// এবাদত আলী
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে আমরা চাটমোহর থানার দিলালপুর গ্রামের টালক প্রমাণিকের বাড়িতে অবস্থান করা অবস্থায় দিলালপুরের ক্যাম্প হতে ঈশ্বরদী থানার বক্তারপুরে অস্থায়ী ক্যম্পে যাবার জন্য নির্দেশ আসে। নদী থেকে নৌকা উঠানো হলো। আমরা একসময় বক্তারপুর মুল ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। নদী পথে বিরাটকায় নৌকা নিয়ে যেখান দিয়ে যাওয়া হোকনা কেন সকলেই বলাবলি করে এই নৌকা মুক্তি বাহিনীর নৌকা। আমাদের এই দেশে ছয় দাঁড়ের নৌকা কোথাও নেই।
একসময় দাশুড়িয়া ইউনিয়নের মাড়মি গ্রামের ছোট মিয়ার বাড়িতে গিয়ে আমাদের যাত্রা বিরতি। তিনি আগে থেকেই আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখান থেকে রাতের বেলা আমরা দাশুড়িয়ার পাশে পাকা রাস্তার উত্তর দিকে গিয়ে নৌকা থামাতে বাধ্য হলাম। কারণ বর্ষাকালে পাকা রাস্তার দুপাশেই পানি। এখানে পাকা রাস্তা পার করতে নৌকা সকলে মিলে ধরাধরি করে পার করতে হবে। তাই পাকা রাস্তায় পাহারার ব্যবস্থা করা হলো। কোন গাড়ি ঘোড়া বিশেষ করে আর্মিদের কোন গাড়ি আসছে কিনা তা পরখ করে সুবিধামত সময় সকলে মিলে ‘আল্লাহ আল্লাহ ধনি বলো’ বলে নৌকা পাকা রাস্তা পার করা হলো। আমরা চুরিওয়ালার ঘাট হয়ে নিরাপদে বক্তারপুর ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম।
সেসময় চারদিকে কলেরা রোগ মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। তাই বাড়ির খোঁজ খবর নেয়ার জন্য কমান্ডারের নিকট কয়েকদিনের ছুটি চাইলে তিনি কোন আপত্তি করেননা। তাই আমি আমার নিজ বাড়িতে ফিরে আসি। আসবার সময় কমান্ডার আমাকে একটি রিভলবার কিছু গুলি, কয়েকটি হ্যান্ড গ্রেনেড ও একখানা ইন্ডিয়ান চাকু দিয়ে দেন।
আমি বাড়ি পৌছে সেরাতেই নকশাল দ্বারা আক্রান্ত হই। নকশাল বাহিনী আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। আমাদের গ্রামের বিল্লাল নামক এক ব্যক্তি সবার অজান্তে আমাদের কাচারি ঘরে ঘুমিয়েছিলো, নকশালরা সেই ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জবাই করে হত্যা করে চলে যায়। আমি আত্মরক্ষামুলক ব্যবস্থা নিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দেই বলে মৃত্যুর হাত থেকে আল্লাহ পাক আমাকে রক্ষা করেন।
আমাদের এলাকায় নাজিরপুরের রজিবুল্লাহ বিশ্বাস ওরফে রতন বিশ্বাস ও তার ছেলে জোমশেদ , জোতআদম গ্রামের জনৈক প্রভাবশালী যুবক এবং তার ছোট ভাই, শ্রীকৃষ্টপুরের এস্কেন, শহীদ, জলিল, গাফফার, হারুন, মোসলেম, মহব্বত খোনকার, বাঙ্গবাড়িয়া গ্রামের আলেপ, নবাব, মজিবর, হান্নান, মান্নান, বাদলপাড়ার মকবুল, লালচাঁদ, হায়াত আলীসহ আরো অনেকেই নকশাল বাহিনীতে যোগ দিয়ে মানুষ খুন ও ডাকাতিতে লিপ্ত হয়েছে। তারা পরপর এলাকার বহুসংখ্যক মানুষকে হত্যা করে। তারা নওদাপাড়া গ্রামের শিক্ষক মফিজ উদ্দিন শেখ, নতুন বাঙ্গাবাড়িয়া গ্রামের নিয়ামত সরদার, ইউনুছ ডাক্তার, মোসলেম, আব্দুল হাই, বাঙ্গাবাড়িয়া গ্রামের আব্দুল গণি প্রাং, রুপপুর গ্রামের হামেদ, শংকরপুর গ্রামের আবুল মালিথা (ইউপি মেম্বর), আনছের মালিথা, জোতআদম গ্রামের আপন দুভাই আফাজ উদ্দিন ও রফিজ উদ্দিন (গন্ধ ও মন্দ) কে গুলি করে হত্যা করে। তারা বাদলপাড়া গ্রামের আজগার প্রামানিককে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে এবং একই গ্রামের অফেজ উদ্দিনকেও হত্যা করে।
দাপুনিয়া ইউনিয়নের হোটরা গ্রামের বয়েন ডাকাতকে নিজ হাতে কবর খুড়িয়ে সেই কবরে তাকে শুতে বলা হয়। সে সেই কবরে শোবার পর উপর থেকে তাকে মাটি চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। দাপুনিয়া ইউনিয়নের চকভবানি গ্রামের জানমামুদ প্রামানিক ওরফে জানা প্রামানিককে নকশালেরা হত্যা করে। এঘটনর পর তার ছেলে জয়েন (পরবর্তীকালে চেয়ারম্যান) প্রতিশোধ নেওয়ার মানসে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি হয়। সেই সাথে গ্রামের আব্দুল প্রামাণিক ও আউয়ালকেও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেওয়ায়।
এলাকার নকশালদের উৎখাত করাও তখন আমাদের জন্য একটি বড় কাজ বলে বিবেচিত হতে থাকে। তাই স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোকদের সঙ্গে অতি সংগোপনে যোগাযোগ করতে থাকি। আমাদের গ্রাম অর্থাৎ মালিগাছা ইউনিয়নের বাদলপাড়া গ্রামের একজন সাহসি ব্যক্তি আফসার মোল্লা। তিনি শুরু থেকেই নকশাল দমনে সচেষ্ট ছিলেন কিন্তু একা কিছুই করতে পারছিলেননা। অপর ব্যাক্তি ছিলেন দাপুনিয়া ইউনিয়নের শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামের আব্দুল আজিজ মন্ডল। এই দুজনের সঙ্গে সসমন্বয় করে একটি উদ্ভট অথচ মানানসই বুদ্ধি বের করা হলো। তারা সে মোতাবেক নকশাল দমনে মরিয়া হয়ে উঠেপড়ে লাগেন। তারা পাবনা শহরের পিস কমিটির অন্যতম সদস্য মোফাজ্জল ডাক্তারের ছোট ভাই অর্থাৎ মগরেব মুন্সির ছেলে কালু মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই কালু মিয়া আগাগোড়াই আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মি এবং বঙ্গবন্ধুর ভক্ত স্বাধীনতার পক্ষে ও নকশালী তৎপরতার বিপক্ষে সোচ্চার ছিলেন। তারা তার মাধ্যমে পাবনায় অবস্থানরত মিলিটারি ক্যাম্পে গিয়ে হাজির হন। তখন রমজান মাস। আর্মি অফিসারের নিকট গিয়ে তারা বলেন যে, আমাদের এলাকায় মুক্তিবাহিনীরা ঘাঁটি গেড়ে এলাকার লোকজনকে দারুন হয়রানি করছে। তারা একটি বাংকার কেটে রাতে সেখানে থাকে এবং দিনের বেলা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে অন্যায় অত্যাচার করে। তারা আরো জানায় যে ঐ মুক্তি বাহিনীরা এলাকার সুন্দরী মেয়েদেরকে ধরে তাদের বাংকারের মধ্যে আটকে রেখে তাদের উপর যৌন নিপিড়ন করে। আর্মি অফিসার তখন বলে কেয়া বাত? মুক্তি হায় ? আওর মুক্তি কি ছাত আওরতভি হায়। ঠিক হায় হাম উহাপর জরুর জায়েগা। এইসব কথা বলে তাদেরকে বলে কথা যদি মিথ্যা হয় তবে তোমাদের জীবন খতম করে দেয়া হবে। সুযোগ বুঝে তারা বলে হুজুর সব কথা সত্যি হায়। আজকে রাতেই চলেন হুজুর ওদের দেখা মিলতা হায় হুজুর। যে কথা সেই কাজ তাদেরকে আর্মি ক্যাম্পে আদর যতেœ রাতের খানা খাওয়ানো হলো। তারা ভাবে যে আমাদের এই বুঝি শেষ খানা খাওয়া। শেষ রাতে তাদের সেহেরি খেতে দেওয়া হয়। তারপর দুজনকে দুটি বোরকা পরানো হয় এবং পৃথক দুটি মিলিটারি কনভয়ে উঠানো হয়। এদিকে নকশালেরা সেসময় দাপুনিয়া ইউনিয়নের কলাবতি গ্রামে ভাদুর মার বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে মাটি খুড়ে খুড়ে বিরাটকায় গর্ত তৈরি করে সেই নিরাপদ গর্তে তারা থাকতো। সেখানে জীবন যাপনের সব রকম ব্যবস্থাই তারা করে রেখেছিলো। অপর দিকে আমাদের মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা রতœাই নদীর (বাঙর নদী) দক্ষিণ পাড়ে বাঙ্গাবাড়িয়া বাদলপাড়া ও নওদাপাড়া গ্রামে পজেশন নিয়ে থাকে।
আর্মির একটি শক্তিশালী বহর মনের আনন্দে মুক্তিবাহিনীদেরকে কুপোকাত করতে চলেছে। আব্দুল আজিজ মন্ডল ও আফছার আলী মোল্লা তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। সে এক রোমাঞ্চকর ও ভয়াবহ অপারেশন।
(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।