ফেলে আসা দিন গুলো-৩২

// এবাদত আলী //
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ হতে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত গোটা পাবনা জেলা (সিরাজগঞ্জ মহকুমাসহ) মুক্ত এলাকা ছিলো। এরপর ঢাকা থেকে পাকিস্তানি বাহিনী নগরবাড়ি ঘাট হয়ে উত্তর বঙ্গে প্রবেশ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সঙ্গে প্রচন্ড লড়াই করে। কয়েকদিন ধরে একটানা যুদ্ধ চলে। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কোন অবস্থাতেই টিকে থাকা সম্ভব নয় সে কারণে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী তাদের অবস্থান ছেড়ে পিছু হটে প্রথমে নাটুয়াবাড়ি তারপর আতাইকুলা এবং সবশেষে পাবনা শহরের পশ্চিমাঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
১০ এপ্রিল রাতের বেলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পাবনা শহর দখল করে নিয়ে ভেরী লাইট জ্বালায় ও টেসারগান ফায়ার করতে থাকে। এই দিন সুযোগ বুঝে দিনের বেলা নকশালেরা পাবনা শহরের একটি ব্যাংক লুট করে।
এ সময়ের পর যে যার মত ভারতে যাওয়া শুরু হলো। ২জন ৪জন করে ভারতে যাওয়া হতো। পাবনার স্বেচ্ছাসেবি বাহিনীর প্রধান রফিকুল ইসলাম বকুলের সঙ্গে পরামর্শ করে আমরা প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে যাবার জন্য সিদ্ধান্ত নেই।
রফিকুল ইসলাম বকুল, তার বড়ভাই আব্দুর রাজ্জাক মুকুল, ফজলুল হক মন্টু, বাবুল, জিলানী, ইকবাল হোসেন, জহুরুল ইসলাম বিশু ও সামস সহ বেশ কজন এক সঙ্গে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
ইতো মধ্যে আমাদের এলাকায় নকশালি তৎপরতা পুরাপুরি শুরু হয়ে গেছে। তারা বেছে বেছে মানুষ হত্যা করছে এবং সেই সাথে লুটতরাজও চালিয়ে যেতে থাকে। নকশালেরা এদিন রাতের বেলা বাঙ্গবাড়িয়া গ্রামের মনিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়িতে হামলা করে তার ভাই রবি ঠাকুর ও ভাতিজা বিশুকে হত্যা করে এবং লুটতরাজ করে। তারা বাদলপাড়ার অফেজ উদ্দিনকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে কয়েকদিন আটকে রেখে অবশেষে তাকে হত্যা করে।
আমি (এবাদত আলী), আমার গ্রাম বাদলপাড়ার আফফান মামা, ভাঁজপাড়ার সাদেক খান ও শ্রীকৃঞ্চপুরের এম মুকতার আলী আমরা বুদ্ধি ঠিক করলাম আমরা ভারতে যাবো। দাপুনিয়া হাটবারে আমরা বাড়ি থেকে রওনা হবো হাটে যাবার নাম করে। যাতে কেউ কোন সন্দেহ না করতে পারে। আমাদের এলাকায় তখন নাজিরপুরের জোমসেদ নকশালের ঘাঁটি স্থাপন করে যুবকদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। আমাদেরকে তার দলে যোগ দিবার জন্য তখন দারুন চাপ ছিলো আমাদের উপর।
আমরা কিছুতেই নকশালে যোগ দেবোনা। আর তাই বাড়ি থেকে ভারতে যেতে চাইলেও তারা আমাদেরকে যেতে দিবেনা। দিন ঠিক হলো। আমি দুপুরে গোসল করতে গ্রামের রতœাই (বাঙ্গড় ) নদীতে গিয়েছি। গোসল সেরে কিছু খাবার খেয়ে আমরা রওনা দিবো।
এদিকে আমার স্ত্রী মাহমুদা বেগম ৯ মাসের সন্তান সম্ভবা। তাকে ঐ অবস্থায় রেখেই আমাকে যেতে হবে। কিন্তু আমার শশুর ও জেঠা শশুর তাদের মেয়েকে নিয়ে যাবার জন্য ঠিক সেদিনই আমাদের বাড়িতে আসেন। আমি গোসল করতে করতে দেখি ২ ব্যাক্তি খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে। দুর থেকেই চিনতে পেরে আমি তাদের নিকট এগিয়ে গেলাম এবং তাদেরকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে গেলাম।
