পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট–মর্মান্তিক ও শোকাবহ ঘটনাবলি – ৪

// এবাদত আলী
‘‘(সর্ব কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলার মাটিতে ফিরে আসার পর ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বিদেশী সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন‘‘ যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারেনা। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সেটাতো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না তা কেউ পারেনা। এটাঁই আমার বিশ্বাস। )’’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার জন্য দেশি বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র হতে থাকে। শেখ মুজিব হত্যা হলেই পথ হারাবে বাংলাদেশ। আর এ কারণেই উচ্চ কন্ঠে মুজিবকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে মার্কিন- পাক গোয়েন্দারা। নীল নকশায় তারা তৈরি করেছিলো দুর্ভিক্ষসহ আরো কিছু সমস্য। স্বাধীনতার পর থেকেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ বিরোধি প্রচার প্রচারণা চালাতে থাকেন এবং বাংলাদেশের চরম ডান ও বাম পন্থিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। আমেরিকান গবেষক ও লেখক স্টেনলি ওলপার্টের মতে ভুট্টো দু বছর ধরে আব্দুল হকসহ অন্যান্য মুজিব বিরোধী দলকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য অব্যাহত রাখেন। দুই বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধচারণ করায় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে তাদের নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলার মাটিতে ফিরে এসে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশকে গড়ে তোলার জন্য প্রথম বিপ্লবের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিন বছর পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশকে আরো স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার মানসে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসুচির মধ্যে ছিলো সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন। সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার প্রবর্তন। দেশের সকল দল বিলুপÍ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব দল ও শ্রেণি পেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল) নামে একটি জাতীয় দল গঠন, কেবলমাত্র চারটি দৈনিক পত্রিকার অনুমতি, মহকুমা গুলোকে জেলায় উন্নীত করা, জেলা প্রশাসনের দায়িত্বে জনপ্রতিনিধি বা গভর্ণর নিয়োগ, সমবায় ভিত্তিক কৃষি উৎপাদন ও ভুমি ব্যবস্থাপনা, পল্লী অঞ্চলে হেলথ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা, প্রশাসন বিকেন্দ্রিকরণ, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার ইত্যাদি।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেওয়ার নেপথ্যে যা ছিলো তা হলো সদ্য স্বাধীন দেশে তিনি যখন দেশটিকে অগ্রগতির পথে ধাবিত করার জন্য প্রানান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তার সরকারকে এক চরম বৈরি অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। দেশের সর্বত্র সশস্ত্র ডাকাতি, লুট-তরাজ, খুন রাহাজানি, ঘুষ দুর্নীতি, কালোবাজারি, মজুদদারি, ‘৭৪ এর দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি থেকে উদ্ভুত পরিস্থিতি মুজিব সরকারের পক্ষে মোকাবেলা করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। তৎকালিন চরম বামপন্থী কিছু সংগঠন যেমন সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টি, আ স ম আব্দুর রবের জাসদসহ আরো কিছু চরমপন্থী দল থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, বাজার ও ব্যাংক লুট, পাটের গুদামে আগুন, রেল লাইনের স্লিপার উপড়ে ফেলা, শ্যেণিশত্রু খতমের নামে অবাধে মানুষ হত্যা, সংসদ সদস্যদেরকে হত্যা ইত্যাদির মাধ্যমে কার্যত সরকারের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং গোটা দেশে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে উদীয়মান বামপন্থী শক্তি মুজবি হত্যকান্ডের পরিস্থিতির জন্য বহুলাংশে দায়ি ছিলো বলে মনে করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং নব্য স্বাধীন দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়ে একটি মতাদর্শগত দ্বন্দের সুত্রপাত ঘটে। তৎকালিন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দগণতন্ত্রকে প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচনা করলেও আ স ম আব্দুর রব এবং শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তার বিরোধিতা করে। ছাত্র লীগের এই অংশটি মুলত সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম খানের অনুসারি ছিলো। তারা পরবর্তীতে ছাত্র লীঘ হতে বিভক্ত হয়ে জাতীয় সমাজ তান্ত্রিক দল –জাসদ নামক আওয়ামী লীগ বিরোধি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে, যার লক্ষ ছিলো সমাজ তেন্ত্র একটি ধারা প্রতিষ্ঠা করা যেটিকে তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করতেন।
শেখ মুজিবের নেতৃত্বে প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানে অবাধ গণতান্ত্রিক অধিকার সন্নিবেশিত হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলো অবাধ রাজনীতির অধিকার লাভ করে। কিন্ত্র এই অবাধ গণতন্ত্রের সুযোগ গ্রহণ করে অতি উগ্র বামপন্থী দল গুলো গোপনে সশস্ত্রদল, স্কোয়াড গঠন করতে থাকে। তার থান ও ব্যাংক লুট করে। খুন হত্যা রাহাজানি ছিনতাই ডাকাতি জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে।
জাসদের বিপ্লবী সৈনিক দ্বারা সেসময় ৪৭টি থানা লুটের ঘটনা ঘটে বলে বিভিন্ন সুত্র মতে জানা যায়। সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি বাংলাদেশকে ভারতের তাবেদার রাষ্ট্র আখ্যায়িত করে জনগণতান্ত্রিক পুবং বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানায়।
এুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দপাকিস্তান পন্থী হিসেবে, চীনা পন্থীগণ ভারত বিরোধী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর স্বাধীনতা বিরোধী অনেক নেতা-কর্মী মুক্তিযুদে।ধর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে তারা সবাই কোন রাজনৈতিক দলের আশ্যয় নিয়ে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। এ অবস্থায় সিরাজুল ্টালম খান, আ স ম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে জাসদ গঠিত হলে তারা উরিউক্ত দলে অনেকে আশ্রয় গ্রহন করেন। এছাড়া সরকারি- আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেশনের পদচ্যুত কর্মকর্তা-কর্মচারিগণ এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতারাও জাসদে যোগ দেন।
ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস: বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড বইয়ের লেখক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাঈদের মতে ১৯৭২ সনে গৃহীত শাসনতন্ত্রে উত্তি মৌলিক অধিকারের সুযোগ নিয়ে ঐ সমস্ত দল ও চক্র অজ¯্র বনোয়াট মিথ্যাচার সমুহ বিভিন্নভাবে প্রচার করে জনগণকে সার্বিকভাব বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়। স্বাধীনতা বৈরি পঁজিপতি, শোষক শ্যেণি ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমুহ স্ব স্ব সার্থে জাসদকে অর্থ, সম্পদ, সাহায্য ও সহযোগিতা দিতে থাকে। চীনি পন্থী রাজনৈতিক দলগুলো বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় দুশমন আখ্যা দিয়ে তাকে ‘খতম ’ করার ঘোষণা দেয়। চীনা পন্থী সিরাজ শিকদার, হক, তোয়াহা, মতিন, দেবেন শিকদার, শান্তি সেন, অমল সেনদের চীনা পন্থী গ্রুপগুলো ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ও সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করে। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী মুজিব সরকারকে উৎখাত করে নতুন পতাকা উড়ারার হুমকি দেন।। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
,তারিখ ০৯ /০৮/২০২৩