// এবাদত আলী
চান্দ্র বর্ষ গণনাায়-সফর মাস হিজরী সনের দ্বিতীয় মাস। অতি প্রাচীন কালে আরব ভূ-ভাগে প্রচলিত বর্ষের প্রথম মাসকে বলা হতো সফর আউয়াল, দ্বিতীয় মাসকে বলা হতো সফরে সানি। এ ছাড়া সফর,আউয়াল, রজব, জিলক্বদ ও জিলহজ্ব এই চারটি মাস অতি পবিত্র হিসাবে গন্য হওয়ায় এই মাস গুলোকে একত্রে বলা হতো মুহাররম।
কালক্রমে সফর আউয়ালই কেবল মুহাররম নামে এবং সফরসানি শুধু সফর মাস নামে পরিচিত হয়। ইসলামের ইতিহাস পর্যলোচনা করলে এই সফর মাসে বিভিন্ন ঘটনার অবতারনার কথা জানা যায়। তন্মধ্যে অতি মর্মন্তদ ঘটনা হলো নজফে ইসলামী মিশনের সকল সাহাবীর শাহাদত বরন। চতুর্থ হিজরী সনের সফর মাসে নজদের কিলাব গোত্রের প্রধান আবু বারা আমের বিন মালিক মদীনা মনোওয়ারায় মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে দুটি উট ও দুটি ঢাল হাদিয়া স্বরুপ দেয়। মহানবী (সা.) তা গ্রহণ না করে বলেন, কোন মুশরিকের হাদিয়া গ্রহণ করা নিষিদ্ধ; সেই সাথে তাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হবার জন্য বলেন।
তখন সে বলে , দেখুন আপনার দীন ভালো তবে আপনি যদি কিছু লোক নজদে পাঠাতেন তা হলে তারা গিয়ে নজদের লোকদের আপনার দীনের দাওয়াত পৌঁছাতো ফলে আমরা এক সঙ্গে অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতাম। নবী করিম (সা.) বল্লেন দেখ, নজদের লোকদের মতিগতি দেখে আমি শংকিত। তখন আবু বারা নবী করিম (সা.) কে নিশ্চয়তা দিয়ে বলে যে, আপনার প্রেরিত লোকদের কোন অমর্যাদা হবেনা।
প্রিয় নবী (সা.) আবু বারার কথায় আশ্বস্ত হয়ে হযরত মনযর বিন আমর (রা.) এর নেতৃত্বে ৭০ জন সাহাবীকে নজদে প্রেরণ করেন। প্রিয় নবী (সা.) আবু বারার ভাতিজার নিকট পত্র ও দিয়ে দিলেন। ইসলাম প্রচারের এই কাফেলাটি নজদে উপস্থিত হয়ে বিরমাউনা বা মাউনার কুপ নামক একটি কুপের পাশে ছাউনী ফেলেন।
হযরত আনাস (রা.) এর মামা হযরত হারাম বিন মালহান (রা.) প্রিয় নবী (সা.)এর পত্র খানা নিয়ে প্রাপক আমর বিন তোফায়েলের নিকট পৌঁছানোর জন্য তার বাসস্থানে উপস্থিত হলেন। আমর বিন তোফায়েল নবী করিম(সা.) এর পত্রখানর প্রতি কোনরূপ সন্মান প্রদর্শন করলোনা। বরং পত্রবাহক হযরত হারাম বিন মালহানকে কতল করার জন্য জনৈক কাফের কে হুকুম দিলো। সাথে সাথে সেই নিষ্ঠুর কাফের হারাম বিন মালহান (রা.) এর বুকে বর্শা ছুড়ে মারলো। হযরত হারাম বিন মালহান (রা.) নিজের রক্ত দু হাতে পেতে গ্রহণ করে বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবার । কসম কাবার প্রভুর, আমার জীবন স্বার্থক।
এ কথা বলেই তিনি শাহাদত বরন করলেন। এর পর নরাধম আমর বিন তোফায়েল বীর মাউনায় উপস্থিত হয়ে ছাউনীতে অবস্থানরত সকল সাহাবী কে নির্মম ও নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে। যা নজদে আমন্ত্রণকারি আবু বারা আমের বিন মালিকের অজানা থেকে যায়। এই ঘটনা শ্রবণ করে হযরত মহানবী (সা.) গভীর ভাবে শোকাভিভুত হন। তিনি একাধারে ৩০ দিন শহীদ দের জন্য দোয়া করেন। হত্যাকান্ডের নায়ক আমর বিন তোফায়েল এই ঘটনার কিছু দিন পর প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরন করে।