তাঁরা বল্লেন যে তারা শাহজাদপুরের পোতাজিয়া থেকে গতকাল বের হয়ে পায়ে হেঁটেই এপর্যন্ত এসেছেন। দুজনের পা ফুলে গেছে। তারা যখন শুনলেন যে আমি ভারতে যাবো তখন বলেন যে, ভারতে পরে যাওয়া যাবে। আমরা মাহমুদাকে নিতে এসেছি তুমি সঙ্গে না গেলে আমরা আর পোতাজিয়াতে কোন মতেই ফিরে যেতে পারবোনা। অগত্যা আফফান মামা এবং মুকতার আলীকে আমার অপারগতার কথা জানালাম।সিদ্ধান্ত হলো আমার সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে তার বাবার বাড়িতে রেখেই আমি ভারতে চলে যাবো।
পরদিন সকাল বেলা আমার স্ত্রী মাহমুদা বেগম, আমার শশুর মোঃ মর্তুজা মিয়া ও আমার জ্যাঠা শশুরসহ চারজন পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে পোতাজিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। এসময় রাস্তায় পারতো পক্ষে কেউ বের হতে চায়না। আমাদের সামনে দারুন বিপদ। অন্তসত্তা স্ত্রীকে আর শশুর জেঠা শশুরকে সঙ্গে নিয়ে যেন নিরুদ্দেশ যাত্রা। সম্পুর্ন মেঠো পথ। গরুর গাড়ির নিরিখ ধরে পথ চলা। অর্থাৎ জমির আইলের উপর দিয়ে কোন মতে পথ চলা। আমরা মালিগাছা পৌঁছে দুরু দুরু বুকে আমার ফুফা হাজী নজিমুদ্দিন ওরফে নজরা হাজির বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। পাকা রাস্তার ধারেই তার বাড়ি। এই বাড়ি হতে খুব ভালো করে খোঁজ খবর করা হলো কোন মিলিটারির জিপ অথবা লরি চলাচল করছে কিনা। এদিক ওদিক খুব ভালো করে দেখে অতি তাড়াতাড়ি পাকা রাস্তা পার হলাম। রাস্তার ওপারে গিয়ে আবার কিছু সময় বিশ্রাম নেয়া হলো।
এরপর পায়ে হাঁটা শুরু হলো। এ পথের যেন আর শেষ নেই। চলছি তো চলছিই। কাশিনাথপুর হয়ে আমরা যখন ডেঙ্গার গ্রামে পৌঁছলাম তখন বেলা দুপুর গড়িয়ে গেছে। বাড়ি থেকে আসবার সময় আমার মা কিছু চিড়া ও খেজুরের গুড় দিয়েছিলেন। আমরা রাস্তার পাশে তাল গাছের নিচে বসে তার কিছুটা খেলাম। কিন্তু সেখানে কোন পানির ব্যবস্থা ছিলোনা। তাই গ্রামের মধ্যে গিয়ে এক বাড়ি থেকে আমরা পানি চেয়ে খেলাম। আমরা পোতাজিয়াতে যাবো শুনে সে বাড়ির লোকজন আমাদেরকে তাদের বাড়িতে সেদিনের মত আশ্রয়দিতে চাইলেন এবং পরদিন যাবার জন্য বলেন। আমরা বলি বেলা থাকতে আমরা যতদুর পারি যাবো। তারপর না হয় কোন বাড়িতে রাত্রি যাপন করবো।
অবশেষে রাত্রি যাপন করতেই হলো। আর তাহলো একদন্ত বাজারের পশ্চিম পাশে কাদের মাষ্টারের বাড়িতে। আমাদের গ্রামের আজগার শাহ যাকে আমি মামা বলে ডাকি তারই মেয়ে জহুরার স্বামী হলেন আব্দুল কাদের মাস্টার। আমরা সেখানে গেলে নিশ্চয়ই তারা রাতটুকু থাকার ব্যবস্থা করবে। সন্ধ্যার কিছু আগে আমরা গিয়ে কাদের মাস্টারের বাড়িতে উঠলাম। সেসময় প্রায় সকলেরই টানাটানি। হাট-বাজার দোকান-পাট সবই বন্ধ। মানুষের হাতে টাকা কড়ি নেই বল্লেই চলে। খাদ্য খানার বড়ই অভাব। তবুও নিজ গ্রামের আত্মীয় একটু খাতির তো করতেই হবে। জহুরা আমাদেরকে পেয়ে খুবই খুশি। আমাদেরকে যথেষ্ট সমাদর করতে লাগলো। আমরা প্রথমে কিছু নাস্তা খেয়ে বিশ্রাম নিতেছিলাম।
এমন সময় কাদের মাস্টার এসে জানালো যে, একদন্তে মিলিটারি আসবে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মহিলারা শিশু সন্তানসহ দৌড়া দৌড়ি ছুটাছুটি শুরু করে দিলো। জহুরা তার ভাবিকে সঙ্গে নিয়ে ঝোপ-ঝাড়ে পালিয়ে রইলো। আমার শশুরেরা বল্লেন আমরা আর কোথায় পালাবো। মরন থাকলে এখানেই মরবো। তোমরা একটু সরে থাকো। কাদের মাস্টার আর আমি বাড়ির এপাশ ওপাশ পাহারা দিতে লাগলাম। এমনি করেই প্রায় রাত কেটে গেল। এরই মধ্যে জহুরার শাশুড়ি কিছু ভাত রান্না করেছিলেন যা অনেক রাতে চুপিস্বারে পালাক্রমে খাওয়া হলো। (চলবে)। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।