। আমিরুল ইসলাম রাঙা।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১০ ই এপ্রিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষনা করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনের ঘোষনা করা হয়। যে সরকারকে প্রবাসী সরকার বা মুজিবনগর সরকার বলা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে ঢাকা সহ সারাদেশে হাজার হাজার নীরিহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। এরপর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সহ মুক্তিকামী জনতা প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। ১০ ই এপ্রিল ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষনা করা হয়। ১১ ই এপ্রিল প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ অজ্ঞাত স্থান থেকে রেডিওতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দেন।
১১ ই এপ্রিল কর্নেল এম,এ, জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি এবং কর্নেল আব্দুর রবকে চীফ অব ষ্টাফ ঘোষনা করা হয়। ১৭ ই এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় শতাধিক দেশী-বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী পরিষদ ঘোষনা করা হয়। এরপর উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, মন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং এ, এইচ, এম কামরুজ্জামান শপথ নেন। সেদিন শপথ গ্রহনের স্থান বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর নামকরণ করে বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী ঘোষনা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বলতে গেলে উল্লেখযোগ্য ঘটনার সাথে বিশেষ কিছু কথা বলা দরকার। ১৯৭০ সালের ৭ ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে। নির্বাচনের ৯০ দিনের মধ্যে ক্ষমতা প্রদানের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী ৭ ই মার্চ ছিল ক্ষমতা হস্তান্তরের শেষ দিন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১ লা মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এমন ঘোষণায় দেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।
১ লা মার্চ গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ২ রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ডাকসু’র ভিপি আ স ম আব্দুর রব স্বাধীন বাংলা’র পতাকা উত্তোলন করেন( মানচিত্র খচিত যে পতাকাটি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে ব্যবহার করা হয়)। ৩ রা মার্চ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ইশতেহার ঘোষনা করেন। ইশতেহারে উল্লেখ করা হয় এখন থেকে রাষ্ট্রের নাম হবে বাংলাদেশ। জাতির পিতা হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় সংগীত হবে আমার সোনার বাংলা – আমি তোমায় ভালবাসি। যা পরবর্তীতে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার অবিকল উক্ত সিদ্ধান্ত সমুহ অনুমোদন করেন। প্রবাসী সরকার ১০ ই এপ্রিল গঠন হলেও বঙ্গবন্ধুর ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষনাকে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সুচনা দিবস (মহান স্বাধীনতা দিবস) হিসেবে অনুমোদন করা হয়।
১০ ই এপ্রিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠন নিয়ে বলতে গিয়ে উপরের কথাগুলি অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলতে হলো। ১০ তারিখের ঘোষিত সরকার ১৭ ই এপ্রিল মেহেরপুর বৈদ্যনাথতলায় শপথ নিলেন। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হলো। হাজার হাজার তরুণ যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে ভারতের শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হলেন। ২ লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারালেন। প্রায় ১ কোটি মানুষের বাড়ীঘর লুঠপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। দেশী-বিদেশী রাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশের জনগণ আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান । বিশেষ করে ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি আমাদের পাশে থাকায় মাত্র নয় মাসে পাকিস্তানী সৈন্যদের পরাজিত করে ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন করা সম্ভব হয়। বাঙালী জাতির পরম সৌভাগ্য নয় মাসে স্বাধীনতা প্রাপ্তি।
বিজয়ের মাত্র ২৪ দিন পর ১৯৭২ সালের ১০ ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে থেকে অস্ত্র জমা নেওয়া হলো। মিত্রবাহিনী হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতের সেনাবাহিনীকে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। যুদ্ধবন্দী প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হলো। তখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে মানুষের চরম অভাব বিরাজ করছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে খাদ্য, বস্ত্রের সংকট দেখা দেয়। দেশের সর্বত্র সড়ক, রেলপথ, ব্রীজ, কালভার্ট, বিদ্যুৎ টাওয়ার প্রায় সব কিছু ধ্বংশপ্রাপ্ত ছিল।
পাকিস্তানী সৈন্যরা পরাজিত হওয়ার আগে চট্টগ্রাম বন্দর সহ গুরুত্বপূর্ন স্থাপনা সমুহে মাইন ও বোমা পুঁতে রেখেছিল। সেগুলো দ্রুত অপসারণ করা দরকার ছিল। এছাড়া বিজয় অর্জনের সময় অর্থ্যাৎ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত তীব্র শীত ছিল। অসহায় মানুষের মাঝে কম্বল এবং শীতবস্ত্র দেওয়া জরুরী হয়। সে সময় চাউল, আটা,তেল, লবন, চিনি, সাবান এমনকি পরিধানের কাপড় পর্যন্ত বিদেশ থেকে আমদানী করে অসহায় মানুষকে সাহায্য করতে হয়েছে। স্বাধীনতার অনেক বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও রেশন এবং ন্যায্যমূল্যে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করতে হতো। স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ রেশনের উপর নির্ভর ছিল।
দুর্ভাগ্য বাঙালী জাতির – দুর্ভাগ্য জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের। এদেশ থেকে পাকিস্তানী হানাদারদের বিতাড়িত করা সম্ভব হলেও দেশীয় হায়নাদের কাছে বঙ্গবন্ধু পরাজিত হন। সাত কোটি বাঙালীর আট কোটি কম্বল এনেও সবাইকে দিতে পারেন নি। খাদ্য, বস্ত্র, ঢেউটিন,কম্বল, চিনি এমনকি তেল, লবন এসব কিছু চোরেরা চুরি করলেন। বঙ্গবন্ধু ভয়ানক কষ্ট নিয়ে বলেছিলেন, মানুষ পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাত কোটি লোক যুদ্ধ করেন। ৩০ লক্ষ লোক শহীদ হন। সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর কাছে মানুষ হাত উঁচু করে ওয়াদা করেন তিন বছর তারা কিছুই চায় না। সেই বঙ্গবন্ধুকে মীর জাফরের দল সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে স্বপরিবারে হত্যা করেন। কারা হত্যা করলেন? বঙ্গবন্ধু যাদের বেশী ভালবেসেছিলেন। তিনি যাকে বেশী বিশ্বাস করেছিলেন- সেই বিশ্বাস ঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিশ্বাস ভঙ্গ করলেন। নিজ হাতে খুন করলো কারা? বঙ্গবন্ধু যাদের নিজের সন্তানের মত ভালোবাসতেন। ঘাতক কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশীদ, মেজর ডালিম, মেজর হুদাদের মত খুনীদের বঙ্গবন্ধু বীরউত্তম, বীরবিক্রম খেতাব দিয়েছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী দেয় ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জাতীয় চার নেতা এবং অল্প সংখ্যক মন্ত্রী এবং এমপি বাদে বেশীরভাগ নেতা ও সরকারের আমলারা খুনী মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল।
স্বাধীনতার পর সরকার যদি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা নিয়ে তাঁদের রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত করতেন। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর সহায়তাকারী অফিসার ও কর্মচারীদের চাকুরী থেকে যদি বিতাড়িত করতে পারতেন। ১৯৭২ সালের জুন-জুলাই মাসে ছাত্রলীগের বিভক্তি যদি রোধ করতে পারতেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক তাজউদ্দিন আহমেদকে মন্ত্রীপরিষদ থেকে বাদ না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী খোন্দকার মোশতাক আহমেদ সহ তার অনুসারীদের যদি সরকার থেকে বাদ দিতে পারতেন। যদি জেলায়-জেলায়, পাড়ায়-পাড়ায়, উশৃঙ্খল নেতা-কর্মীদের সশস্ত্র রিজার্ভ ক্যাম্প বন্ধ করে দিতে পারতেন। যদি সেদিন রক্ষীবাহিনীর মত বিশেষ বাহিনী না বানাতেন। যদি ১৯৭৪ সালের জরুরী অবস্থা ঘোষণা ১৯৭২ সালে দিতে পারতেন। ১৯৭৫ সালের ঘোষিত বাকশাল যদি ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হতো। আমার মনে হয় এইদেশ অন্য রকম বাংলাদেশ হতে পারতো!!! যদিও এখন এই ধরনের ভাবনা বা চিন্তার কোন মূল্য নাই।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন। তাঁর সময়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী বানিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুণর্বাসণ। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রাষ্ট্রদূত বানানো। এছাড়া তার সময়ে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা কে হত্যা করা হয়। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাত করা হয়েছিল । ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদের শাসন এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি শাসনে মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করা হয়েছে। প্রকৃত ইতিহাসকে আড়াল করতে গিয়ে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধীরে ধীরে ফিরে আসতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মান, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়তে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি ঘটে। বিশেষ করে একজন মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান করে সমাহিত করা। চাকুরী ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ের কোটা সংযোজন করে নাতী-নাতনীদের কোটা ভুক্ত করা। সন্মানী ভাতার পরিমান বহুগুণ বৃদ্ধি করা। চাকুরীরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবসরের মেয়াদ বৃদ্ধি করা সহ বোনাস প্রদান, ঋন প্রদান এমনকি এককালীন সহযোগিতা দেওয়া শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্বাধীনতার এত বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে। যেটা কোনভাবে প্রত্যাশিত নয়। বর্তমান সময়ে মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না তালিকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধারা সবাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কল্যাণ ট্রাষ্ট গঠণ করেছিলেন। কোকোকোলা বেভারেজ, নাবিস্কো বিস্কুট, গুলিস্তান ও নাজ সিনেমা হল, হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরী সহ বহু পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ট্রাষ্টকে দেওয়া হয়। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বড় অংকের টাকা ট্রাষ্টকে দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে এককালীন অর্থ দেওয়া হয়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার জন্য বিশ্রামগার করা, বীরঙ্গনা নারীদের পূনর্বাসন করা, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দেশ-বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় জন্য চাকুরীজীবিদের দুই বছরের সিনিয়রিটি দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর অসৎ আর অযোগ্য নেতৃত্বের জন্য সেই কম্বল আর লবন চুরির মত দৃষ্টান্ত স্থাপন হতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল ছিল মাত্র নয় মাস। যুদ্ধের প্রায় মাঝামাঝি সময় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা দৃশ্যমান হতে থাকে। একটি থানাকে জরিপ হিসেবে নিয়ে উল্লেখ করা হলো। যেমন পাবনার আটঘরিয়া থানায় জুলাই আগষ্ট মাসে ভারত থেকে আনোয়ার হোসেন রেনু’র নেতৃত্বে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল এলাকায় প্রবেশ করে। তাঁরা এলাকায় এসে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকার প্রচারনা চালায়। এলাকায় তরুণ যুবকদের রিক্রুট করে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। নানা ভাবে বন্দুক, রাইফেল সংগ্রহ করা এবং ছোট খাটো অপারেশন করে সমাজ বিরোধী ও স্বাধীনতা বিরোধী লোকজনকে নির্মুল করার অভিযান চলতে থাকে। ২২ শে অক্টোবর রাজাকারদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে ভারতীয় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দুইজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৬ ই নভেম্বর বংশিপাড়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে আরেক যুদ্ধে স্থানীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুইজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। একজন মুক্তিযোদ্ধা চাঁপাই নবাবগঞ্জের মহদিপুর যুদ্ধে এবং আরেকজন পুলিশের দারোগা ২৯ শে মার্চ পাবনার মালিগাছায় পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন। আটঘরিয়া উপজেলায় ৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং বর্তমানে প্রায় ১৫৭ জন গেজেটভূক্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এমন অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরে বর্তমান প্রজন্মের একজন কিশোর বা তরুণকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কে কে? নিশ্চিত বলতে পারবে কারা মুক্তিযোদ্ধা এবং কারা অমুক্তিযোদ্ধা। বড় পরিতাপের বিষয় এদেশে জীবন বাজী রেখে যারা যুদ্ধ করলেন, যারা রক্ত দিলেন যুদ্ধ পরবর্তী তাঁরা দীর্ঘ সময় অবহেলা আর অনাদরে জীবন কাটাতে হয়েছে। আর এখন অমুক্তিযোদ্ধাদের কারণে তাঁরা উপহাসের পাত্র হয়েছেন।
স্বাধীনতার পর একশ্রেনীর সুবিধাভোগী নেতাদের কারণে লক্ষ লক্ষ লোককে চাকুরী দেওয়া হয়েছিল। এমনও হয়েছে পাঁচ বা দশ জেলায় যত লোক চাকুরী পেয়েছেন তার চেয়ে এক থানাতেই বেশী লোককে চাকুরী দেওয়া হয়েছিল। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ পরিবারের কাউকে চাকুরী না দিয়ে স্বজনপ্রীতি করে অমুক্তিযোদ্ধা পরিবারের লোককেও চাকুরী দেওয়া হয়েছিল । হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকুরীতে সুবিধা নিয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই এমন বহুজন আছে যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হয়ে নয় মাস চাকুরী করার পরেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা নিয়েছে।
দুটি কথা বলতে যেয়ে হাজার কথা লিখতে হলো। হাজার কেন লক্ষ কথা বললেও এসব কথার শেষ হবে না। দুটি কথার চেয়ে বরং দুটি ঘটনা বলি। একটি হলো স্বাধীনতার পর ঢাকার মোহম্মদপুরে অবস্থিত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় কেন্দ্রে পাবনার মুজাহিদ ক্লাব পাড়ার জনৈক আব্দুর রাজ্জাক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রায় ২০ বছর সেখানে ছিল। সেখানে থেকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করার পর ২০ বছর পর জানা যায় সে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। অভিযোগে জানা যায় যুদ্ধের আগে পাবনা শহরের পাঁচ মাথা মোড়ে জনৈক তপন দাস তাকে চাকু মেরে আহত করেছিল। এরপর সে পঙ্গুত্ববরণ করে। মুক্তিযুদ্ধের সাথে আব্দুর রাজ্জাকের কোন সম্পর্ক ছিল না। স্বাধীনতার পর সে হয়ে যায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আরেকটি গল্প বলি পাবনার কাচারীপাড়ার জনৈক ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে কল্যাণ ট্রাষ্ট পরিচালিত গুলিস্তান ও নাজ সিনেমা হলের গেটম্যান হিসেবে চাকুরী করতো। সে দুর্নীতি করে ৫/৬ বছরের মধ্যে চলচ্চিত্রের পরিবেশক এবং প্রযোজক হয়েছিল। এমন দুটি গল্পের মত শত শত উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। পাবনায় জন্মগত পঙ্গু ব্যক্তি হয়েছে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার বহু পরে মারামারি করে আহত ব্যক্তি হয়েছে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে পাবনায় পরিচিত এক ব্যক্তি মিরপুরে শহীদ পরিবার হিসেবে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি দখল করে আছে। এদের কথা বলতে গেলে বলা উচিত এই অপরাধীদের থেকে অনেক বড় অপরাধ করেছে তারা যারা সামান্য অর্থের লোভ সামলাতে না পেরে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। ভুয়া ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের খাটো করেছে। জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ভুয়াদের মধ্যে বন্টন করে রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ করেছে।
আরেকটি কথা বলে এই লেখা শেষ করতে চাই। সেটা হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিলো জনগণের যুদ্ধ। যাকে বলা হয় জনযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের প্রায় দুই বছর পর ১৯৭৩ সালের ১৫ ই ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে প্রায় সাড়ে ছয়শত জনকে রাষ্ট্রীয় খেতাব দেওয়া হয়। যার মধ্যে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ, ৬৮ জন বীরউত্তম এবং বাঁকীদের বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক খেতাব পান। পদকপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রায় সাড়ে চারশত ছিল ডিফেন্সের। বাঁকী দুইশতের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা বিশেষ একটি জেলার। পাবনা সহ অনেক জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের কোন পদক দেওয়া হয়নি । এই পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অনেকেই আছেন যারা যুদ্ধে একটি গুলি না ছুড়েও সর্বোচ্চ পদক পেয়েছেন। জানা যায় পদকপ্রাপ্ত অনেকের ঠিকানা আজও খুঁজে পাওয়া যায় নি। কয়েক যুগ পরে তারামন বিবিকে খুঁজে পেয়ে তাঁকে পদক দেওয়া হয়েছিল। অথচ নয় নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম,এ জলিল, আট নম্বর সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্ণেল আবু ওসমান চৌধুরী এবং সাত নম্বর সেক্টরের প্রথম কমান্ডার মেজর নাজমুল হোসেনকে পদক দেওয়া হয় নি। অনেক সাব সেক্টর কমান্ডারকেও পদক দেওয়া হয়নি। এমন অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা পদক থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই বিষয়গুলি পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য জরুরী ভাবে প্রয়োজন অমুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। ভারতীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের “এ” গ্রেড ভুক্ত ও স্থানীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের “বি”গ্রেড ভুক্ত করে সন্মানী ভাতা পুনঃ নির্ধারন করা। রাষ্ট্রীয় পদক বন্টনের বিষয়ে পুনঃ বিবেচনা করা দরকার। বঞ্চিতদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী পদক প্রদান করা প্রয়োজন। সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নুন্যতম বীরপ্রতীক পদক প্রদান করা দরকার। মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরকে দেশের প্রথম রাজধানী ঘোষনা করে প্রতি বছর ১৭ ই এপ্রিল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গের উপস্থিতিতে মুজিবনগর দিবস পালন করা দরকার। ১০ ই এপ্রিলকে প্রজাতন্ত্র দিবস এবং ১৭ ই এপ্রিলকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করা দরকার।
আমার বিশ্বাস নিকট ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন বাংলাদেশে থাকবে না অনাচার-অবিচার, ঘুষ এবং দুর্নীতি। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগে অর্জিত বাংলাদেশে আরেকটি লড়াই হবে। সে লড়াই হবে সমাজ পরিবর্তনের লড়াই। স্বাধীনতার চার দশক পর যদি স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার হতে পারে এবং জাতির জনকের হত্যাকান্ডে জড়িতদের বিচার হয়ে শাস্তি কার্যকর হতে পারে। তাহলে স্বাধীনতার পাঁচ / ছয় দশক পরে হলেও রেহাই পাবে না এই দেশের সম্পদ লুন্ঠনকারীরা। জনতার বিজয় অনিবার্য। মনে রাখতে হবে এই দেশ স্বাধীন করেছে জনতা। এই দেশকে সোনার বাংলা বানাবে জনতা। আগামী দিনে জনতার প্রেরণা হবে একাত্তরের জনতা।
লেখক – আমিরুল ইসলাম রাঙা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবীদ।