ঈশ্বরদী (পাবনা) সংবাদদাতাঃ
ঈশ্বরদীতে পৌরসভার টোল আদায়ের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে মহাসড়কের পাশে রঙ্গিন ছাতা ও কাঠের ব্রেঞ্চ নিয়ে একটু আড়ালে দলবদ্ধভাবে বসে আছে কয়েকজন যুবক। হাতে রয়েছে রশিদ ও কলম। ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত মালবাহী ট্রাকসহ ছোট-বড় যানবাহন দেখলেই দৌড়ে এসে মহাসড়কেই থামিয়ে দিচ্ছে। রশিদ দিয়ে চালক ও তার সহকারীর কাছ থেকে টোলের নামে আদায় করা হচ্ছে টাকা। রশিদে ইজারাদারের নাম লেখা রয়েছে। টাকা দিতে না চাইলে চালকদের সাথে আদায়কারীর ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকে। দীর্ঘসময় গাড়ি আটকে রাখার ঘটনাও ঘটছে। এভাবেই প্রকাশ্যে পৌরসভার টোল আদায়ের নামে চাঁদাবাজীর দৃশ্যের দেখা মিলেছে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ঈশ্বরদী-পাবনা মহাসড়কের আলহাজ্ব মোড়সহ কয়েকটি এলাকায়।
জানা গেছে, মহাসড়কে যানবাহন থামিয়ে টোল আদায় বন্ধ করতে হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট পিটিশন নং- ৪৬৪০/২০২২ এর মোতাবেক গত ২১ এপ্রিল আদেশের আলোকে টার্মিনাল ব্যতিরেকে সড়ক-মহাসড়ক থেকে টোল আদায় না করার জন্য সকল সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদের দৃষ্টি আকর্ষণ পূর্বক বিজ্ঞপ্তি জারি করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ হতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। হাইকোর্টের অনুলিপি অনুযায়ী টার্মিনাল ছাড়া টেন্ডার হয় না। পৌরসভার বিধানের ৯৮ ধারার ৭ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে শুধু মাত্র পৌরসভা নির্মিত টার্মিনাল ছাড়া পার্কিং ফিথর নামে টোল আদায় সম্পূর্ণ অবৈধ। অথচ এখানে ট্রাক টার্মিণাল না থাকলেও বছরের পর বছর ধরে পৌর উন্নয়নের নামে টোল আদায়ের রসিদ দিয়ে সড়কের একাধিক স্থানে চাঁদাবাজি চলছে।
সূত্র জানায়, ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাত্র এক লাখ টাকায় পৌরসভা থেকে টোল আদায়ের ইজারা পান আবুল কাশেম। শহরের বকুলের মোড়, চাঁদআলীর মোড়, রেলগেট, ভেলুপাড়া মোড়সহ পাঁচটি স্থানে ইজারাদারের প্রায় ১৫ জন চাঁদা আদায় করছেন। মালবাহী ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যান, নছিমন, বাস, মিনিবাস থেকে ৫০ টাকা, অবৈধ ইঞ্জিনচালিত ভটভটি থেকে ২০ টাকা ও পন্যবাহী ব্যাটারিচালিত ভ্যান থেকে ১০ টাকা করে আদায় হয়। প্রতিদিন প্রায় চার শতাধিক যানবাহন থেকে ৩২ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে। হিসাব করলে দেখা যায়, মাসে ৯ লাখ এবং বছরে এক কোটি টাকার বেশি আদায় হয়। রাতে উল্লেখিত মুল্যের থেকে বেশি পরিমাণে, অনেক সময় রশিদ ছাড়াই চাঁদা দিতে হয় বলে অভিযোগ চালকদের।
হাইকোর্টের রিট পিটিশনের আদেশের প্রেক্ষিতে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা এলাকার সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন থামিয়ে ইজারার নামে টোল আদায় বন্ধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পৌর-১ এর উপসচিব মেয়রদের চিঠি দেন। চিঠিতে টার্মিনাল ব্যাতিরেকে কোন সড়ক বা মহাসড়কে যানবাহন থামিয়ে টোল উত্তোলন না করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনা অমান্য করে ইজারার নামে সড়ক-মহাসড়ক থেকে টোল আদায় সম্পূর্ণ অবৈধ ও ফৌজদারি অপরাধের আওতাভুক্ত বলে জানা গেছে।
কয়েকজন ট্রাক চালক অভিযোগ করেন, ঈশ্বরদীতে ট্রাকের নির্দিষ্ট কোন টার্মিনাল না থাকার কারনে পৌরসভার নাম করে ইজারাদারের লোকজন সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন থামিয়ে চাঁদা আদায় করছে। সারা বছরই তারা এভাবে চাঁদা আদায় করে। চাঁদা দিতে দেরি হলে বা অস্বীকৃতি জানালে হয়রানি হতে হয়। রাত ১০ টার পর গাড়ি নিয়ে ঢুকলেই তারা রশিদ ছাড়াই বাড়তি টাকা দাবী করে।
