মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী স্মরণে

— এবাদত আলী —
মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বৃহত্তর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জের অদুরে ধানগড়া গ্রামে ১৮৮০ সালে ১২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে তাঁর নাম ছিল চেগামিয়া। তাঁর পিতার নাম সরাফত আলী খান এবং মাতার নাম মজিরন নেছা। ছেলেবেলা তিনি পিতামাতাকে হারিয়ে চাচার তত্বাবধানে লালিত পালিত হন। বাল্যশিক্ষার জন্য গ্রামের একটি পাঠশালাতে তাঁকে ভর্তি করা হয়। এরপর সুদুর ইরাক হতে আগত সৈয়দ নাসির উদ্দিন বোগদাদী পীর ছাহেবের কাছে তিনি আরবী ও ফারসী ভাষা শিক্ষালাভ করেন। পীর ছাহেব তাঁকে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রসাতে পাঠান।
প্রথম জীবনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী টাংগাইলের কাগমারিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এসময় দরিদ্র প্রজাদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার চরমে পৌঁছে। কৃষকেরা সংসারের খরচ এবং খাজনা পরিশোধের জন্য মহাজনদের নিকট জমি বন্ধক রেখে উচ্চহারে সুদে ঋণ গ্রহণ করতো। এই ঋণ পরিশোধে যতই বিলম্ব ঘটতো ঋণের বোঝা ততই বাড়তো। সুদের টাকা জোগাড় করতে গিয়েই হিমশিম খেতো। ঋণের আসল টাকাই শোধ হতোনা কোনদিন। বন্ধকি জমি চলে যেতো মহাজনদের হাতে। জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার যখন চরমে তখন মওলানা আব্দুল হামিদ খান এর জোরালো প্রতিবাদ করেন। জমিদারেরা জোটŸদ্ধ হয়ে তাঁকে কাগমারি ছাড়তে বাধ্য করে। কাগমারি থেকে তিনি পাবনা চলে যান। সেখানেও কৃষকদের দুর্দশার একই চিত্র দেখতে পান। এসকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন।
১৯১৯ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান, চিত্তরঞ্জন দাস, মওলানা আজাদ সুবহানি, মওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রভৃতি ব্যক্তিদের সঙ্গে স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দেন। তৎকালিন আসামে মোট ১৬ লাখ লোকের মধ্যে ৫ লাখ বাস্তুহারা বাঙালির ভাগ্য পরিবর্তনে তিনি “লাইন প্রথা” ভাঙার বিদ্রোহি সম্মেলনের ডাক দেন।
১৯২৪ সালে ভাসানডাঙার চরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে “ লাইন প্রথা” ভঙ্গ করেন। সেই থেকে মওলানা আব্দুল হামিদ খানকে ভাসানী উপাধীতে ভুষিত করা হয়। এদিকে আসামে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন। পাশাপাশি পুর্ব বাংলার সাথেও তাঁর যোগসুত্র ছিল। ১৯৩৭ সালে মহাপ্লাবিত টাংগাইলে ত্রান সামগ্রি বিতরণ করতে এসে তিনি কাগমারিতে ঘাঁটি স্থাপন করেন। সেই সাথে মুসলমানদের পক্ষ হতে দাবি তুললেন সন্তোষ জমিদারির অধিকারের। অত্যাচারে জর্জরিত এলাকার কৃষকগণ বহুবিধ দাবির ভিত্তিতে গোটা এলাকায় অসন্তোষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়। একারণে তিনি জমিদারদের কোপানলে পড়ে সেখান থেকে বিতাড়িত হন এবং গাইবান্ধায় গিয়ে আশ্রয় নেন। সামন্ত জমিদারের বিরুদ্ধে জমিদারি ও চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের অবসানের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করায় তিনি গাইবান্ধা হতে বহি®কৃত হয়ে পুনরায় আসামে যেতে বাধ্য হন। আসামে তাঁর ১৩ বছর প্রবাস জীবন কাটে। তন্মধ্যে ৮ বছরকাল সময় কারাগারে কেটেছে। মওলানা ভাসানী এরই মাঝে আসাম আইনসভার সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি আসামে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। মওলানা ভাসানীর প্রচেষ্টায় আসামে ৩৩ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়। কিন্তু পাকিস্তনি শাষকগোষ্ঠির শোষন, নির্যাতন, ব্যর্থতা ও দুর্নীতি এমনভাবে একটি পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় যেখান থেকে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ স্বতস্ফুর্তভাবে প্রতিরোধে এগিয়ে আসে। পুর্ব বাংলার জনগণের প্রতি প্রদর্শিত অসংযম আচরণ,অবহেলা ও বৈশম্যকে সামনে রেখে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির প্রচেষ্টায় ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। পরবর্তীকালে স্বৈরাচারি মুসলিম লীগকে রাজনৈতিক জবাব দিতে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোস্তাক আহমেদ প্রভৃতি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আওয়ামী মুসলিম লীগ হতে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ গঠন করেন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দেলন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন ও পুর্ব-পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্টের অভূতপুর্ব সাফল্যে মওলানা ভাসানীর অবদান অপরিসীম।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৫৪ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন এবং আজীবন এই সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থেকে ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বনে যান। ১৯৬৩ সালে আওয়ামী লীগের সামগ্রিক দায়িত্ব শেখ মুজিবের ওপর অর্পিত হলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের উদ্বিগ্নতা ব্যাপকতর বৃদ্ধি পায়। আইয়ুব খান ক্ষমতার সাংগঠনিক রূপ দিতে মৌলিক গনতন্ত্র ভিত্তিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ইতোমধ্যে পূর্ব-বাংলার ছাত্র সমাজ “ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করে তারা স্বৈরতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে বিরোধী দলের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। এই অবস্থার পটভূমিকায় সংগঠিত হলো সম্মিলিত বিরোধী বা কপ। কপ থেকে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী করা হলো আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে। শেখ মুজিব অনুরোধ জানালেন বয়োবৃদ্ধ নেতা মওলানা ভাসানীকে এই আন্দোলনে অবদান রাখতে। এতে মওলানা ভাসানী অগ্রনী ভুমিকা পালন করেন।
১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে মওলানা আব্দুল হামিদ খানের ভূমিকা ছিল অত্যান্ত সুস্পষ্ট। তিনি ১৯৭১ মালের ৯ মার্চ তারিখে পল্টন ময়দানে জনগণকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। অস্থায়ী মুজিব নগর সরকারের ৯ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদের তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর অতি বৃদ্ধ বয়সেও মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বিভিন্ন দাবি আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার জন্য ১৯৭৬ সালের ১৭ মে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিল পরিচালিত হয়।
শিক্ষা বিস্তারে তিনি টাংগাইলের মহিপুরে হক্কুল এবাদ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। টাংগাইলের মওলানা মোহাম্দ আলী কলেজ এবং সন্তোষে বেসরকারি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। টাংগাইলের সন্তোষ ইলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট