পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট——মর্মান্তিক ও শোকাবহ ঘটনাবলি (পুর্র্ব প্রকাশের পর)


এবাদত আলী

(সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলার মাটিতে ফিরে আসার পর ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বিদেশী সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন‘‘ যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারেনা। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সেটাতো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না তা কেউ পারেনা। এটাঁই আমার বিশ্বাস।’’ )

১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বাঙালি জাতির নয়নমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্তিলাভ করে প্রথমে লন্ডন ও পরে দিল্লী হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করলেন। বাংলার ঘরে ঘরে সেদিন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। বাংলার জনগণ তাঁকে এক ঐতিহাসিক সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। বাংলার মানুষ মহা খুশিতে তাঁকে বরণ করে নিলো । শেখ মুজিব রাষ্ট্রনায়ক হবার পরপরই সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশকে রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মান, মিশর, ইরাক ও আমেরিকা স্বীকৃতি দান করে।
শেখ মুজিব কিছুদিন রাষ্ট্রনায়ক থাকার পর দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পার্লামেন্টারি সরকার প্রবর্তন করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচিত হন এবং দলীয় নেতা হিসাবে শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হন।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভে সর্বোতভাবে সাহায্য সহযোগিতা করলেও ভারতীয় মিত্র বাহিনী তখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করছিল। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে ঢাকায় আগমনের আমন্ত্রণ জানালে ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় আসেন। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে ভারতীয় মিত্র বাহিনী একে একে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। এ সময় অসংখ্য বাঙালি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে। মুজিব সরকার তাদের পুনর্বাসনের ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার, আহত মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপুরণ সরূপ অর্থ মঞ্জুর করা হয়। এ সময় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হয়। এতে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ এই চারটি রাষ্ট্রীয় মুল নীতির কথা স্বীকৃত হয়। গঠিত হয় নতুন মন্ত্রীসভা।
নির্বাচনী ওয়াদার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হয় এবং পি,ও, ৯৮/৭২ নং আদেশ মূলে ১০০ শ বিঘা পর্যন্ত জমির সিলিং ধার্য করা হয়। ১০০শ বিঘার ঊর্ধের পরিবারের জমির মালিকদের উদ্বৃত্ত জমি সরকারের হেফাজতে নিয়ে তা ভুমিহীন কৃষকদের মাঝে বন্দোবস্ত প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কৃষকের কৃষি খাতের উন্নতির জন্য স্বল্পমূল্যে সার ও কীটনাশক বিতরণ করা হয়। কৃষকের মাঝে তাকাবি লোনের ব্যবস্থা করা হয়। পল্লী অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বনির্ভর আদর্শ গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হতে থাকে। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরো শক্তিশালী করার মানসে এবং শ্রমিকদেরকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহে সরাসরি সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে মুজিব সরকার দেশের ভারি শিল্প-কারখানা সমুহকে জাতীয়করণ করে।
দেশে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ সরকারি করণ ও শিক্ষকগণকে সরকারি কর্মচারি হিসাবে মর্যাদা প্রদান করা হয়। স্বাধীনতা লাভের অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য শ্রেনিভুক্ত হতে সক্ষম হয়।
যে ৯৩ হাজার যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনা সদস্য যাদেরকে ভারতের কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল তাদের বাংলার মাটিতে বিচার করা হবে বলে ঘোষণা করা হলেও প্রায় ২ বছর পর তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর বিনিময়ে পাকিস্তানে আটক কয়েক লাখ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি বহুদিন পর স্বাধীন বাংলায় নিজ মাতৃভুমিতে ফিরে আসার সুযোগ লাভ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাকারি রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও পিসকমিটির লোকেরা যারা খুন, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য ও সহযোগীতা করেছিল সেই সকল ব্যক্তি বাদে ছোট-খাটো অপরাধ সংঘটনকারিদেরকে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তাঁর এই মহানুভবতার সুযোগে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ও তাদের অনুসারিরা শেখ মুজিবকে চিরতরে উৎখাত করার জন্য বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে।
দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মুজিব সরকার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পাশাপাশি জাতীয় রক্ষী বাহিনী নামে একটি আধা সামরিক বাহিনী গঠন করে। এই আধা সামরিক বাহিনী সৃষ্টি পুলিশ ও সামরিক বাহিনী ভাল চোখে দেখেনা। সরকারের প্রশাসন যন্ত্রে দুনীতির অভিযোগ ওঠে। দলীয় নেতা-কর্মীগণও এ থেকে বাদ যায়না। (চলবে)।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট ,