শাহজাদপুর কুঠিবাড়িতে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ

// এবাদত আলী
বিশ্ব কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদার হিসেবে এষ্টেট দেখাশোনার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য ১৮৯০ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জমিদারি পর্যবেক্ষণ করার নির্দেশ দেন। সেমতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদার হিসেবে প্রথমে ১৮৯১ সালে কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহে এবং পরবর্তীকালে শাহজাদপুর কুঠিবাড়িতে আগমণ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকা নাথ ঠাকুর ছিলেন অগাধ সম্পত্তির মালিক। কিন্তু তাঁর আকস্মিক মৃত্য ঘটলে দেখা যায় যে, তিনি বহু দায়-দেনা রেখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের পিতা সেসকল দায়-দেনা পরিশোধ করেন। অতঃপর তিনি উড়িষ্যার তিনটি জমিদার, পাবনার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ) শাহজাদপুর, রাজশাহীর (নওগাঁ) পতিসর এবং নদীয়ার (কুষ্টিয়ার) বিরাহীমপুর জমিদারির মালিক সাব্যস্ত হন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষ নীলমনি ঠাকুর ইংরেজ কোম্পানি আমলে আমিন গিরির চাকরি করতেন। সেই সুবাদে তিনি অগাধ টাকা কড়ির মালিক হন এবং ঠাকুর পরিবারের ভিত্তি পত্তন করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে নাটোরের মহারাজা রঘুনন্দনের নিকট বিরাহিমপুর পরগনা ইজারা দেয়া হয়। পরবর্তীকালে যশোরের বিখ্যাত জমিদার সীতারাম রায় ছিলেন এই জমিদারির মালিক। সীতারাম রায়ের পতনের পর নবাব মুর্শিদকুলি খান তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারি নাটোর রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা রঘুনন্দনকে দান করেন। পরে নাটোরের রানী ভবানী এষ্টেট হিসেবে খ্যাত উত্তর ইব্রাহীমপুর পরগনা (বিরাহীমপুর) ১৮০০ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নিলামে খরিদ করেন। পরবর্তীকালে শেলী নামক এক নীলকর ফিরিংগীর নিকট হতে ১৮০৩ সালে ঠাকুরেরা শিলাইদহ কুঠি ক্রয় করেন এবং ঠাকুর জমিদারগণ উক্ত কুঠিকে বাস ভবন হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। অপর দিকে নাটোরের রানী ভবানীর শাহজাদপুর এষ্টেটেটর জমিদারি ১৮৪০ সালের দিকে বাকি খাজনার দায়ে নিলামে উঠলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র তের টাকা দশ আনায় তা খরিদ করে নেন। শাহজাদপুর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত কাচারি বাড়িতে একটি কুঠি ছিল যাতে নীলকর সাহেবরা বসবাস করতেন। জমিদারি ক্রয় করার পর এই ভবনটি ঠাকুর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রিন্স দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর বিশাল জমিদারি দেখা শোনা করা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ায় তিনি প্রত্যক্ষভাবে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্বভার ত্যাগ করেছিলেন। তখন থেকে পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বড় জামাই সারদা প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ , দ্বিজেন্দ্রনাথের বড় ছেলে দিপেন্দ্রনাথ ও মেজ ছেলে অরনেন্দ্রনাথ, সারদা প্রসাদের ছেলে সত্য প্রসাদদের উপর জমিদারি দেখাশোনার ভার দেন। পরবর্তীতে জমিদার হিসেবে এষ্টেট দেখাশোনার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ১৮৯০ সালে তাঁকে জমিদারি পর্যবেক্ষণ করার নির্দেশ দেন। এসময় রবীন্দ্রনাথকে লেখা তাঁর বাবার একটি চিঠি উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছিলেন, “ এইক্ষণে তুমি জমিদারি কার্য পর্যবেক্ষণে প্রস্তুত হও। প্রথমে সদর কাছারিতে নিয়মিতভাবে বসিয়া সদর আমিনের নিকট হইতে জমা ওয়াশিল বাঁকি ও জমা খরচ দেখিতে থাক এবং প্রতিদিন আমদানি রপ্তানি পত্র সকল দেখিয়া তাহার সারমর্ম নোট করিয়া রাখ। প্রতি সপ্তাহে আমাকে তাহার রিপোর্ট দিলে উপযুক্ত মতে তোমাকে আমি উপদেশ দিব এবং তোমার কার্যে তৎপরতা এবং বিচক্ষণতা আমার প্রতীতি হইলে আমি তোমাকে মফঃস্বলে থাকিয়া কার্য করিবার ভার অর্পণ করিব।”
পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে কিছু জমিদারির সামগ্রিক দায়িত্ব “ পাওয়ার অব এটর্নি মাধ্যমে অর্পণ করেছিলেন। অনেকের ধারণা ঠাকুর পরিবারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ এবং ঠাকুর এষ্টেটের আমলাদের বিরুদ্ধে প্রজাদের বিভিন্ন ধরনের অভিযোগের কারণে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯১ সালে জমিদারি পরিচালনার জন্য কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আগমণ করেন। তখন রাজশাহী জেলার (বর্তমান নওগাঁ) পতিসর (কালিগ্রাম), পাবনা জেলার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ) শাহজাদপুর এবং নদীয়া (বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি থানা) বিরাহিমপুর এই তিন অংশে ঠাকুর পরিবারের জমিদারি বিভক্ত ছিল। আর এসব গুলোই দেখাশোনা করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, পুত্র রথীন্দ্রনাথ, কন্যা রাণী ও মীরাসহ আরেক সন্তান নিয়ে তিনি রীতিমত শিলাইদহে সংসার পাতলেন। জমিদারি দেখাশোনার জন্য অন্যান্যদের মত তিনি মাসিক দু’শ টাকা হারে মাসোহারা পেতেন। পরে অবশ্য তা মাসিক ১শ টাকা বৃদ্ধি করা হয়।
জমিদারি দেখাশোনা করতে গিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অতীতের চিরাচরিত প্রথা ভেঙ্ েনতুন পথে যাত্রা শুরু করেন। প্রজা হিতৈষী এই জমিদার শিলাইদহ কুঠি বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও তিনি মাঝে মধ্যেই শাহজাদপুর কুঠিবাড়িতে গমণ করতেন। পদ্মা নদীতে বজরা নৌকা ভাসিয়ে পাবনা শহরের অভ্যন্তরের ইছামতি নদী বেয়ে তাঁর বজরা নৌকা ভেসে চলতো শাহজাদপুরের দিকে। ইছামতি নদীর বর্ণনা প্রসঙ্গে কবি লিখেছেন, পদ্মা নদীর কাছে মানুষের লোকালয় তুচ্ছ কিন্তু ইছামতি মানুষ ঘেঁষা নদী। ছোট নদীটির উপর ঘন বর্ষার সমারোহের মধ্যে একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে করছে। মেঘলা গোধূলিতে নিরালা ঘরে মৃদুমন্দস্বরে গল্প করে যাওয়ার মত চিঠি। (ছিন্ন পত্র)। তাঁর নৌকা সরাসরি শাহজাদপুর কাছারিবাড়ির ঘাটে গিয়ে ভিড়তো। আর যখন পানি কম থাকতো তখন বড়াল নদীর তীরে রাউতারা ঘাটে তরি ভিড়িয়ে পালকিতে চড়ে তিনি শাহজাদপুর কাচারি বাড়িতে গমণ করতেন।
ছিন্নপত্রে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুরের তাঁর কাচারি বাড়ি সম্পর্কে লিখেছেন, “ আমি চারটি বড় বড় ঘরের মালিক।” পুর্বে রবীন্দ্র কাচারি বাড়ি সংলগ্ন উত্তরে ও দক্ষিনে দুটি বড় বাগান ছিল। পাশেই ছিল একটি কৃত্তিম হ্রদ। রবীন্দ্রনাথের পরিচর্যায় এই হ্রদের মধ্যে বারোমাস পদ্ম ফুল ফুটে থাকতো। একসময় এই কাচারি বাড়ি ঘিরে ছিল বড় বড় ঝাউ, লিচু, আম, দারুচিনি, কামিনী ফুলের গাছসহ আরো দু®প্রাপ্য গাছ-পালা। কবি এই বাগানের কথাই ছিন্ন পত্রে লিখে গেছেন, “ দক্ষিনের বারান্দায় কেবল মাত্র কামিনী ফুলের গন্ধে মস্তিষ্কের রন্ধ্র পূর্ণ হয়ে উঠে।” শাহজাদপুর কাচারি বাড়ির নিচের তলায় ছিল একটি ডাকঘর। পোস্টমাস্টার চিঠিতে স্ট্যাম্প দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কবির সঙ্গে গল্প-গুজব করতেন। তিনিই ‘পোস্টমাস্টার ’ গল্পের মধ্যে অমর হয়ে রয়েছেন।
কুঠি বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদী দেখে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “ – আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।” এই কুঠি বাড়িতে তিনি যে সুখানুভুতি পেতেন তা লিখে গেছেন ছিন্নপত্রে। অনেক কাল বোটে থাকার পর শাহজাদপুর বাড়িটি বেশ ভালো লাগে। একটা যেন নতুন স্বাধীনতা পাওয়া যায়। যতটা খুশি নড়বার চড়বার আবার শরীর প্রসারণ করবার জায়গা পাওয়া মানুষের মানসিক সুখের যে একটা প্রধান অঙ্গ সেটা আবিষ্কার করা যায়। ” (ছিন্নপত্র ১৮৯৩, শাহজাদপুর)। কবির এই কথাতেই বুঝে নেওয়া যায় কি ছিলো এই কাুঠি বাড়িতে।
যতদুর জানা যায় কবি ১৮৯১ সাল হতে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত জমিদারি দেখাশোনার জন্য এই শাহজাদপুর কুঠিবাড়িতে মাঝে মধ্যে আসতেন। শাহজাদপুর কুঠি বাড়িতে বসে কবি বহু কবিতা, ছোট গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করেছেন। এই সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ছুটি,’ পোস্টমাস্টার, রাম কানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, ক্ষুধিত পাষাণ, অতিথি, সমাপ্তি ইত্যাদি। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।