ফেলে আসা দিন গুলো-৩৩

// এবাদত আলী

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ রাতের বেলা পাবনা পুলিশ লাইন্সের পুলিশ বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে তুমুল লড়াই চলতে থাকে। তখন যার যা ছিল অর্থাৎ টুটুবোর, গাদা বন্দুক ইত্যাদি নিয়ে ইছামতি নদীর পাড়, জামতলা, জজ সাহেবের বাংলোর পাশে, বাণী সিনেমা হলের উত্তরে ইত্যাদি স্থানে ছাত্র জনতা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ঘায়েল করার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে এবং গুলি ছুড়তে আরম্ভ করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তখন পাবনা হেড পোষ্ট অফিস, জজ কোর্ট, সদর সাব রেজিষ্টারী অফিস ও কালেক্টরেট ভবনের পাশ থেকে পুলিশ লাইন্সের পুলিশদেরকে লক্ষ করে গুলি চালিয়ে যাচ্ছিলো।
এ দিকে ভোর না হতেই পাবনার চারিদিকে এই যুদ্ধের খবর ছড়িয়ে পড়ে। আমরা সাথে সাথে চোঙ দ্বারা লোকজনকে আহ্বান জানাই এবং পাশা পাশি বেল বা ঘন্টি বাজানো হয়। আমরা একত্রিত হয়ে পাবনা শহরের দিকে রওনা হই। ভোর হতে না হতেই পাবনা সদর মহকুমার বিভিন্ন থানার সাধারণ মানুষ লাঠি, ফালা সড়কি, ঢাল, তলোয়ার, হাসুয়া ইত্যাদি নিয়ে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে পাবনা শহরের দিকে এগুতে থাকে।
হাজার হাজার জনতা পুলিশ লাইনে সমবেত হয়। পাকিস্তানি আর্মিরা জজকোর্ট ও পোষ্ট অফিস থেকে পাবনা পুলিশ লাইন্সের পুলিশদের উপর আক্রমন করে চলেছে, পুলিশ লাইন্সের আর আই আবুল খায়েরের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী প্রাণপণ লড়াই করে চলেছে। সাধারণ জনতার মধ্য থেকে রফিকুল ইসলাম বকুলসহ স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর যোদ্ধারা অতি সাহসি মনোভাব নিয়ে সামনের দিকে এগুতে থাকে। এ সময় পাকিস্তানি আর্মিদেরকে ধনুকের তীর দ্বারা আঘাত হানতে গিয়ে অজ্ঞাতনামা এক যুবক শহীদ হয়।
জজ সাহেবের বাড়ীর পাশে বেশ বড় ধরনের একটি ড্রেনের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বকুলসহ অনেক স্বেচ্ছাসেবিরা অগ্রসর হতে থাকে। এসময় পাবনা পৌরসভা এবং আমজাদ সাহেবের বাড়ির মাঝখানের রাস্তার উপর দিয়ে মিলিটারিদের একটি জিপ গাড়ি আসছিলো দেখে রফিকুল ইসলাম বকুল কর্তৃক হাতের টুটুবোর দিয়ে ফায়ার করা মাত্র সামনের কাঁচ ভেঙ্গে ড্রাইভার আহত হয় এবং জিপটি উল্টে খাদে পড়ে যায়। জিপে থাকা পাকিস্তানি আর্মিরা দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। পুলিশ লাইন্সের যুদ্ধ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়।
আর, আই, আবুল খায়ের স্বেচ্ছাসেবক দেরকে নিয়ে গিয়ে পুলিশ লাইনের ভিতরের অবস্থা দেখান। এ সময় রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে পাবনা জেলখানার তালায় গুলি করে তালা ভেঙ্গে ফেলা হলে কয়েদীরা মুক্ত হয়ে বাইরে চলে আসে। ডান্ডাবেড়ি পরানো কয়েদীর ডান্ডা ঝন ঝন শব্দ হতে থাকে। তখন পাবনার ম্যাগজিন রুম খুলে দেওয়া হলে স্বেচ্ছাবেসী যুবক ও জনসাধারণের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। আমাদের কয়েকজ স্বেচ্ছাসেবীর হাতে ৩০৩ রাইফেল ও পর্যাপ্ত গুলি চলে আসে।
