পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট——মর্মান্তিক ও শোকাবহ ঘটনাবলি -১২

/ – এবাদত আলী

(১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের সকালটা শুরু হয়েছিলো ‘রেডিও পাকিস্তানের’ এমন ঘোষণা শুনে। ‘‘আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ও তার সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশ বিডিআর ও রক্ষীবাহিনীর সিপাহী ভাইবোনেরা আপনারা সবাই সেনাবাহিনীর সাথে যোগদান ও সহযোগিতা করুন। যাহারা অসহযোগিতা করিবেন , দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের চরম দন্ড দেওয়া হইবে।’’)

এদিন ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট ভোরবেলা সু-পরিকল্পিতভাবে পৈশাচিক এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। দিনটি ছিলো শুক্রবার। সকাল সন্ধ্যা কারফিউ জারি করে রেডিওতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো যাতে কেউ পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত নিজ নিজ বাড়ি ঘর থেকে বের না হয়। তবে দুপুরের আগে সংবাদে জানানো হয় জনগণ যাতে জুম্মার নামাজ আদায় করতে পারে সেজন্য রাষ্ট্রপতি আজ দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে ২টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ফারুক হোসেন নামে রেডিও পাকিস্তানের একজন ঘোষক সেদিনের ঘোষণাগুলো সঞ্চালন করছিলেন। তিনি একটু পরপর ব্যুলেটিন পাঠ করে জানিয়ে যাচ্ছিলেন ‘ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। মাঝে জাতীয় সঙ্গীতের সুরে বাজিয়ে জানানো হয় এখন বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ। প্রেসিডেন্ট জাতিকে আস্সালামু আলাইকুম জানিয়ে বলেন, আজ ঐতিহাসিক প্রয়োজনে দেশ এবং দেশবাসির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা এবং দেশবাসির উপর নির্ভর করে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন।
ভোরবেলা এমন খবরে গোটা বঙালি জাতি হয়েছিলো স্তব্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারিরা স্বদম্ভে এমন আস্ফালন করায় গোটা দেশবাসি তখন স্তম্ভিত।
সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহনকারী মানুষটিকে সাড়ে তিনবছর আগে সিংহাসনে বসানো হলো ; অথচ তাঁর মৃত্যু সংবাদে করা গেলনা কোন প্রতিবাদ। অনুষ্ঠিত হলোনা কোন মিটিং মিছিল কিংবা শোকসভা। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থানকারি বাংলার নয়নমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এমন কি অপরাধ করেছিলেন যে, তাঁকে এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে অকাতরে জীবন দিয়ে মাশুল দিতে হলো?
নৃশংস হত্যাকান্ডের পর হত্যাকারিদের কয়েকজন এবং কিছু সৈন্য বাড়িটির সামনে ও ভিতরে অবস্থান করে। আদেশ প্রাপ্ত হয়ে প্রথমে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করেন লে:কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি। সে সময় তিনি ঢাকা স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন।
তাঁর লেখা ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান এবং না বলা কিছু কথা ’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ তিনি সেখানে দেখতে পান বাড়ির মুল দরজায় মেজর পাশা এবং মেজর বজলুল হুদা দাঁড়িয়ে ছিলো। হুদা প্রথমেই তাকে নিয়ে গেল নিচ তলার রিসিপশন রুমে। সেখানে শেখ কামালের মৃতদেহ টেবিলের পাশে একগাদা রক্তের মাঝে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। একটি টেলিফোনের রিসিভার টেবিল থেকে ঝুলছিলো। হয়তো শেষ মুহর্তে কাউকে ফোন করতে চেয়েছিলেন শেখ কামাল। কামালের ভাঙা চশমা তার পাশে পড়েছিলো। টেবিলের পাশে আরেকটি মৃতদেহ। একজন পুলিশ অফিসার। প্রচুর রক্তক্ষরণেই দুজন মারা গেছেন।
এরপর আমরা দোতালায় উঠতে পা বাড়ালাম। সিঁড়ির মুখেই চমকে উঠলাম। দেখি সিঁড়িতে পড়ে আছেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর পরনে ছিলো সাদা পাঞ্জাবী এবং চেক লুঙ্গি। পাশে পড়ে আছে তার ভাঙা চশমা। তাঁর দেহ সিঁড়ির ওপরে এমনভাবে পড়েছিলো যেন, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেছেন। কারণ তার মুখে কোন রকমের আঘাতের চিহ্ন ছিলোনা। চেহারা ছিলো সম্পুর্ণ স্বাভাবিক। তাঁর বুকের অংশটুকু ছিলো ভীষনভাবে রক্তাক্ত। মনে হলো ব্রাস লেগেছে। তাঁর বাম হাতটা ছিলো বুকের উপর ভাঁজ করা, তবে তর্জনীর আঙ্গুলটা ছিঁড়ে গিয়ে চামড়ার টুকরার সাথে ঝুলে ছিলো। তাঁর দেহের অন্য কোন অঙ্গে তেমন কোন আঘাত দেখিনি।’’ সারা সিঁড়ি বেয়ে রক্তের বন্যা, লিখেছেন তিনি।
এরপর সিঁড়ির মুখেই ঘরটিতে বেগম মুজিবের দেহ দেউড়ির উপর উপুড় হয়ে পড়েছিলো। তার গলার হারটা ঢুকে ছিলো মুখের মধ্যে। তিনি লিখেছেন, মনে হলো স্বামীর উপর গুলির শব্দ শুনে তিনি ছুটে আসছিলেন। কিন্তু দরজার মুখেই গুলিবিদ্ধ হয়ে দেউড়িতে লুটিয়ে পড়েন। তার দেহ অর্ধেক বারান্দায় অর্ধেক ঘরের ভেতরে।
লে: কর্নেল লিখেছেন, তাকে পাশ কাটিয়ে আমি কামরার ভেতরে প্রবেশ করলাম। কামরার মেঝেতে এক সাগর রক্ত থপথপ করছিলো। আমার বুটের সোল প্রায় অর্ধেক ডুবে যাচ্ছিলো। বিধ্বস্ত পরিবেশ। রক্তাক্ত কামরার মধ্যে পড়ে আছে কয়েকটি লাশ। বাম পাশেরটি শেখ জামাল। তার দেহে ক্ষতবিক্ষত অবস্থা দেখে মনে হলো কামরার ভেতরে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। মিসেস রোজি জামাল সদ্য বিবাহিতা হাতে তাজা মেহেদীর রং। ব্রাশ অথবা গ্রেনেডের আঘাত সরাসরি তার মুখে লেগেছিলো।
পাশে মিসেস সুলতানা কামাল। প্রচুর রক্তক্ষরণে এখন তার চেহারা সম্পুর্ণ বিবর্ণ শুকনো। তারই কোল ঘেঁষে ছোট্ট রাসেলের মৃতদেহ। তার মাথার পিছন দিকে একেবারে থেঁতলে গিয়েছিলো। সবগুলো ঘর ছিলো খোলা। প্রতিটি ঘরেই দামী জিনিষপত্র। রাষ্ট্রপতির পরিবার। মাত্র কদিন আগেই ঐ বাড়িতে দু দুটি বিয়ে হয়ে গেছে। শেখ কামাল এবং শেখ জামালের। আনন্দ মুখর আনন্দ ভবনটি এখন নীরব নিথর।
নিচ তলার একটি বাথরুমে পড়েছিলো শেখ মুজিবের ভাই শেখ নাসেেেরর রক্তাপ্লুত মৃত দেহ। চেনাই যাচ্ছিলোনা। বাড়ির পিছনে আঙিনায় একটি লাল গাড়ির পেছনের ইটে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা ছিলো কর্নেল জামিলের প্রাণহীন দেহ।
১৫ আগস্ট দুপুর পেরিয়ে বিকেল। কিন্তু তখনো ক্ষমতার পালাবদলের হিসাব নিকাশ চলছে। কারো মাথা ব্যথা নেই ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির দিকে।।।। (চলবে)

(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
,তারিখ ১৮ /০৮/২০২৩