// মাজহার মান্নান কবি ও কলামিস্ট
'' হে ক্ষণজন্মা প্রবাদ পুরুষ
বীর মুক্তিযোদ্ধা
গণ মানুষের মুক্তির সেবক
কালজয়ী এক বোদ্ধা।''
কালের গর্ভে প্রতিটি মানুষকেই হারিয়ে যেতে হবে। তবে কজন পারে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিতে। প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন থাকে জাকজমক জীবন যাপন করা। মানুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিজের আরাম আয়েশ আর সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য। কিন্তু এমন কিছু মানুষের জন্ম হয় এই ধরায় যারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে অন্যের মঙ্গলের জন্য। মানব সেবা যাদের পরম ব্রত। তেমনি একজন সাদা মনের মানুষ হলেন ডাঃ জাফরউল্লা চৌধুরি। এই মহান ব্যক্তির সাথে আমি একবার সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলাম। তার সৌজন্যবোধে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তার পান্ডিত্য, প্রজ্ঞা, জীবন দর্শন, দেশপ্রেম এবং সহজ সরল জীবন অনেক মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস। অকুতোভয়, নিভৃতচারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা এই মানুষটি ছিলেন সাধারন মানুষের জন্য এক বাতিঘর। কোন ধরণের লোভ লালসা, অর্থবিত্ত তাকে কাছে টানতে পারে নি। মহা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি অতি সাধারন জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। যে কোন সত্যকে খুব সহজে বলতে পারতেন।সত্যিকার অর্থে তার মত সৎ ও সাহসী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি যতটা সরব ছিলেন ততটা অন্য কাউকে দেখিনি। গণ মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে তিনি প্রথম সারিতে থেকেছেন। জীবন শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ে গেছেন। তিনি কতটা দেশপ্রেমিক ছিলেন তার দু একটি উদাহরন থেকেই আমরা বুঝতে পারি। যাদের অর্থ আছে তাদের গায়ে একটু জ্বর এলেই বিদেশে চলে যান চিকিৎসার জন্য। অথচ ডাঃ জাফরউল্লাহ দেশের মাটিতেই জীবনের শেষক্ষণ পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন। নিজ দেশের চিকিৎসার প্রতি আস্থা রেখেছেন। লন্ডনের সেই সুন্দর জীবনের হাতছানি ছেড়ে পাকিস্থানী পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। গড়ে তোলেন বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল যেখানে আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসা দেয়া হত। এমন আরো বহু নজীর আছে যেটা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে ডাঃ জাফরউল্লা ছিলেন দেশের এবং দেশের মানুষের জন্য এক নিবেদিত প্রাণ। বহুমাত্রিক এই প্রতিভার অধিকারী মানুষটিকে আমরা কতটুকু মূল্যায়ন করতে পেরেছি? যে মানুষটি তার জীবনকে মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন, সারাজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। ২০ বছরের পুরাতন শার্টি প্যান্ট যিনি পরে থাকতেন, কোন দামি গাড়ি কখনোই ব্যবহার করেন নি তার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর জমি দখল, ভাঙ্গচুর ও হত্যা চেষ্টার মামলা করে বসলেন মানিকগঞ্জের এক ব্যক্তি। কোন স্বার্থে, কার স্বার্থে ঐ ব্যক্তি মামলাটি করেছিলেন তা দেশবাসী জানে। ডাঃ জাফরউল্লা জামিনে যদিও মুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি যে হয়রানির শিকার হয়েছিলেন সেটার দায় কে নিবে?
ডাঃ জাফরউল্লার জীবনে অর্জনের ঝুলি অনেক বড়। কিন্তু নিজ প্রয়োজনে সেই অর্জন গুলিকে কখনোই কাজে লাগান নি। ঢাকা মেডিক্যাল থেকে এম বি বি এস পাশ করে উচ্ শিক্ষার জন্য ১৯৬৫ সালে লন্ডনে গিয়েছিলেন তিনি। এফ আর সি এস একবারেই শেষ পর্যায়ে ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো। পড়ার টেবিলে বসতে পারতেন না। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের প্রবল তাড়না তাকে লন্ডন ছাড়তে বাধ্য করলো। তিনি দেশের চরম সংকটে সত্যিকারের সারথী হয়ে বীরের মত হাজির হলেন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেয়ার জন্য গড়ে তুললেন বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল যেটি বর্তমানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে পরিচিত। ইংল্যান্ডের রাজকীয় সুযোগ সুবিধাকে পদদলিত করে দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ইংল্যান্ডে তার বিমান চালানোর লাইসেন্স ছিল এবং তিনি বিমান চালিয়েছেন। রাজ পরিবারে সদস্যরা যেখান থেকে পোষাক অর্ডার করতো সেখানেই তৈরি হতো ডাঃ জাফরউল্লার পোশাক। এমন সব প্রাপ্তিকে তিনি মূহূর্তেই বিসর্জন দিয়ে দিলেন দেশের জন্য। মুক্তিযুদ্ধে তিনি শুধু হাসপাতাল করেই দায়িত্ব শেষ করেন নি, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, রণ কৌশল শিখিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি উসমানীর সাথে একই হেলিকপ্টারে ডাঃ জাফরউল্লা সঙ্গী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন রনাঙ্গনের বীর সেনা।
মুক্তিযুদ্ধের পর ইচ্ছা করলেই তিনি উন্নত কোন দেশে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু প্রবল দেশপ্রেম তাকে নিবৃত করে। স্বাধীনতা লাভের পর দেশের নাজুক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তিনি ছিলেন নিবেদিত। তিনি আওয়মীলীগ করতেন না, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর একজন শুভাকাঙ্খি হিসাবে সৎ ও সঠিক পরামর্শ দিতেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভায়ও তার সুযোগ তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু নির্লোভ ও নির্ভিক এই মহান ব্যক্তিত্ব সেই সুযোগ গ্রহন করেন নি। পদ পদবী না নিয়েও যে দেশের মানুষের সেবা করা যায় সেটার অনন্য নজীর স্থাপন করেছেন ডাঃ জাফরউল্লা। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে মানুষের সেবা করার জন্য ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট, ক্ষমতায় বসার প্রয়োজন হয় না। তিনি সবার কাছেই প্রিয় ছিলেন তার নির্লোভ চরিত্রের জন্য। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাকে মন্ত্রী হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সেটাও তিনি নেন নি। হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ তাকে মন্ত্রীত্ব দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু ডাঃ জাফরউল্লাকে রাজি করাতে পারেন নি। পদ পদবী, মন্ত্রীত্বের জন্য মানুষ যখন মরিয়া তখন তিনি জনগণের জন্য দিল দরিয়া। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশ গঠনে উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে ডাঃ জাফরউল্লার। দেশের বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজের জন্য তিনি দেশের বাইরে বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিতে থাকেন। তিনি ৫০ টির বেশি দেশে বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। জাতীয় ঔষধ নীতি প্রণয়নে নিজ দেশে যেমন ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন তেমনি অন্যান্য দেশকেও পরামর্শ দিয়েছেন। তার লেখা বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হতে থাকে। ১৯৮২ সালে তিনি জাতীয় ঔষধ নীতি প্রণয়নে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিলেন। দেশেই ঔষধ উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করে দেশীয় ঔষধ কোম্পানীকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। জাতীয় ঔষধ নীতিতে তার অবদানের কারণেই ঔষধের দাম অনেকাংশে কমে আসে এবং বিদেশী ঔষধের প্রতি নির্ভরতা কমে আসে। ডাঃ জাফরউল্লা দেশের গরীব মানুষের কথা ভাবতেন। মানুষ যেন অল্প টাকায় ঔষধ পেতে পারে সেজন্য সারা জীবন কাজ করে গেছেন। স্বাস্থ্য সেবাকে তিনি সাধারণ মানুষের দৌড়গোড়ায় পৌছে দিয়েছিলেন। আজ বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশে ঔষধ রপ্তানি করছে। কিন্তু এর পিছনের মানুষটির খোঁজ আমরা কজন রাখি? আজ ঔষধ শিল্পের যে অভুতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে সেটার মূল কারিগড় ছিলেন জাফরউল্লা। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য আন্দোলনের আইকন ছিলেন তিনি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে প্যারামেডিক কোর্সের ধারণা তিনিই সর্ব প্রথম দিয়েছিলেন। ডাঃ জাফরউল্লা বহমাত্রিক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, কিন্তু কখনোই সেগুলি থেকে কোন ব্যাবসায়ী সুবিধা তিনি গ্রহন করেন নি। তার প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে খুব অল্প টাকায় মানুষ সেবা পায়। অন্যান্য হাসপাতালে সেবা নিতে যখন গলদঘর্ম হতে হয় রোগীদের তখন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সত্যি যেন এক স্বস্তির নিঃশ্বাস রোগীদের জন্য। ১৯৯১ সালে ন্যাশনাল হেলথ পলিসির সাথে তিনি যুক্ত থেকে চিকিৎসা সেবার বহুমাত্রিক উন্নয়ন সাধন করেন। দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে তার অবদানের কথা সবাই জানে। ছেলে হোক, মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট — এই স্লোহানটির রূপকার ছিলেন তিনি। মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য সেবার প্রতি ডাঃ জাফরউল্লার বিশেষ নজর ছিল। তিনি নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন।
ডাঃ জাফরউল্লার অবদানের জন্য তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয় ১৯৯৭ সালে। এছাড়াও ম্যাগসাইসাস পুরস্কার তিনি অর্জন করেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে অনেক পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি পেয়েছেন তিনি মানুষের কাছ থেকে। আর সেটি হল সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা। তুখোর মেধাবী জাফরউল্লা ঢামেকে থাকা অবস্থায় বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে ছাত্র সংসদের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি আর রাজনীতিতে সক্রিয় হোন নি। তবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন। গণ মানুষের অধিকার আর গণতন্ত্রের জন্য লড়ে গেছেন সাহসের সাথে। দেশে যখনই কোন বড় অন্যায় হয়েছে তিনি সেটার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। হুইলচেয়ারে বসেও তিনি গণ মানুষের আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশের বড় দুটি দলের সাথেই তার ভাল সম্পর্ক ছিল। ২০১৮ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনে তিনি সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বি এন পি সরকারের সাথে সংলাপে বসেছিলো যার মূল কারিগর ছিলেন ডাঃ জাফরউল্লা। ডাঃ জাফরউল্লা এমন এক ক্যারেজমেটিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি কখনই রাষ্ট্র থেকে কোন আইন বর্হিভূত সুযোগ গ্রহন করেন নি। ব্যক্তি স্বার্থকে তিনি কখনোই বড় করে দেখতেন না। দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তিনি অনেক প্লাটফর্মে সাহসী বক্তব্য রেখেছেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সকল ধরণের আন্দোলন সংগ্রামে তিনি যুক্ত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি যুক্ত থেকেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন একটি দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা এবং সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা অপরিহার্য। রাজনীতি না করেও তিনি রাজনীতির মাঠে সরব ছিলেন। কোন দলীয় তকমা তাকে স্পর্শ করতে পারে নি, তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন। প্রকৃতির নিয়মেই তাকে চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু ২০২৩ সালে একটি সুষ্ঠ নির্বাচনের স্বপ্ন তিনি দেখতেন। তার সেই স্বপ্ন কি সত্যি আলোর মুখ দেখবে?