা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরশাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের বেলাতেও বলতে গেলে প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটেছিল। দেশের মানুষের নিকট থেকে স্বৈরাচার খেতাবে ভূষিত হয়ে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ন্যাক্যারজনকভাবে পদত্যাগ করার পর মূহুর্ত থেকেই তাঁর নামে গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা সমূহের নামের পরিবর্তন এবং নামফলক ভেঙ্গে ফেলার কাজ শুরু হয়ে যায়।
মুজিবনগর স্মৃতি সৌধের গেটে কবি রাষ্ট্রপতির একটি কবিতা শ্বেত পাথরে খোদাই করা ছিল। তাঁর লেখা সুন্দর সেই কবিতাটি ১৭ এপ্রিল,১৯৮৭’ তারিখে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের একটি তোরণ গাত্রে সেঁটে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কবি রাষ্ট্রপতি স্বৈরাচার হওয়ার কারণে কে বা কারা সেই সুন্দর কবিতা ও কবির নামের উপর কুঠার চালিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। পালাবদলের পর এরশাদ সরকারের মন্ত্রী- প্রতিমন্ত্রী এবং এমপি কর্তৃক উন্মোচিত ফলক গুলোর অবস্থা যে কি হয়েছিল তা যাঁরা স্বচক্ষে দেখেছেন কেবল তারাই বলতে পারবেন।
নাম বদল ও ফলক বদলের সংস্কৃতি এ দেশে নতুন কোন ঘটনা নয়। আওয়ামী লীগের শাসনামলে যমুনা নদীর উপর নির্মিত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সড়ক সেতুু ‘‘বঙ্গবন্ধু সেতু’’টি ১৯৯৮ সালের জুন মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেতুর দু‘পাড়ে তখন থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতির জনকের কন্যা বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশাল প্রকিতকৃতি শোভা পাচ্ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ২০০১ সালে বিএনপি জামাত জোট ক্ষমতায় আসার সাথে
সাথে রাতারাতি বঙ্গবন্ধু সেতুর নাম বদলিয়ে রাখা হলো যমুনা বহুমুখী সেতু, এবং সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রতিকৃতিও গায়েব হয়ে যায়। আবার ২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে যমুনা সেতুর নাম ‘‘বঙ্গবন্ধু সেতু’’ হয়ে যায়। সরিয়ে ফেলা প্রতিকৃতিও যথাস্থানে শোভা পেতে থাকে।
আবার ২০১০সালের ১৫ফেব্রুয়ারি বাংলা দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ‘জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের’ নাম পরিবর্তন করে তদস্থলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর নামকরণ করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি দারুনভাবে ক্ষুব্ধ হয়। তারা বিভিন্নভাবে এর প্রতিবাদ জানায়। এমনকি জাতীয় সংসদেও এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যগণ। এই প্রতিবাদকে আরো শক্তিশালী করার জন্য তারা জাতীয় সংসদ থেকে ওয়াক আউট পর্যন্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয় ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে সারা দেশের জেলা শহরে প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালন করা হয়।
পক্ষান্তরে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা সঙ্গত কারণেই এই নাম পরিবর্তন করেছেন। সেসময় ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রীসভার বৈঠকে নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব অনুমোদন হয়। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, অবৈধ স্বৈরশাসকদের নামে কোনো স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের নাম থাকা উচিত না,-আদালতের এমন রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রীসভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৭৯ সালে এ বিমান বন্দরের নাম ছিল ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। ১৯৮১ সালে এর নাম পরিবর্তন করা হয়।
পত্রিকাস্তরে প্রকাশিত খবর হতে জানা যায়, বিএনপি-জামাত জোট সরকার চন্দ্রিমা উদ্যানের নাম পরিবর্তন করে জিয়া উদ্যান, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র নামকরণ করে। শহীদ সোহরাওয়ারদী হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে বেগম খালেদা জিয়া মেডিকেল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ারদী হাসপাতাল করা হয়। বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের নাম পরিবর্তন করে ভাসানী নভোথিয়েটার, সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে কিশোরগঞ্জ জেলা স্টেডিয়াম, শেখ কামাল স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে গোপালগঞ্জ স্টেডিয়াম, শহীদ কামরুজ্জামান স্টেডিয়ামের নাম পরির্তন করে রাজশাহী বিভাগীয় স্টেডিয়ামসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা সমুহের নাম পরিবর্তন করে।
প্রধান মন্ত্রীর প্রেসসচিব আরো বলেন, চট্রগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমান বন্দর এবং খুলনায় প্রস্তাবিত খানজাহান আলী বিমান বন্দরের সাথে সঙ্গতি রেখে ঢাকা বিমান বন্দরের নাম হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর করা হয়েছে।
জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন স্থাপনার নাম পরিবর্তনে সরকারি পদক্ষেপের পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা নাম পরিবর্তন করেছিল তাদের শিক্ষা দিতেই এই নাম পরিবর্তন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধূ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা আরো বলেন, ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট কয়েক শ’সরকারি স্থাপনার নাম পরিবর্তন করেছিল। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ওই সব স্থাপনা তৈরি ও নামকরণ করা হয়েছিল।
বিএনপির জেষ্ঠ্য যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নাম পরিবর্তন করে সরকার অত্যন্ত কুরুচির পরিচয় দিয়েছে। এর মাধ্যমে সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করেছে। জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা। সরকারের অবশ্য এই বিষয়টি অনুধাবন করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, দেশের মানুষের নানা সমস্যা আড়াল করতে সরকার এটা করেছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সেসময় ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে বিএনপি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় দলীয় নেতারা বলেন, বিএনপিকে শিক্ষা দেয়ার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেই। আগামী নির্বাচনে জনগণই উচিত শিক্ষা দেবে। তারা বলেন, জিয়া বিমান বন্দরের নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে নাম পরিবর্তনের শিক্ষাই দিয়ে গেলেন। আগামীতে বিরোধী দল ক্ষমতায় গেলে তার দেওয়া শিক্ষা থেকে একই কাজ করবে।
তবে নাম বদলের সংস্কৃতিতে বিএনপি জামাত জোট সরকার প্রতিহিংসার আশ্রয় নিয়ে যে সকল স্থাপনার নাম পরিবর্তন করেছিল মহাজোট সরকার সেই সকল স্থাপনার নাম পুর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে কেবল। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করেছে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নাম পরিবতর্নে। এই নাম পরিবর্তন করে দলীয় কোন নেতা নেত্রীর নাম কিংবা জাতির জনক বঙ্গব›দ্ধু শেখ মুজিবের নামেও করেনি। সরকার যাঁর নামে নামকরণ করেছে, তিনি একজন আল্লহর ওলি। যিনি ৩শ৬০জন মুরীদ বা শিষ্যসহ বাংলার সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ এবং সিলেটের রাজা গৌর গোবিন্দের রাজত্বকালে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য এ দেশে আগমণ করেন।
মহান ওলিয়ে কামেল হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর নামে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নাম করণ করে এবং আওয়ামী লীগের শাসনামলে যে সকল স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল সেই সকল নাম পুর্বাবস্থায় ফিরিয়ে এনে নামবদলের সংস্কৃতিতে সরকার যে ভূমিকা পালন করে চলেছে তাতে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলকে ‘‘ঢিল ছুঁড়লে যে পাটকেল খেতে হয়’’ তারই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে বলেই মনে হয়। ওলি আল্লহগণের নাম ব্যবহার করে ধর্মীয় অনুভুতির কায়দায় বিএনপিই প্রথমে ২০০৫ সালের ২ এপ্রিল চট্রগ্রামের এমএ হান্নান বিমান বন্দরের নাম বদল করে ১৮ শতাব্দীর দরবেশ শাহ আমানত বিমান বন্দরের নাম রেখেছিল। মহাজোট সরকার কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কৌশল অবলম্বন করেছে মাত্র।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহেমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা জনগণের ভোটে বার বার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন। তার সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভে সক্ষম হয়েছে। এসময়কালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নামে দু একটি স্থাপনা ছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটালাইট, চট্রগ্রামের কর্নফুলি নদীতে বঙ্গবন্ধু ট্যানেল এবং বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুসহ যেসকল স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে যা বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামেই তা করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী খুলনা মেডিকেল কলেজ প্রকল্প থেকে তার নাম বাদ দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। গত ৯ মে’ ২০২৪ অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেকের) বৈঠকে খুলনা মেডিকেল কলেজ প্রকল্প থেকে ‘শেখ হাসিনা’ নামটি বাদ দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। পরে সবার অনুরোধে এ নামটি থাকলেও আগামীতে আর কোন প্রকল্প স্থাপনায় নিজের নাম না দেওয়ার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষের ভাগ্যনোœায়নের জন্য দিনবদলের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তাই নাম বদলের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে দিনবদলের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রতিই অত্যাধিক যতœবান। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)