এবাদত আলী
বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পক্ষে, পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং প্রতিবাদি কণ্ঠ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঘনিষ্ট সহকর্মী এম মনসুর আলী ছিলেন পাবনার কৃতি সন্তান।
বৃহত্তর পাবনা জেলার কাজিপুর থানায় তাঁর পৈত্রিক নিবাস। তবে বলতে গেলে তিনি সারাটি জীবনই কাটিয়েছেন পাবনায়। তাই পাবনার মাটি ও মানুষের সাথে ছিলো তার নাড়ির যোগসুত্র। পাবনা বাসির নিকট তিনি ক্যাপ্টেন সাহেব, মনসুর চাচা কিংবা মনসুর ভাই হিসেবেই ছিলেন সমধিক পরিচিত। প্রথম জীবনে তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে এম এ এবং সেই সাথে এল এল বি পাশ করে পাবনা জজকোর্টে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। তৎকালিন ন্যাশনাল হোমগার্ডে তাকে অনারারি ক্যাপ্টেন উপাধি দেয়া হয়। এজন্য শিক্ষিত শ্রেণি ও সমাজের উঁচু স্তরের সকলেই তাকে ক্যাপ্টেন সাহেব বলে সম্বোধন করতেন। ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারি থেকে শুরু করে সমাজের সাধারণ মানুষের নিকট তিনি ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। পাবনা জজকোর্টে তিনি নামেমাত্র ওকালতি করতেন বটে তবে গরিব ও অসহায় মানুষের বন্ধু হিসেবে মামলা-মোকদ্দমার কাজ সমাধা করতে গিয়ে তিনি আর্থিক দিক থেকে বেশি একটা সফলকাম হতে পারতেননা। তাই অতি সল্প মুল্যের ভাড়া বাসায় তিনি স্ত্রী পুত্র পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন।
ওকালতি পেশার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তার ভুমিকা ছিলো অসাধারণ। সংগ্রামি চেতনা, মেধা ও সাধারণ মানুষের প্রতি তার প্রগাঢ় ভালোবাসার কারণে রাজনৈতিক পরিমন্ডলে তিনি অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে বিশেষ পরিচিতি লাভে সক্ষম হন। তৎকালিন সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের একজন বলিষ্ঠ নেতা হিসেবে চারদিকে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অতি বিশ্বস্থ ও ঘনিষ্টজন হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভে সক্ষম হন বলে সমগ্র উত্তরাঞ্চল তথা দেশ ব্যাপি তার পদচারণা শুরু হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির যেমন দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো ঠিক তেমনি এম মনসুর আলীর প্রতিও তারা ছিলো খুবই নাখোশ। ফলে জেলখানা ছিলো তার দিত্বীয় আবাসস্থল। কারণে অকারণে যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কারাভোগ করতে হতো ঠিক তেমনি সামান্য ছুতা নাতা দিয়ে এম মনসুর আলীকে প্রায়ই কয়েদখানায় বন্দি করে রাখা হতো। সংগ্রামি চেতনায় দীপ্যমান এই সুপুরুষটি কখনো তাতে দমে যেতেননা। বরং বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা আন্দোলনের তিনি ছিলেন পুরধা সৈনিক। শত নির্যাতন ও জেল-জুলুম উপেক্ষা করে তিনি সকল সময়েই বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। ‘৬৯ এর গণ আন্দোলন ও একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনে তার ভুমিকা ছিলো গৌরবোজ্জল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হায়েনার দল যখন অতর্কিতে নিরীহ বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু করে তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে তিনি আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে প্রতিবেশি বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং ভারত সরকারের সহায়তায় বিপ্লবী মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্্িরল মুজিবনগরে যে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয় এম মনসুর আলী ছিলেন উক্ত মন্ত্রী পরিষদের অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রী। বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার (ভবেরপাড়া) আম্র কাননে ১৭ এপ্রিল‘১৯৭১, মন্ত্রী পরিষদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অন্যান্য সদস্যের সাথে এম মনসুর আলীও মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে তিনি কলকাতার ২২২ সি – লোয়ার সার্কুলার রোডে অবস্থিত অর্থ – বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অস্থায়ী কার্যালয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। প্রবাসি সরকার পরিচালনায় অর্থের যোগান ছিলো এক দুঃসাধ্য কাজ। যা তিনি সুষ্ঠুভাবে সমাধান করে মহান মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসার পর স্বাধীন বাংলাদেশের যে স্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে এম মনসুর আলীকে তাতে যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। নিরলস পরিশ্রম, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ গঠনের ক্ষেত্রে দৃঢ় আত্মপ্রতয় ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য তাকে জাতীয় রাজনীতির শীর্ষে তুলে আনে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অতি বিশ্বস্থ ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মি এই নেতাকে যোগাযোগ মন্ত্রীর পদ হতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় মন্ত্রী। শুধু তাই নয়, এম মনসুর আলী বঙ্গবন্ধু সরকারের শেষ প্রধানমন্ত্রীর আসন লাভের গৌরব অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্ট বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মম নিষ্ঠুর ও কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করার পর পরই জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে ঢাকায় জেলখানায় বন্দি করা হয়।
১৫ আগষ্টের হত্যাকান্ডের মত ‘৭৫ এর ৩ নভেম্বর ঘাতকের দল জেলখানায় বন্দি দশা অবস্থায় এই জাতীয় চার নেতার উপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয় তাদের বুক। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমেদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামানের সাথে এম মনসুর আলীও। শহীদদের খাতায় রক্তের আখরে লিপিব্ধ হয় তাদের নাম।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।