রেলের সহযোগীতায় গড়ে ওঠেছে বালুর খোলা বালুর স্তুপে ঢাকা পড়েছে ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ

// ঈশ্বরদী (পাবনা) সংবাদদাতাঃ
ঈশ্বরদীর পাকশীতে বিভাগীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সহযোগীতায় ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সন্নিকটে পদ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকা দখল করে গড়ে ওঠেছে অবৈধ বালুর খোলা। পাহাড় সমান বালুর স্তুপ সাজিয়ে ভ্যাট-ট্যাক্স ছাড়াই শুধু ম্যানেজ করেই বছরের বছর জমিয়ে চলছে রমরমা বালুর ব্যবসা। খরচ বলতে নৌকা ভাড়া, চাঁদা আর লেবার খরচ। আওয়ামী লীগের স্থানীয় কতিপয় নেতা এ বালুর খোলার হর্তকর্তা। কেপিআইভূক্ত এলাকায় বালুর ব্যবসা সহযোগীতা করছে রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় ভূসম্পত্তি অফিস, লক্ষীকুন্ডা নৌ পুলিশ ফাঁড়িসহ অন্যান্য সংস্থা ও প্রশাসন। প্রকৌশলীদের মতে, বালু স্তুপের কারণে বর্ষা মৌসুমে পদ্মা নদীর স্রোত বাধাগ্রস্থ ও গতিপথ  পরিবর্তন হয়। এতে ব্রিজের পিলার ও গাইড ব্যাংকের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখিন।

পাকশীতে হার্ডিঞ্জ সেতুর পাশে পদ্মা নদীর তীরে গাইড ব্যাংকের বিশাল এলাকা জুড়ে বালুর স্তুপ রয়েছে। পাকশীর আওয়ামী লীগের নেতা ও  ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস শুরু হতেই বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রক জানা গেছে। তবে নতুন কেউ কেউ বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রক হয়েছেন। বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রকরা ওই এলাকাকে বালুমহাল বলছেন না, বলছেন বালুর খোলা। অন্যান্য স্থান হতে বালু এনে এখানে স্তুপিকৃত করে ব্যবসা করছেন বলে তাদের দাবি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও লক্ষীকুন্ডা নৌ-পুলিশ এসব দেখেও দ্যাখেন না। নির্বিঘেœ বালুর ব্যবসার কাজে তাদেরও সহযোগীতা রয়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। এলাকাবাসী ও দলীয় অন্যান্যদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ সেতুর পাশে নদী তীরবর্তী গাইড ব্যাংকের পাশে বিশাল এলাকা কৃষিকাজের জন্য রেলওয়ের ভূসম্পত্তি অফিস থেকে লীজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে কৃষিকাজ হয় না। লীজ গ্রহীতাদের নিকট থেকে ভাড়া নিয়ে বালুর ব্যবসা চলছে। শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এবং লালন শাহ সেতুর খুব কাছে বালুর ব্যবসা পরিচালনার কারণে ব্রিজ দুটির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। বালুর স্তুপ বড় হতে হতে বিশাল স্তুপের আড়ালে ঢাকা পড়েছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতু। স্থানীয়রা জানান, বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রকরা প্রতিদিন টাকা ওঠানোসহ যাবতীয় কর্মকান্ডে দায়িত্ব পালন করেন। বালুমহালের বালু ব্যবসায়ীরা জানান, জমি ভাড়া নিয়ে তারা বালু স্তুপ করে বিক্রি করছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে ট্রাক-ট্রাক্টর আসছে ও বালু নিয়ে চলে যাচ্ছে। বালু বোঝাইয়ের পর নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে টাকা দিচ্ছে। এখানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক হাজার ট্রাক ও ট্রাক্টর বালু বিক্রি হয় বলে জানা যায়। টাকার হিসেবে এসব ঘাট থেকে প্রতিদিন ২০-৩০ লাখ টাকার বালু বিক্রি হয়। ট্রাক প্রতি এবং বালুর ফুট হিসেব করে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয়।

রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী (ডিইএন-২) বীরবল মন্ডল বলেন, পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ মূলত আপস্ট্রিমের পানি প্রবাহ। বৃটিশরা যখন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ তৈরি করে ব্রিজট রার জন্য রক্ষা বাঁধ ( গাইড ব্যাংক) আপস্ট্রিমে অনেক দূর পর্যন্ত করেছে। এটি ব্রিজটি রক্ষার স্বার্থেই। এখন বালু মহালকে কেন্দ্র করে গাইড ব্যাংক ব্যাপকভাবে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে কেউই গুরুত্ব দিচ্ছে না। একে পদ্মা নদীর নাব্যতা কমেছে। আর এভাবে যদি রক্ষা বাধটাকে ধ্বংস চালানো হয়, তবে যদি কখনো সিলেটের মতো হঠাৎ বন্যা আসে তাহলে রা বাঁধটাকে ধ্বংসের ফলাফল স্বরূপ ব্রিজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ব্রিজটি ইতোমধ্যে তার গানিতিক আয়ুষ্কাল অতিবাহিত করেছে। ফলে যদি কোন পিয়ার ওয়াস আউট হয়, তবে সেটা অবাক হওয়ার মতো বিষয় থাকবে না। ব্রিজের ডাউন স্ট্রিমের বালুমহাল স্থানান্তর খুবই জরুরী। এতে ব্রিজ রা পাবে। দেশের রাষ্টীয় সম্পদের বিষয় অনুধাবন করে প্রতিটি সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে। রেলওয়ের নিবিড় তত্ত্ত্বাবধানে ব্রিজ ১০৮ বছর  জীবনকাল পার করেছে। অসচেতনতা আর ডিপার্টমেন্ট ইজমের জন্য আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বিলুপ্তির পথে ধাবিত করছি না তো ?

পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) শাহ সূফি নূর মোহাম্মদ বলেন, বালুর ওই জমি রেলের। এতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পিলার ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। পিলার রক্ষার জন্য গাইড ব্যাংক করা হয়েছে। বালু রাখার কারণে গাইড ব্যাংকেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের ভূসম্পত্তি অফিস এসব জমি দেখাশোনা করে। এবিষয়ে তাদের বলেছি। কিন্তু ভালো রেসপন্স পাচ্ছি না। বালু ব্যবসা থেকে রেলের কোন আয় হয়না জানিয়ে ডিআরএম আরও বলেন, আয় অর্জনের চেয়ে কারিগরি দিক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় প্রভাবশালী চক্র। আপোষে বালু সরিয়ে নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না। আপোষে সরিয়ে না নিলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এবং গাইড ব্যাংক রক্ষার জন্য শক্তি প্রয়োগ করা হবে।  

পাকশী বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান এবং পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক ইউপি’র চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাসের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তারা উভয়েই হজব্রত পালন করতে সৌদি আরব অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।

পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল ইসলাম হব্বুল বলেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকার আশেপাশে আগে নদী থেকে বালু তোলা হলেও এখন হয় না। অন্য এলাকা হতে নৌকায় বালু এনে এখানে স্তুপ করে ব্যবসা হয়। নৌকায় বালু আনতে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয় বলে শুনেছি। বালু ব্যবসার সাথে আমি কোনদিনই জড়িত নেই জানিয়ে তিনি বলেন, সাবেক চেয়ারম্যান এনাম বিশ্বাস নূহ আমল থেকে বালুর সাথে জড়িত। ক্ষমতাসীনদের সাথে রেলের লোক ও প্রশাসনের লোকজনও জড়িত না থাকলে দীর্ঘদিন ধরে চলমান বালুর ব্যবসা বন্ধ হয় না কেন। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও গাইড ব্যাংকের ক্ষতি প্রসংগে তিনি বলেন, রেল তাদের জমি লীজ দিছে, তারা ব্যবস্থা না নিলে আমরা কি বলবো। রেল, নৌ পুলিশ ও প্রশাসন কেউই কিছুই বলে না। বিবিসি বাজার এলাকায় পাবলিকের জমির মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। আমাদের কিছু বলার উপায় নেই। সামনে ভোট, আমরা মানুষের কাছে কি জবাব দেব। ক্ষমতাসীন কারা জড়িত জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এরআগে পাকশীতে পুলিশ কর্মকর্তাসহ অনেকগুলো খুন হয়েছে। জড়িতদের নাম বলে খুনের শিকার হতে চাই না।

লক্ষীকুন্ডা নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এমদাদ হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নৌকায় করে বৈধ বালুর চর থেকে বালু এনে এখানে স্তুপ করা হয়। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কি জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এখন কক্সবাজারে আছি, ফিরে এসে কি করা যায় দেখব।

এবিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের সহকারি কমিশনার (ভূমি) টি এ রাহসিন কবীর জানান, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আশেপাশের এলাকা কেপিআই ভূক্ত। এ এলাকা রেলের জানিয়ে তিনি বলেন, কেপিআই ভূক্ত এলাকায় বালুমহাল বা ব্যবসার সুযোগ নেই। ঈশ্বরদীতে স্বীকৃত কোন বালুমহাল নেই বলে জানান তিনি।