// এবাদত আলী //
মানুষ যখন থেকে সভ্যতার পরিমন্ডলে বসবাস করতে থাকে তখন থেকেই ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন তথা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সময়কাল সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের উপায় হিসাবে সন পদ্ধতি অনুসৃত হয়।
অতীত ইতিহাস হতে প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে জানা যায় সভ্য পৃথিবীতে চন্দ্র ও সুর্যের হিসেবেই সাধারণতঃ বর্ষ গণনা শুরু হয়।
বর্ষপঞ্জি রচনার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রাচীন মিশরীয় পন্ডিতগণ বছরের পর বছর নীল নদের জোয়ার ভাটা ও সন্নিহিত অঞ্চলে প্রাকৃতিক পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে করতে চান্দ্র বর্ষের পরিবর্তে সৌর বর্ষের দিন গণনার প্রয়াস পান।
প্রচীন যুগে চাঁদই ছিল তারিখ ও সন গণনার মাধ্যম। প্রাচীন আরব জণগন বর্ষ গণনায় প্রথমতঃ কোন নির্দিষ্ট সন সাব্যস্ত করতোনা। তারা একটি স্মরণীয় ঘটনার আগে পরে জুড়ে দিয়ে গণনা করতো। নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের নানা সন তারিখ যেমন বলা হতো অমুকের জন্ম বুসুম যুদ্ধের পর। অমুকের ছেলের জন্ম হস্তি বাহিনীর আক্রমণের বছর। অমুকের ব্যবসা শুরু হয় হাতি বর্ষের দুবছর পর। হেজাজের মহামারি বা নজদের দুর্ভিক্ষের পাঁচ বছর আগে। যীশু খ্রিষ্টের জন্ম সময়কাল স্মরণে কয়েক বছর পর হতে খ্রিষ্ট অব্দ বা খি ্রষ্টাব্দ কাল গণনা শুরু হয়। সন বা সাল গণনা সর্ব প্রথম শুরু হয় রোম সাম্রাজ্যে।
রোমানদের প্রাচীন ক্যালেন্ডারে তখন মাস ছিলো- ১০টি, সে সময় ৩০৪ দিনে বর্ষ গণনার প্রচলন ছিলো। মধ্যশীত মৌসুমের ৬০ দিন তারা গণনা থেকে বাদ রাখতো। রোমানদের বর্ষ গণনার প্রথম মাস ছিলো মার্চ। তখন ১ মার্চে পালিত হতো নববর্ষের উৎসব।
রোমের উপাখ্যান খ্যাত প্রথম সম্রাট রমুলাসই নাকি ৭৩৮ খিৃষ্টপুর্বাব্দে রোমান ক্যালেন্ডার চালু করেন। পরবর্তীকালে রোমান সম্রাট নুমা ১০ মাসের সাথে আরো দুটো মাস যুক্ত করেন। সে দুটো মাস হচ্ছে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি। তিনি জানুয়ারিকে বছর শুরুর মাস এবং ফেব্রুয়ারিকে বছর সমাপ্তর মাস হিসেবে বর্ষ গণনায় যুক্ত করেন।
জানুয়ারি মাস ধার্য করা হয় ২৯ দিন এবং ফেব্রুয়ারি ২৮ দিনে। এছাড়া মারসিডানস নামে অতিরিক্ত একটি মাসের প্রবর্তন করেন যা ২২ দিনে গণনা করা হতো।
খিৃষ্টপুর্ব ৪৫২ অব্দে সম্রাট নুমা কর্তৃক প্রবর্তিত মাসের হিসাব পরিমার্জন ও পরিবর্তন করা হয়। পরবর্তীকালে রোমানরা চার বছর অন্তর অন্তর লিপইয়ারের হিসাবের প্রবর্তন করে।
রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার খিৃষ্টপুূর্ব ৪৬ অব্দে মিশর দেশ জয় করার পর মিশরীয়দের মধ্যে প্রচলিত সৌরবর্ষ পঞ্জিকা স্থান পায়। সম্রাট সিজার মিসরীয় পন্ডিত সোসিজেনিসের পরামর্শ অনুযায়ি রোমান বর্ষ পঞ্জির ব্যাপক সংস্কার করেন। সে সময় ১ মার্চের পরিবর্তে ১ জানুয়ারিতে নববর্ষ গণনা করা হয়। এই বর্ষপঞ্জির নাম সিজারিয়াস বর্ষপঞ্জি।
যীশু খ্রিষ্টের জন্ম বছর থেকে গণনা করে ডাইওনিসিয়াম এক্সিগুয়াস নামক এক খ্রিষ্টান পাদ্রি ৫৩২ অব্দ থেকে খ্রিষ্টাব্দ গণনার সুচনা করেন।
১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জ্যোতিবিজ্ঞানীদের পরামর্শক্রমে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধন করেন। গ্রেগারিয়ান ক্যালেন্ডার এখন পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচলিত বর্ষপঞ্জি এবং এই পঞ্জিই আমাদের দেশে ইংরাজি ক্যালেন্ডার হিসাবে পরিচিত।
ইংরাজি সনের কয়েকটি মাস বিভিন্ন দেব দেবীর নাম বহন করছে- যেমন প্রাচীন রোমের দ্বার রক্ষি বলে কথিত জানুস দেবতার নাম অনুসারে জানুয়ারি মাস, প্রাচীন রোমের যুদ্ধ দেবতা বলে কথিত মার্স এর নাম অনুসারে মার্চ মাস, রোমানদের দেবরাজ বলে কথিত জুপিটারের পতিœ জুনোর নামানুসারে জুন মাস এবং একইভাবে দেবদেবির নামের সাথে যুক্ত করে ইংরাজি মাস সমুহের নাম করণ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে একথা বলা যায় যে, আমাদের দেশে ইংরাজি সন তারিখের যে উল্লেখ করা হয় তা প্রকৃত পক্ষে ইংরাজি সন তারিখ নয়। এটা মুলত বিশ্বের বহুল প্রচলিত খ্রিষ্টিয় বা ইসায়ী সাল। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও লেখক