গরীবে নেওয়াজহজরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (র.)

— এবাদত আলী —
সমগ্র ভারতবর্ষ যখন অন্যায়, অত্যাচার, পাপাচার, জুলুম-নির্যাতন আর অন্ধকার কুসংস্কারে ভরপুর, মানুষ চরম নৈতিক অধঃপতনের মাঝে যখন নিপতিত, আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে যেমন আরব সাম্রাজ্যের অবস্থা বিরাজমান ছিল ঠিক তেমনি অবস্থার মাঝে সকল অন্ধকার কুসংস্কার ও জুলুম অত্যাচারের অবসান ঘটিয়ে ইসলামের আলোক বর্তিকা হাতে নিয়ে যিনি তৎকালীন ভারত ভূ-ভাগে আগমণ করেছিলেন, সেই মহান সাধকের নাম হজরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (র.)।
মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর নিকট হতে স্বপ্নযোগে আদেশ প্রাপ্ত হয়ে তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে আগমণ করেছিলেন। যতদুর জানা যায় হজরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (র.) হিজরী ৫৩৭ সালের ১৪ রজব ইরানের খোরাসানে সাঞ্জার নামক গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা হজরত গিয়াস উদ্দিন (র.) ছিলেন একজন বুজর্গ ব্যক্তি এবং ধনি ব্যবসায়ী। তাঁর মাতার নাম বিবি উম্মুল ওয়ারা (র.)। তাঁর পিতা মাতা উভয় দিক খেকেই হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর নাতি হজরত ইমাম হাসান (রা.) এবং হযরত হোসাইন (রা.)এর বংশধর। তিনি গাউসুল আজম মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানী (র.) এর ঘনিষ্ট আত্মীয় ছিলেন। বাল্যকালে তাঁর নাম ছিল মঈন উদ্দিন হাসান। তাই হাসান নামেও তিনি পরিচিত। হজরত খাজা মঈউদ্দিন চিশতি (র.) মাত্র ৭ বছর বয়সে উপনীত হবার পর হতেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত আদায় করতেন ও নিয়মিত রোজা রাখতেন এবং জিকিরের মাহফিলে যোগদান করতেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতা-মাতাকে হারান। পিতার মৃত্যুকালীন সময়ে খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (র.) উত্তরাধিকার হিসাবে একটি পেষন কল ও ফলের বাগান পেয়েছিলেন। তিনি দ্বীন-ই এলেম শিক্ষা লাভের জন্য ঘরবাড়ি পরিত্যাগ করে তিনি সমরখন্দ গমন করেন। সেসময় সমরখন্দ ও বোখারা ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ছিল। বড় বড় মোহাদ্দেছ, ফকিহ, দার্শনিক ও চিন্তাশীল পন্ডিতগন সেখানে ছিলেন। তিনি তাফসির, হাদিস, ফেকাহ, ওসুল, মানতেক ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। হজরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (র.) এর স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যাধিক প্রখর। তিনি অতি সল্প সময়ের মধ্যেই পবিত্র কোরআন হেফজ করেন এবং ইসলাম ধর্মীয় জ্ঞানে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করেন।
এরপর তিনি গাউসুল আজম হজরত আব্দুল কাদের জিলানী (র.)এর সাথে সাক্ষাত করেন। তথায় ৫৭ দিন ব্যাপি ইলমে মারেফাত, ইলমে লাদুনী ও তাসাউফ এবং বাতেনি ফয়েজ লাভ করেন। ইরাকে যাবার পথে নিশাপুর জেলার হারুন নামক স্থানে প্রখ্যাত শাহ সুফি সাধক হজরত খাজা শাহ সুফি ওসমান হারুনীর সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাঁর নিকট বয়াত হন। এরপর চিশতিয়া তরিকার শিষ্যত্বে নিজেকে সপে দেন। দীর্ঘ ২০ বছর যাবত তিনি পীরের সাহচার্যে থেকে তাঁর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক ও বাতেনী এলেম লাভ করেন। তিনি তাঁর পীরসহ পবিত্র মক্কা ও মদীনা শরীফে গমণ করেন। মুর্শিদ তাঁকে জড়িয়ে ধরে আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বল্লেন, “ হে আল্লাহ আমি মঈন উদ্দিনকে তোমার হাতে সোপর্দ করলাম।” অতঃপর উভয়ে হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর রওজা মোবারক জিয়ারতের জন্য মদীনা শরীফে গমণ করেন। এখানে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) তাঁকে সপ্ন যোগে আজমীরের সব স্থানের পরিচয় করিয়ে দেন এবং আজমীর যাবার জন্য নির্দেশ দেন।
অতঃপর তিনি আজমীরের দিকে রওনা হন। পথে স্বল্প সময়ের জন্য তিনি লাহোরে অবস্থান করেন। লাহোরে অবস্থানকালে শায়খ আলী আলহাজ উইরী (র.) এর মাজারে কিছু সময় মোরাকাবা করেন। এরপর দিল্লীতে আগমণ পূর্বক তথায় বহসংখ্যক লোককে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং আজমীরের দিকে রওনা দেন।
এদিকে শিহাব উদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী পৃত্থিরাজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে পৃত্থিরাজের সেনাবাহিনী পরাস্থ হয় এবং পৃত্থিরাজের সকল দর্প চুর্ন হয়। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানেই সারা ভারতবর্ষ ইসলাম ধর্মের আলোকে উদ্ভাসিত হতে থাকে। মহান সাধক হজরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (র.) সকল সময় আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। দুনিয়ার লোভ লালসা তাঁর কাছে ছিল অতি তুচ্ছ। তিনি আল্লাহ তায়ালার প্রেমে এমনি মমগুল থাকতেন যে, একাধারে সাত দিন রোজা রাখতেন এবং সামান্য পরিমান আহার্য দিয়ে সাহরি খেতেন ও রোজার এফতার করতেন। তিনি প্রতি দিবা-রাত্র আড়াই হাজার রাকাত নফল নামাজ আদায় করতেন এবং প্রায় প্রতিদিনই পবিত্র কোরআন খতম করতেন। তাঁর পরিধানে ছিল মাত্র একখানা চাদর। তা কখনো ছিঁড়ে গেলে তিনি নিজ হাতে সেলাই করে পরিধান করতেন। তাঁর ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও আধ্যাত্মিক শক্তির কাছে মানুষ সহজেই মোহিত হয়ে যেতো। তিনি কাউকে জোর পুর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করেননি। তিনি ৫৬১ হিজরীতে অধিক বয়সে বিবাহ করেন। তাঁর প্রথমা স্ত্রী সামন্ত হিন্দু রাজার কন্যা বিবি আমাতুল্লুাহ। তাঁর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন এক কন্যা, বিবি হাফেজ জামিলা। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম বিবি ইসমাতুল্লাহ বানু। তিনি ছিলেন সাইয়িদ হাসান মাশহাদির কন্যা। তার গর্ভে জন্ম লাভ করেন পুত্র সায়খ ফখরুদ্দিন, শায়খ আবু সাঈদ এবং শায়ক হুসামদ্দিন (র.)।
হজরত খাজা মঈন উদ্দিস চিশতি (র.) ৬৩২ হিজরীর ৬ রজব শুক্রবার আজমীর শরীফে ইন্তেকাল করেন। তিনি ইসলামী সুফিবাদের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা সুবিদিত ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন এবং উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা। সুলতানুল হিন্দ, আফতাবুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ তাঁরই উপাধি। প্রতি বছর ৬ রজব আজমীর শরীফে তাঁর মাজার প্রাঙ্গনে ওরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।


এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব