বাঙালির হৃদয়ে একুশের চেতনা

— এবাদত আলী —
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়। ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুটি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের একটি প্রদেশ পুর্ব পাকিস্তান নামে মাত্র স্বাধীনতা পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তর ফারাক ছিলো। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠি সমগ্র পুর্ব পাকিস্তানের ৫৬% ভাগ লোকের
মাতৃভাষা বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। মাত্র ১০% ভাগ লোকের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভনর্ণর জেনারেল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার তৎকালিন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান ) এক বিশাল সভায় একতরফা ভাবে ঘোষণা করেন যে “উর্দু এবং কেবল মাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা”।
এহেন একতরফা ভাবে অযৌক্তিক ঘোষণায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে তৎকালিন পুর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষি মানুষ। তাদের মনে সন্দেহের বীজ দানা বেধে ওঠে। পাকিস্তান নামের মোহচ্ছন্নতার আবেশে এ কোন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার হতে লাগলো। রাষ্ট্রনায়কের এহেন ঘোষণায় ব্যথিত বাঙালির কন্ঠে তাই ‘না’ শব্দ ধ্বনিত হলো জনসভার মাঝ থেকে। তৎকালিন মুসলিম ভারতের একমাত্র নেতা উপমহাদেশের মুসলিম জনগণের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নিকট সেদিনকার জনসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রের প্রতিবাদ তাঁর নিকট ঔদ্ধতপনা বলেই মনে হয়েছিলো।
এর মাত্র চার দিন পর ২৪ মার্চ ঢাকার কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই উক্তির পুনরাবৃত্তি করেন। “এটা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া উচিত যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা অন্য কোন ভাষা নয়।” সে দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ ছিলেন আরো সংঘবদ্ধ। তারা পুর্বাহ্নেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন যে মাতৃভাষা বাংলার বদলে রাষ্ট্রভাষা উর্দু সংক্রান্ত কোন কথার আভাস পাওয়া গেলে তার প্রতিবাদ করতে হবে। জিন্নাহ সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই ছাত্রনেতাসহ অন্যান্য ছাত্রগণ সমস্বরে না-না বলে চিৎকার করে ওঠেন। পুরা কার্জন হল না-না ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ক্ষনিকের জন্য স্তম্ভিত হন। কিন্তু প্রক্রিয়া চলতে থাকে ভিন্ন্ ভাবে। বাংলা ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করার মানসে পাকিস্তানের শাষক গোষ্ঠি পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম ডাকটিকিট, মনি অর্ডার ফরম এবং ব্যাংক চালানে উর্দুর পাশে ইংরেজির স্থান করে দিলেও বাংলার কোন স্থান সেখানে ছিলোনা। এমনকি নতুন রাষ্ট্রের মুদ্রা থেকেও অত্যন্ত সুকৌশলে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়া হয়। সদ্যলব্ধ পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় শাসকগোষ্ঠির এ জাতীয় হঠকারিতা তৎকালীন পুর্বপাকিস্তানের জনগণকে দারুন ভাবে আহত করে। শুরু হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণ ও ছাত্র সমাজ ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর গঠন করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণ পরিষদে ইংরেজি এবং উর্দুতে বক্তৃতা করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এতে পাকিস্তান গণ পরিষদে কুমিল্লার বাঙালি সদস্য বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত (১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত ) দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠির মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করার দাবি জানান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খাঁন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। এ জাতীয় প্রস্তাব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার নামান্তর বলেও তিনি মন্তব্য করেন। পাকিস্তানের তৎকালিন পুনর্বাসন মন্ত্রী গজনফর আলী খান প্রধানমন্ত্রীর ঐ বক্তব্যকে সমর্থন করে পরিষদ কক্ষে এক বিবৃতি দেন। ঐ বিবৃতির মাধ্যমে তিনিও জানান যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা একটিই হবে তা হবে উর্দু।
এদিকে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন করা হয় এবং ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ হতে ৭ দফা দাবিনামা সরকারের কাছে পেশ করা হয়। পুর্ব-বাংলার অফিস আদালত এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাংলা ভাষার প্রচলন, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য কেন্দ্রিয় সরকারের কাছে সুপারিশ করে পূর্ব বাংলা আইনসভা প্রস্তাব গ্রহন করবে। এ ধরনের দাবি সমূহ তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন মেনে নেওয়ার পক্ষে ১৯৪৮ সালের ১৪ মার্চ তারিখে স্বাক্ষর করেন।
কিন্তু ১৯৫১ আলের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হাতে নিহত হবার পর খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের ৭ দফা চুক্তির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি তারিখে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। বাংলা ভাষার ব্যপারে তার এই বিশ্বাসঘাতকতার পর ঢাকায় ছাত্র আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে।
সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১ মাসের জন্য সভা সমিতি শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৪৪ ধারা জারি করে।
এ সময় ছাত্র রাজনীতি সচেতন যুব সমাজ সোচ্চার হয়ে ওঠে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রিয় মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করার মানসে ঢাকার জগন্নাথ হলে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মেনে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টির ব্যাপারে ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। প্রাদেশিক সরকার অবস্থা আঁচ করতে পেরে ১৪৪ ধারা জারি করেন। এতে আন্দোলন কারিরা কিছুতেই পিছুপা হলেন না। বরং দশ জনে গ্রুেেপ গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তারা প্রাদেশিক ভবনের দিকে এগুতে থাকেন।
ছাত্রজনতার মিছিল এমনিভাবে এ দিন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪ টার দিকে মেডিকেল কলেজের মোড় ছেড়ে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের কাছা কাছি পৌঁছতেই পুলিশ তাদের উপর বেপরোয়া ভাবে গুলি বর্ষণ করে।
মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে মিছিলের মাঝে গুলিতে ঘটনাস্থলে রফিক উদ্দিন, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাশের ছাত্র আবুল বরকত প্রাণ হারান। আহত এবং গ্রেফতার হন আরো অনেকে। ঢাকার রাজপথ মহান ভাষা শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়। আর এ ভাবেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চিহ্নিত হয় বাংলার মানুষকে অধিকার সচেতন করার লক্ষ্যে এক অন্য দিবস হিসাবে। রক্তস্নাত অমর একুশের চেতনা তাই প্রতিবছর ফিরে আসে বাঙালির হৃদয়ে।
(লেখক:-সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট