// এবাদত আলী
(১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। ভোর প্রায় ৫টা ৫০ মিনিট। দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই সিঁড়ির মুখে মেজর হুদাকে দেখে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে ওঠেন, ‘‘ তোরা কি চাস? তোরা কি আমাকে মারতে চাস?’’ মেজর হুদা বলে ‘আামি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’ বঙ্গবন্ধু বলেন ‘‘ তুই আমাকে মারতে চাস? কামাল কোথায়? তোরা কামালকে কি করেছিস? উত্তরে হুদা বলে ‘ স্যার কামাল তার জায়গায়ই আছে আর আপনি তুই তুই করে বলবেননা। আপনি বন্দি, চলুন।’ এবার গর্জে উঠলেন বঙ্গবন্ধু ‘‘ কি তোদের এত সাহস! পাকিস্তানি আর্মিরা আমকে মারতে পারেনি। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে কেই আমাকে মারতে পারেনা।’’ )
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা। লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। মহিতুলকে বলতে বলেন আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। মহিদুল ঘাতকদের বলেন, উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। আর তখনই বজলুল হুদার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝাঁজরা করে দেয় কামালের দেহ। প্রাণ হারান তিনি। একটা গুলি এসে লাগে মহিতুলের হাঁটুতে।
নিচ তলার বারান্দা তখন রক্তে ভাসছে। বন্ধ ঘরের ভেতরে টেেিফানে ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু। ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিনকে বলেন, ‘ জামিল তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকেরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। শফি উল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’ তৎকালিন সেনা প্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকে নিজেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তাকে বলেন,‘ শফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক বরেছে। কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও। ফোনের ওপাশ থেকে সফিউল্লাহ বলেন, আই এম ডুইং সামথিং, ক্যান ইউ গেট আউট?
টেলিফোন মারফত খবর পেয়ে কর্নেল জামিল তার ব্যক্তিগত লাল রঙের গাড়ি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসায় রওনা হন। সঙ্গে ছিলেন নিজের গাড়ি চালক আয়েন উদ্দিন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পৌঁছানো হলোনা কুার। পথেই সোবহান বাগ মসজিদের কাছ্ েতাকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকেরা। পালিয়ে বেঁচে যান আয়েন উদ্দিন।
তখন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে লম্বালম্বি লাইনে দাঁড়ানো মহিতুল, নুরুল ইসলাম,আব্দুল মতিন ও পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যসহ কয়েকজন। ঘাতকেরা একজন পুলিশ শাখার বিশেষ সদস্যকে গুলি করে। তারপর গুলি করতে করতে চলে যায় ওপরে। সেখানে শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেওয়া আব্দুলকে গুলি করে। হাতে ও পেটে গুলি বিদ্ধ আব্দুল সিঁড়ির পাশে হেলান দিয়ে বসে থাকেন।
ভোর তখন ৫টা ৫০ মিনিট। বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনিসহ বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, ও রোজি জামাল। বন্ধ ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ঘাতকেরা। ততক্ষণে গোলা গুলি থেমে গেছে। দরজা খুলে বারান্দায় আসতেই বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ফেলে ঘাতকেরা। নামিয়ে আনতে থাকে নিচে।
সিঁড়ির মুখে মেজর হুদাকে দেখে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে ওঠেন, ‘‘ তোরা কি চাস? তোরা কি আমাকে মারতে চাস?’’ মেজর হুদা বলে ‘আামি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’ বঙ্গবন্ধু বলেন ‘‘ তুই আমাকে মারতে চাস? কামাল কোথায়? তোরা কামালকে কি করেছিস? উত্তরে হুদা বলে ‘ স্যার কামাল তার জায়গায়ই আছে আর আপনি তুই তুই করে বলবেননা। আপনি বন্দি, চলুন।’ এবার গর্জে উঠলেন বঙ্গবন্ধু ‘‘ কি তোদের এত সাহস! পাকিস্তানি আর্মিরা আমকে মারতে পারেনি। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে কেউ আমাকে মারতে পারেনা।’’
সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়াতেই সিঁড়ির নিচে অবস্থান নেয় মেজর বজলুল হুদা ও মেজর নূর। নূর কিছু একটা বল্লে সরে দাঁড়ায় মহিউদ্দিন। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে হুদা ও নূরের হাতের স্টেনগান। ১৮ টি গুলি ঝাঁজরা করে দেয় বঙ্গবন্ধুর বুক ও পেট। বিশাল দেহী মানুষটি ওমনি পড়ে যান সিঁড়ির ওপর। বঙ্গবন্ধু তখন মৃত। তাঁর বুকের রক্তে ভেসে যায় সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে সেই রক্তের ¯্রােত।
কিছুক্ষণ পরই দোতালায় উঠে আসে মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলে উদ্দিন। সঙ্গে সৈন্যরা। গুলি আর ধাক্কায় এক সময় দরজা খুলে সামনে দাঁড়ান বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। সবাইকে নিচে আশার নির্দেশ দেয় ঘাতকেরা। নিচে নামতে থাকেন বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমা। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বেগম মুজিব। চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘‘আমি যাবোনা, আমাকে এখানেই মেরে ফেলো।’’
শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হয়। তার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বেগম মুজিবকে। তারপর সেই ঘরে আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলে উদ্দিন একে একে গুলি করে হত্যা করে বেগম মুজিবসহ শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজি জামালকে। বেগম মুজিবের নিথর দেহটি ঘরের দরজায় পড়ে থাকে। বাঁ দিকে পড়ে থাকে শেখ জামালের মৃতদেহ। রোজি জামালের মুখে গুলি লাগে। আর রক্তক্ষরণে বিবর্ণ হয়ে আসে সুলতানা কামালের মুখ।
নিচে দাঁড় করানো হলো শেখ নাসের, শেখ রাসেল আর রমাকে। শেখ নাসের ঘাতকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি তো রাজনীতি করিনা। কোন রকম ব্যবসা বাণিজ্য করে খাই। আমাকে কেন মারবে। অফিস সংলগ্ন বাথরুমে নিয়ে য্ওয়া হয় তাকে। গুলি করা হয় সেখানে। অসহায় নাসেরের গুলিবিদ্ধ দেহ গড়াতে থাকে মেঝতে। এসময় পানি পানি বলে গোঙাতে থাকেন তিনি। পানি নয় ঘাতকরা আরেকবার গুলি বর্ষণ করে তার উপরে।
রমাদের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলা ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলও । অসহায় শিশুটি প্রথমে রমাকে ও পরে মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলে,‘ ভাইয়া আমকে মারবেনাতো? কোন জবাব নেই রমার মুখে। মহিতুল বলেন , ‘ না ভাইয়া তোমাকে মারবেনা।’ একথা শুনে শিশুটি তার মায়ের কাছে যেতে চায়। দোতালায় নিয়েও যাওয়া হয় তাকে। কিন্তু মা নয় পাঠানো হয় মৃত্যুর কোলে। গুলি করে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শিশুটিকে। কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসে। থেতলে যায় মাথার পেছনের অংশ। নিথর রক্তমাখা এক রত্তি দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামালের পাশে।
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা ছিলেন না। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা স্বামীর সঙ্গে ছিলেন জার্মানিতে। তাঁদের সঙ্গ ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাও। তাই তারা প্রাণে বেঁচে যান।।। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
,তারিখ ১৭ /০৮/২০২৩