– এবাদত আলী
‘‘(সর্ব কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলার মাটিতে ফিরে আসার পর ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বিদেশী সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন‘‘ যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারেনা। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সেটাতো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না তা কেউ পারেনা। এটাঁই আমার বিশ্বাস। )’’
ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস: বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড বইয়ের লেখক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাঈদের মতে মাওলানা ভাসানী বহুদিন ধরে প্রগতিশীল রাজনীতির কথা বলে নির্যাতন ভোগ করেছেন তিনি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অতি উগ্র ডান ও বাম পন্থীদের হাতে এবং জাতীয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে ক্রীড়ানক হিসেবে কাজ করে গেলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বর্ণনাতীত ক্ষতিগ্রস্থ বিদ্ধস্ত দেশ পুর্নগঠনের কাজে যেখানে প্রয়োজন ছিলো সহায়তা সেখানে প্রকাশ্য জনসভায় তিনি হুংকার দিয়ে বলেন, ‘আমি এ দেশে প্রতি বিপ্লব ঘটাঁবো।’
স্ট্যানলি ওলপার্ট তার ‘‘ জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান’’ বইয়ে লিখেছেন, মার্ক্সবাদী-লেলিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির একাংশের নেতা আব্দুল হক ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী সম্বোধন করে অস্ত্র সহায়তা চেয়ে একটি চিঠি লেখেন। চিঠির ভাষা ছিলো নি¤œরূপ: আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, পুতুল মুজিব চক্র এখন জনগণ থেকে সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অস্ত্র, অর্থ ও ওয়ারলেস সরঞ্জাম প্রদানের আবেদন জানাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে স্পটতই বোঝা যায় যে, যেই দেশি এবং বিদেশি শক্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করে স্বাধীনতা বিেেরাধীদের সাহায্য সহযোগিতা করেছে তারা যৌথভাবে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ধ্বংস হয়ে যায়।
আরো উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম ছিলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিকসন, বিশেষ করে হেনরি কিসিঞ্জারের একটি বড় পরাজয়। তারা এ পরাজয়ের প্রতিশোধের অপেক্ষায় ছিলেন। তখন চলছিলো ¯œায়ুযুদ্ধ, বিশ্ব ছিলো দুই ভাগে বিভক্ত।একভাগে ছিলো আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদী ব্লক, আরেক ভাগে ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্লক। বাংলাদেশ ছিলো জোট রিনপেক্ষ গ্রুপে, তবে সোভিয়েত ঘেঁষা। এজন্য মার্কিন প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর উপর ছিলো দারুন ক্ষ্যাপা। বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করতে তাদের বিশেষ ভুমিকা অস্বীকার করবার উপায় নেই।
এসময় অধিকন্ত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগি সংগঠনগুলোর মধ্যে চরম অনৈক্য, কিছু নেতা কর্মির সমাজ বিরোধী কর্মকান্ড ও দুর্নীতিপরায়নতার কারণেও বঙ্গবন্ধু অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ঐসময় আক্ষেপ করে বলতেন ‘‘ সবাই দেশ স্বাধীন করে পায় সোনার খনি আমি পেয়েছি চোরের খনি।’’
স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা দেখা দিতে থাকে। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ক্রমবর্ধমান বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, খাদ্য সংকট সামাল দিতে ব্যর্থতার ফলে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা ২৭ হাজার থেকে ১৫ লাখ পর্যন্ত দাবি করা হয়। অনেক বিশ্লেষকের মতে এই দুর্ভিক্ষ মুজিব সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস করে এবং তার হত্যাকান্ডের পরিস্থিতি সৃষ্টিতে ভুমিকা রাখে। ১৯৭৪ সালের চরম দুর্ভিক্ষে দেশের সাধারণ মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। উত্তারঞ্চলের মঙ্গা কবলিত এলাকার মানুষ ভাতের অভাবে কচু-ঘেচু সিদ্ধ করে তার সঙ্গে জব ও গমের আটা গুলিয়ে খেত যার নাম দিয়েছিলো মুজিব ঘাঁটি।
এসময় কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় এক জেলে পরিবারের বাকপ্রতিবন্ধী মেয়ে বাসন্তীর জাল পরে লজ্জা নিবারনের ছবি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আর সেই বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত ছবির ফটোগ্রাফার ছিলেন ইত্তেফাকের নিজস্ব আলোকচিত্রি আফতাব আহমেদ। অনেকেই ছবিটির নাম দিয়েছিলো জাল বসনা-বাসন্তী। ছবিটিতে দেখানো হয় বাসন্তী ও দুর্গতি নামক দুই যুবতি মেয়েকে। অভাবের জন্য যারা সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারছিলোনা। ছবিতে বাসন্তীর পরনে ছিলো একটি মাছ ধরার জাল। এই ছবি তৎকালিন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সরকারকে রাজনৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছিলো। দেশের আনাচে-কানাচে দুর্ভিক্ষের বার্তা পৌঁছে দেয়। বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনকে তরান্বিত করতে এই ছবি গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখে। কিন্তু সেই ছবি প্রকাশিত হবার কিছুদিনের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যায় ছবিটি ছিলো সাজানো। কিন্তু তখন আর করবার কিছুই থাকেনা। পরবর্তীতে সেই প্রবীন সাংবাদিক আফতাব উদ্দিনকে খুন করে দুর্বৃত্তরা।
ষড়যন্ত্রকারিরা বাকশাল সম্পর্কেই বেশি বেশি অপপ্রচার চালায়। একই কথা বার বার শুনতে শুনতে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
নিন্দুকেরা বঙ্গবন্ধুর ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়েও জনমনে বিষবাষ্প ছড়াতে থাকে। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে ভাষণ দানকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘‘ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে, মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবেনা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে বাংলাদেশে ধর্মকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবেনা। যদি কেউ করে তাহলে বাংলার মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করবে এ আমি বিশ্বাস করি।’’ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ধর্ম নিরপেক্ষতার দৃষ্টিভঙ্গিকে ষড়যন্ত্রকারিরা ধর্মহীনতা বা নাস্তিকতা বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে। ফলে দেশের অধিকাংশ ধর্মভীরু মানুষ তাদের কথায় বিশ্বাস করে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের মনে ঘৃণা জন্মাতে থাকে।
সদ্য স্বাধীন দেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও বিভিন্ন অপপ্রচার চলে। দেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে আটক যেসকল ব্যাক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিলোনা বঙ্গবন্ধু তাদের ক্ষমা ঘোষণা করেন। ফলে জেল খানায় আটক ৩৭ হাজার ব্যাক্তির মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার ব্যক্তি মুক্তি লাভ করে।
বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন ঠিকই কিন্তু খুনি,ধর্ষক, লুট-তরাজ ও অগ্নি সংযোগকারি এবং যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা অথবা হুলিয়া ছিলো তারা সাধারণ ক্ষমার আওতায় পড়েনা বলে প্রেসনোটে তা উল্লেখ করা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে যারা সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পেয়েছিলো পরে তারাই এক জোট হয়ে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতের প্লাটফরমে একত্রিত হতে থাকে।।। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
তারিখ ১০ /০৮/২০২৩