মাজহার মান্নান ,কবি ও কলামিস্ট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও দার্শনিক ডক্টর গোবিন্দ চন্দ্র দেব একটি সমন্বয়বাদী দর্শন প্রবর্তন করেছিলেন। ভাববাদী আর বস্তুবাদীদের লড়াইকে কিছুটা প্রশমিত করতে চেয়েছিলেন এই দর্শন প্রবর্তন করে। সেটা এমন এক দর্শন যেটা সব কিছুর সমন্বয় করতে পারে। কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক কিঞ্চিৎ রসিকতা করে দেবের সমন্বয়বাদী দর্শনকে আলু দর্শন হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। কারণ আলু সব তরকারির সাথে মিশতে পারে। দারুন সমন্বয়কারী এক সুলভ সবজি আলু। কিন্তু সেই সুলভ শব্দটি ঠিক বৈপরীত্য লাভ করেছে। দুর্লভ সবজিতে পরিনত হতে চলেছে আলু। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন খুব আলু ভর্তা খেতাম। কেননা এটা ছিল খুব সস্তা। ২ টাকা কেজি আলু খেয়েছি। সময় অবশ্যই গড়িয়েছে তবে ৭০ টাকা হওয়ার মত সময় গড়ায়নি। আজ আলুকে রসিকতা দর্শনের পর্যায়ে না ফেলে পূর্ণ বাস্তববাদী দর্শনের মর্যাদা দেয়া উচিত। স্যালুট আলু দর্শন তোমাকে। শুধু আলু দর্শন চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই না। এর সাথে পিঁয়াজ দর্শনকেও নিতে হবে কারণ সেটার দামও লাগামহীন। কিছুদিন আগেও স্লোগান ছিল আলু খান, ভাতের উপর চাপ কমান। এই স্লোগান এখন শুধু কাগজেই শোভা পাবে। হাজার পদের খাবারে আলু ও পিঁয়াজ দুটি সবজি ব্যবহৃত হয়। আর এদুটির দাম এখন লাগামহীন। বানিজ্য মন্ত্রালয় আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্ত এত দেরি কেন? আর সিন্ডিকেটদের কেন সরকার খুঁজে পায় না? আমরাতো কারসাজিকারীদের শাস্তি পেতে দেখি না। তবে কি এভাবেই চলবে? উন্নয়ন বলতে কি শুধু ব্রিজ আর রাস্তা নির্মানকে বুঝায়। ঘরে বাজার না থাকলে পাকা সড়কে হাওয়া খেলে কি পেট ভরবে? বাজার নিয়ন্ত্রনে রাখা সরকারের একটি বড় সক্ষমতা। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত কিভাবে বাজার নিয়ন্ত্রন করছে? আমাদের দুর্বলতা কোথায়? দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বলতে গেলে চরমে। এই অবস্থায় দাম।কমার কোন আশা করাই বোকামি।
করোনা মহামারিতে কতটুকু ক্ষতি হয়েছে তা পরিমাপ করা অসম্ভব। তবে এতটুকু নিশ্চিত করে বলা যায় যে বাংলাদেশে বহু মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে, বহু মানুষ কর্ম হারিয়েছে। করোনা মহামারিতে বাংলাদেশের বহু মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে। অনেক মানুষ তাদের ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে দরিদ্র হয়ে গেছে। সাধারন মানুষের ক্রয় সক্ষমতা কমেছে। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে নিত্য পন্যের উর্ধ্বগতি পরিস্থিতি আরো নাজুক করে তুলেছে। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষ খুব চাপের মধ্যে আছে। ব্রাক ইনষ্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ( বি আই জি ডি) এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের ( পি পি আর সি) যৌথ জরিপে বলা হয়েছে দেশে করোনাকালে নতুন দরিদ্র ৩ কোটি ২৪ লাখ।