এই সফর মাসে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর খাদ্যে বিষ প্রয়োগ। একবার খায়বারের ইহুদী নেতা সালাম বিন মাসকামের স্ত্রী জয়নব প্রিয় নবী (সা.) কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে খাদ্যের সাথে বিষ মিশিয়ে তা পরিবেশন করে। উক্ত খাদ্য খেয়ে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত বসর ইবনে বারা (রা.) শাহাদতের সৌভাগ্য লাভ করেন। পক্ষান্তরে হযরত মোহাম্মদ (সা.) সেই খাবার গ্রহণ করেও আল্লাহর অশেষ কৃপায় তা হজম করেন।
উক্ত ঘটনার প্রায় চার বছর পর প্রিয় নবী হযরতহ মোহাম্মদ (সা.) এই সফর মাসের শেষ সপ্তাহে ভীষন অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। মাথার যন্ত্রনা এবং জ্বরের তাপমাত্রা তীব্রতর হয়ে ওঠে। এই সংবাদ পেয়ে সাহাবীগণ দারুন চিন্তিত হলেন। মদিনা বাসীর মনেও কালো বিষাদের ছায়া নেমে আসে।
কয়েক দিন পর সফর মাসের শেষ বুধবার প্রিয় নবী (সা.) কিছুটা সুস্থ্যতা বোধ করলেন। মাথার যন্ত্রনা দুরীভূত হয় এবং শরীরের তাপ মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তাঁর নির্দেশে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) তাঁকে গোসল করালেন। অতঃপর তিনি তৃপ্তির সাথে খাদ্য গ্রহণ করলেন। তিনি তাঁর নাতী হযরত ইমাম হাসান(রা.) ও হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) কে বুকের কাছে তুলে নিয়ে আদর করলেন। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর এই সুস্থ্যতার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সাথে সাথে সারা মদীনায় যেন আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। লোকজন দলে দলে এসে মসজিদে নববীতে ভিড় জমাতে শুরু করলেন। সাহাবাগণ আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জানানোর উদ্দেশ্যে নফল নামাজ আদায় করলেন।
মহানবী (সা.) এর রোগ মুক্তির কারণে আনন্দের শোকরানা স্বরূপ হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) পাঁচ হাজার দিরহাম, হযরত ওমর (রা.) সাত হাজার দিরহাম, হযরত ওসমান (রা.) দশহাজার দিরহাম, হযরত আলী (রা.) তিনহাজার দিরহাম এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ এক শ উট আল্লাহর রাস্তা দান করলেন।
প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.)এর হুজরা হতে মসজিদে নববীতে এসে নামাজে ইমামতি করেন, এবং নামাজ শেষে মিম্বরে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করেন।
নবী করিম (সা.) এর রোগ মুক্তি লাভ হয় হিজরী ১১ সালের সফর মাসের শেষ বুধবার। ফারসীতে বলা হয় আখেরী চাহার শোম্বা। এই আখেরী চাহার শোম্বা ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। মুসলিমগণ সেই সময় থেকেই এই আখেরী চাহার শোম্বা দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে আসছেন। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও লেখক
তারিখ: ১২/০৯/২০২৩