ব্যাটারিচালিত ভ্যানে ফার্ণিচারের মাল নিয়ে পাবনা থেকে ঈশ্বরদী আসছিলেন আমিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, পৌরসভার লাইসেন্স আছে এরপরও আমার থেকে জোর করে পাঁচ টাকার পরিবর্তে দশ টাকা নিয়েছে। লাইসেন্স থাকলে কোথাও চাঁদা দেওয়ার নিয়ম নাই। চাঁদার টাকা না দিলে ইজারাদারের লোকজন অনেক খারাপ ব্যাবহার করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আদায়কারীদের একজন বলেন, আমরা ইজারাদরের নিয়োগকৃত শ্রমিক। টাকা আদায় করে ইজারাদারের হাতে দিয়ে আসি। পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে কাজ করি। তবে এ টাকা কোথায় যায়, কি কাজে ব্যবহার হয় তার কিছুই জানিনা।
ইজারাদার আবুল কাশেম বলেন, পৌরসভার অনুমতিক্রমে ইজারার মাধ্যমে টাকা তোলা হয়। প্রতি বছরই পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের দায়িত্বে থাকা সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক মিলে পৌরসভাকে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ দিয়ে টোল আদায়ের ইজারা নেয়া হচ্ছে।
পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক রেজাউল করিম নান্টু ও ৮ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি ওসমান আলী জানান, এক বছর পর পর পৌরসভা থেকে ইজারা নেওয়া হয়। পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডের মোট ১৮ জন নেতার সমন্বয়ে ইজারা নিয়ে টোল আদায় করা হয়। তবে টোল আদায়ের বৈধতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন, এটা মেয়র বলতে পারবেন।
পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম বলেন, আওয়ামীলীগের দায়িত্বে থাকা নেতারা কিছু টাকা দিয়ে পৌরসভা থেকে ইজারা নিয়ে এ টোল আদায় করছেন। আদায়কৃত টোলের টাকা তারাই ভাগাভাগি করে নেন। আদালতের নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি মোটর সাইকেলে নেমে ফোন দিচ্ছি। পরে তিনি আর কিছু জানাননি।
পৌরসভার মেয়র ইসাহক আলী মালিথা বলেন, পৌরসভা থেকে ডাক হয়ে পৌর এলাকার ভেতরে মালামাল আনলোডের সময় টোল আদায় হয়। তবে সিএনজি বা অটো থেকে আদায় করা হয় না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, নসিমন, করিমন, ভটভটি এগুলো থেকে আদায় হয়। এক বছরের জন্য ইজারা দিয়ে পৌরফান্ডে টাকা পাই। পৌরসভার উন্নয়নের জন্য দীর্ঘদিন ধরে টোল আদায় হচ্ছে। ইজারার মাধ্যমে এটি সম্পূর্ণ বৈধ উপায়ে আদায় হচ্ছে। এবিষয়ে হাইকোর্টের কোন নিষেধাজ্ঞা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, সব জায়গাতেই টোল আদায় করা হয়।
স্থানীয় সরকার গবেষক মোশারফ হোসেন মূসা হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা বা মন্ত্রণালয়ের আদেশ সম্পর্কে অবগত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার আয় বৃদ্ধির জন্য যানবাহন কর ধার্য্য করতে পারবে। কিন্তু এখানে যে ট্যাক্স ওঠানো হচ্ছে তার কোন হিসেব-নিকেশ নেই। বাৎসরিক ইজারা প্রদান সম্পূর্ণ অবৈধ জানিয়ে তিনি বলেন, পৌরসভার নিজস্ব কালেক্টর এটা আদায় করবে এবং প্রতিদিনের আয় পৌরসভার এ্যকাউন্টে জমা দিবে। এই অর্থ কোন কোন খাতে ব্যয় করা যাবে তারও সরকারি নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু এখানে যেটা হচ্ছে পুরোটাই নয়-ছয়, ব্যয় হচ্ছে গায়েবি খাতে। এই নয়-ছয় ঠোকাতে হলে জনগণকে সচেতন হতে হবে।
ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার গোস্বামী বলেন, সড়কে যানবাহন থামিয়ে চাঁদা বা টোল আদায়ের ইজারা সংক্রান্ত বিষয়ে ধারণা নেই। পৌর কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে দেখবো এটি বৈধ না অবৈধ। যদি অনিয়ম থাকে তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।