যারা সীমিত আয়ের মানুষ তাদের অবস্থা যে কতটা শোচনীয় তা বিভিন্ন জরিপ থেকেই বুঝা যায়। পরিবারের সকল খরচ মিটানো এবং বাড়ি ভাড়ার চাপতো আছেই। বছর ঘুরলেই বাড়িওয়ালারা ভাড়া বৃদ্ধির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। একদিকে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি আর অন্যদিকে বাড়তি করের বোঝা সাধারণ জনগণকে মহা মুশকিলে ফেলেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস মধ্যবিত্তদের। সবকিছু মিলিয়ে ধনী আর দরিদ্রের ব্যবধান আরো প্রকট হচ্ছে। আয়ের তুলোনায় ব্যয় বাড়ছে তীব্র গতিতে। নিম্নবিত্তরা সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় কিছু সুবিধা পেলেও বাড়তি ব্যয়ের চাপে পিষ্ট মধ্যবিত্তরা। এর ফলে কমছে জীবনযাত্রার মান। অনেকে সঞ্চয় ভেঙ্গে কোনমতে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পণ্যের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটার প্রতিফলন ঘটেনি। দেশে বেকার সমস্যা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তেমন কোন গতি দেখা যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রয় ক্ষমতা কমছে। কিন্তু পণ্য মূল্য ও সেবার দাম বেড়েছে। বিভিন্ন খন্ডিত জরিপ থেকে জানা যায় গত ১ বছরে মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় প্রায় ১২ শতাংশ বেড়েছে আর আয় বেড়েছে ৫ শতাংশ। প্রতি বছর বাজেটের পর নিত্য পণ্যের দাম এমনিতেই বেড়ে যায়। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ছে। কিন্তু প্রকৃত মজুরি কতটা বাড়ছে সেটাই বড় প্রশ্ন। জিডিপি এবং প্রবৃদ্ধি দুটোই বাড়ছে কিন্তু এর সুফল সবার মাঝে সমহারে পৌঁছাচ্ছে না। এর ফলে দারিদ্র বিমোচন, মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া এবং টেকসই উন্নয়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সকল স্তরে ঋণের চাপ বাড়ছে। বহু মানুষ ধারদেনায় জর্জরিত হয়ে একটি অস্বস্তিকর জীবন কাটাচ্ছে। কভিড মহামারি শুরুর পর থেকে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি শুরু হয়েছে এবং সেই বৃদ্ধি এখনো অব্যাহত আছে। করোনার সময় প্রায় ৫০ শতাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৭৫ শতাংশ শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। ফলে বেকার এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে। শহর অঞ্চলের মানুষেরা নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ পেলেও তৃণমূল অঞ্চলের জনগণ তা পায় না। অথচ বিদ্যুতের দাম গ্রাম ও শহর অঞ্চলের কোন ফারাক নেই।। আমদানি নির্ভরতা কমাতে পারলে নিত্যপণ্য সহ সবকিছু নিয়ন্ত্রনে রাখা সহজ হয়। বাজার পরিস্থিতি অনেটাই নিয়ন্ত্রন হয়ে পড়ছে। বাজার অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও নৈরাজ্যে বাজার অব্যবস্থাপনা আরো প্রকট হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রন হওয়ার পিছনে ভোক্তাদের দায়কেও একেবারে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ভোক্তাদের সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে এবং কোন পণ্যের দাম বাড়লে ভোক্তারা সেটা আরো বেশি ক্রয়ের জন্য হুড়মূড় খেয়ে পড়ে। ফলে বাজার আরো অস্থির হয়ে উঠে। আমাদের দেশের বাজার অনেকটা গুজব দ্বারা প্রভাবিত হয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে গুজব ছড়িয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে থাকে। সাধারণ ভোক্তারা গুজবে কান দিয়ে ভুল করে থাকে। যাহোক এপ্রিল মাস থেকে শুরু হচ্ছে পবিত্র রোজা। আর রমজান মাস এলেই দেশের বাজার চিত্র কেমন হয় সেটা খুব সহজেই অনুমেয়। রমজানে হু হু করে বাড়ে নিত্যপণ্যর দাম।
প্রতিটি পণ্যের দাম এখন উর্ধ্বমূখী। মাছ, মাংস, ভোজ্য তেল, সবজি সহ সকল পন্যের দাম লাগামহীন। সাধারন মানুষ খাবে কি? কিভাবে পাবে তারা পুষ্টিগুণ। যারা সীমিত আয়ের মানুষ এবং সৎ পথে যারা রোজগার করেন তাদের কি অবস্থা? অবস্থা যাই হোক না কেন, তাদের কষ্টের কথা শোনার কেউ নেই। পন্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পন্যের দাম বাড়ানোর নোংরা খেলা আমরা বছরের পর বছর দেখে আসছি। পন্যের এত দাম, কিন্তু যে কৃষকরা এত কষ্ট করে সেটা উৎপাদন করলো তারা সেটার নায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত। একদল ফরিয়া অসাধু ব্যবসায়ী পুরো সিস্টেমটাকে জিম্মি করে রাখে। নানা প্রকার খোঁড়া কারণের জিকির তুলে তারা পন্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। বাজার নজরদারিতে কিছুটা তৎপরতা দেখা গেলেও সেটাকে পর্যাপ্ত বলা যায় না। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য টিসিবি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু টিসিবির সেবার আওতায় সবাইকে তো আনা সম্ভব হয়নি। কিছু মানুষ আছে যারা না পারে হাত পাততে, না পারে সংসার চালাতে। এরকম মানুষের সংখ্যা কম নয়। বাজারের বাস্তব চিত্র দেখে মনে হয় না যে পন্যের কোন সংকট আছে। প্রচুর সরবরাহ অথচ দাম বেশি। Laws of Supply Demand নীতিটি কঠোরভাবে কার্যকর করা গেলে কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়া যেতো। আমাদের দেশে পন্যের দাম ব্যাসায়ীদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। ভোক্তা অধিকার যেন উপেক্ষিত। পন্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখতে সরকার আমদানী শুল্ক হ্রাস করলেও তা খুব একটা কাজে আসে না। পন্যের দাম উঠা নামার সাথে অনেকগুলি বিষয় জড়িত আছে। আন্তর্জাতিক বাজার, জ্বালানী খরচ, দুর্যোগ, পরিবহন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, প্রক্রিয়াজাতকরন সুবিধা, বাজারজাতকরন ও গুদামজাতকরন। এসব গুলি বিষয় স্বাভাবিক থাকলে পন্যের দাম বাড়ার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। তবে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, দূর্নীতি, ঘুষ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের অবস্থানগত দুর্বলতা, ক্রেতাদের সচেতনতার অভাব, দুর্বল নজরদারি, কালোবাজারি, কালো টাকার প্রভাব, অতিরিক্ত মুনাফার লোভ পন্যের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
পন্যের মূল্য তালিকা প্রতিটি হাট বাজারে টাঙিয়ে দিয়ে সেটা নজরদারি করতে হবে। দ্রুত সেবা নিশ্চিত করতে হবে। কোন ব্যবসায়ী বা ফরিয়া পন্যের দাম বেশি রাখলে তাকে যেন দ্রুত আইনের আওয়ায় আনা যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পন্য কেনার পরিধি আরও বাড়াতে হবে। এখনই লাগাম টেনে না ধরলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। বাড়তি জনসংখ্যার ফলে চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু উৎপাদন ঘাটতির কারণে যোগান অপ্রতুল হয়ে পড়ছে। প্রতিনিয়ত কমছে কৃষি জমির পরিমান। ফলে উৎপাদন ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। কৃষি পন্যের নায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষির প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে। আর এর ফলে যোগানের উপর চাপ তৈরি হচ্ছে। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি পৃথক কমিশন গঠন করা যায় কিনা সে ভেবে দেখার সুযোগ এসেছে। সব কিছুকে আসলে আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রনে আনা কঠিন, বিশেষ করে বাজার ব্যবস্থাপনার মত একটি জটিল বিষয়। তাই ক্রেতা সচেতনতা অতি জরুরী। মাঠ পর্যায়ে নজরদারির ঘাটতির কারণে বাজার বেসামাল হয়ে পড়ে। তাই কঠোর নজরদারি বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। অন্তত সবজি হিসাবে আলুর দামটি নিয়ন্ত্রনে রাখা উচিত। কবির ভাষায় বলতে হয়—
'' গরীবের আলু ভর্তা
করিবে কি রক্ষা কর্তা?''