// এবাদত আলী
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের শেষ প্রান্তে এসে মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর উত্তর বঙ্গের উল্লেখযোগ্য স্থাপনা বগুড়া শহর তিন দিক থেকে অবরোধ করে ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বিশাল বহর পিছু হটে তাদের হেডকোয়ার্টার ঢাকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানোর জন্য শেরপুর ও উল্লাপাড়া হয়ে শাহজাদপুরের অদুরে বাঘাবাড়ি ফেরিঘাটে এসে ফেরিতে যুদ্ধ সরঞ্জামসহ নিজেরা পারাপারের জন্য জমায়েত হতে থাকে।
এুক্তি ও মিত্র বাহিনীর হাতে নামস্তানাবুদ হয়ে শোচনীয় পরাজয়েরভয়ে ভীত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অসহায়ত্বের সে এক অভুতপুর্ব নগ্ন দৃশ্য। যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। শত শত মিলিটারি কনভয় বাঘাবাড়ি ফেরিঘাট পার হবার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক হাজার মুক্তিফৌজ তিন দিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলেছে।
বাঘাবাড়ি ঘাটে ফেরি তখন মাত্র একটি। তাও আবার আকারে ছোট। এদিকে ফেরির একমাত্র চালক গোলাম মোস্তফা মুক্তিবাহিনীর ভয়ে ফেরি ফেলে আগেই পালিয়ে গেছে। পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে তাই শত শত যানবাহন ও যুদ্ধের রসদপত্র পারাপার খুবই কষ্টসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের অধিনায়ক নির্ভিক মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ মির্জা ততক্ষণে ওয়ারলেসের মাধ্যমে বিমান বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। তার পক্ষ থেকে আমাদের ওয়ারলেস অপারেটর রফিকের মাধ্যমে বিমান হামলার একটি ম্যাসেজ পেলাম। আমাদের তখন দৃঢ় প্রত্যয় কোন অবস্থাতেই বিনা চ্যালেঞ্জে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাঘাবাড়ি ফেরিঘাট পার হতে দেওয়া হবেনা।
অতি সল্প সময়ের মধ্যেই সকল যোগাযোগ সম্পন্ন হলো। বাঘাবাড়ি ঘাটের দক্ষিনে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার “ ফুল ” এর নেতৃত্বে মুক্তি ফৌজের একটি শক্তিশালী বহর ওঁৎ পেতে রইলো। তাদের প্রতিরোধের মুখে পাাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শত চেষ্টা করেও ফেরিঘাট পার হতে পারলোনা। দারুন অসহায় ও উৎকন্ঠার মধ্যে নিরূপায় হয়ে তরা সারা রাত বাঘাবাড়ি ফেরিঘাটে কাটিয়ে দেয়। পরদিন ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের সকাল ৯ টা। শীতের সকালের মিষ্টিমাখা রোদ সবেমাত্র কুয়াশা ভেদ করে আমাদের গায়ে এসে লাগছে। শহজাদপুর মসজিদ ঘাট থেকে ছয়আনিপাড়াহয়ে শশ্নান ঘাট পর্যন্ত এবং পশ্চিমে পোতাজিয়া ও রাউতারা বরাবর শাকপালা ও নুকালী গ্রামে হাজারো মুক্তিফৌজ তাদের হাতের অস্ত্র তাক করে ধরে আছে। গোটা রাত ধরে বাংকার খনন করে দস্তুরমত রণাঙ্গনের ছকে প্রস্তুতি নিয়ে আছে।্ সকলের চোখে মুখে দৃঢ় আত্মপ্রতয়ের ছাপ। শত্রু হননের সে এক দূর্বার আকর্ষণ।
ঠিক এমনি সময় দু খানা বোমারু বিমান উঁচু দিয়ে উড়ে গেল। গতকালই কথা হয়েছিল বিমান হামলার। কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার কারণে তা হয়নি। ওয়ারলেস অপারেটর রফিক সে কথা রাতের বেলা জানিয়েছিল যে, সকালে বিমান হামলা হবে। দেখতে দেখতে আবারো বিমান দুটো চক্কর দিয়ে পূর্ব দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাঘাবাড়ি ঘাটের সেনা ছাউনি হতে ভারি মেশিনগানের গুলি ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে গেল। অমনি গর্জে উঠলো মুক্তিবাহিনীর হাতের অস্ত্র। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তখন দিশেহারা হয়ে এলোপাথাড়িভাবে গুলি ছুুঁড়ছে। আকাশে আবারো বিমান দেখা গেল তবে এবার একটি। দেখতে দেখতে বিমানটি ফেরিঘাটের অস্থায়ী সেনা ছাউনির উপর এবং ফেরির উপর পর পর দুটো বোমা ফেলে দ্রুত আকাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। বিকট শব্দে বোমা দুটি ফাটলো। ধুঁয়ার কুন্ডুিল আর আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ পর্যন্ত ধেয়ে উঠলো। ফেরিতে আগুন ধরেছে। পুড়ছে। ঘাটে গোলা বারুদ বহনকারি সারিবদ্ধ ট্রাক ও কনভয়ে আগুন ধরে গিয়ে প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হতে লাগলো।
চারদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল। হাজার হাজার নারী- পুরুষ শিশু- কিশোর বাড়ির বাইরে মাঠে নেমে পড়লো। লোকে লোকারণ্য। সকলের কন্ঠেই ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে ‘জয় বাংলা- জয় বাংলা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তখন বাংকরে আত্মগোপন করেছে। আত্মরক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। বোমার আঘাতে কারও কারও শরীর পুড়ে ঝলসে গেছে। আমরা সন্তর্পণে সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদারদের মরণছোবল আমাদেরকে এগুতে দিলোনা। তারা মরিয়া হয়ে বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ করতে লাগলো। তারা আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য বাঘাবাড়ি ঘাট সংলগ্ন নুকালি গ্রামে প্রবেশ করে কয়েকজন নীরিহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলো। এদিকে মুক্তিবাহিনী অতি সাহসের সাথে তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে লাগলো। অবশেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পুনরায় বাঘাবাড়ি ঘাটের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য হলো। এসময় তারা কি করবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিলনা। এদিন সন্ধার কিছু আগেই মুক্তিযোদ্ধা বাকি মির্জাসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে গোটা শাহজাদপুর বাজার এলাকা এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল মতিন মোহনের নেতৃত্বে মাদলা ও নুকালি গ্রাম মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে এলো। রাতের আাঁধারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপর একটি ফেরি জোগাড় করে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে যে যার মত পালিয়ে গেল। অবশ্য পালিয়ে যাবার সময় বেড়া, কাশিনাথপুর ও নগরবাড়ি ঘাটে শতাধিক সেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়।
পরদিন ষোলই ডিসেম্বর ভোর বেলা বাঘাবাড়ি ঘাটে গিয়ে দেখা গেল প্রায় ২৮ জন পাকিস্তানি সৈন্যের লাশ পড়ে আছে। তাদের অধিকাংশের শরীরই বিকৃত। তখনো গোলাবারুদ ও মাংস পোড়ার গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমরা বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিলাম শত্রুমুক্ত বাঘাবাড়ি ফেরিঘাটে। সেই সাথে গোটা শাহজাদপুর থানাতে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা পতপত করে উড়তে লাগলো। আমরা বিজয়ের মহা উল্লাসে মেতে উঠলাম। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী, সাংবাদিক ও কলাস্টি, তাং ০২/০৯/২০২৩