ততক্ষণে পকিস্তানি আর্মি পাবনা পিসিও বা পাবলিক কল অফিস অর্থাৎ টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে আশ্রয় নিয়ে আছে। এ খবর পাবার পর সংগ্রামী জনতা তাদের উপর চারিদিক থেকে আক্রমণ করে বসে। বিভিন্ন স্থান থেকে পাকিস্তানি আর্মিদের উপর ব্যাপকভাবে হামলা করা হয়। তাদের উদ্দেশ্যে পেট্রোল বাল্ব ছুঁড়ে মারা হলে ভয়ে তারা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জানালা দিয়ে গুলি চালাতে থাকে।
এ সময় গোবিন্দা মহলল্লার রহিম ব্ল¬্যাকার (বাণী সিনেমা হলের টিকেট ¬ব্ল্যাককারি) আম গাছ বেয়ে ছাদে উঠে সেখান থেকে একটি এস এম জি নিয়ে আসে। চাইনিজ এস এম জি টি তার কাছ থেকে নিয়ে ঝংকারের মালিক হাবুল ভাই বাণী সিনেমা হলের ছাদে পেতে গুলি চালাতে থাকে। রফিকুল ইসলাম বকুল ও ইকবালের হাতে টুটুবোর এবং অন্যান্যদের কাছে ছিল ৩০৩ রাইফেল। এক সময় পেট্রোল বাল্ব ছোড়া হলে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের জানালায় আগুন ধরে যায়। যে সকল পাকিস্তানি সেনা গুলি করতে করতে বারান্দায় এসেছিল তারা তখন ভয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এ সময় বারান্দায় পেতে রাখা অপর একটি এস এম জি বকুল তার নিজের দখলে নিয়ে নেয়। এরপর অন্যান্য বন্দুকের গুলির পাশাপাশি দুটো এস এম জি গুলির আক্রমণে খান সেনারা ব্রাশ ফায়ার করতে করতে ইছামতি নদীর পাড় দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। এ সময় গোপালপুরের গুনাইয়ের বাপ তাদেরকে লাঠি নিয়ে মারতে গেলে তাকে লক্ষ করে গুলি ছুড়লে সে নিহত হয়।
তখন চারিদিক থেকে সাধারণ মানুষ পাকিস্তানি আর্মিদেরকে ঘিরে ফেলে এবং লাঠি ফালা ও অন্যান্য অস্ত্র শস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তাদেরকে হত্যা করে। অবস্থা বেগতিক দেখে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অভ্যন্তর হতে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর সদস্যরা চিৎকার করে বলতে থাকে “ইহাপর কুই ইপি আর সোলজার হায়? ইহাপর কুই পুলিশ হায়, হামলোক সারেন্ডার করনা চাহতা হায়”। কিন্তু কে শোনে কার কথা যে যেভাবে পারলো তাদেরকে হত্যা করলো। সেখানে প্রায় ২৮/৩০ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। এর পর হাজার হাজার জনতা স্বতঃস্ফুর্তভাবে পাবনা শহরে মিছিল বের করে জয় বাংলা ধনি দিতে থাকলে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।
এই দিন ময়লা গাড়ীর নিকটে মুসলেম প্রাং এর তেমাথায় আরেকটি যুদ্ধ হয়। সেখানে বুলবুল, খুকু ও রশিদসহ একদল মুক্তিকামি যোদ্ধা অংশগ্রহণ করে। বিকাল ৪টা থেকে সারা রাত থেমে থেমে যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে সুজানগর থানার বাসিন্দা পাবনা ইসলামিয়া কলেজের দ্বাদশ মানবিক বিভাগের ছাত্র শামসুল আলম বুলবুল সহ বেশ ক’জন যোদ্ধা শহীদ হয়।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সুচনালগ্নে ২৮মার্চ পাবনা শহরের সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত এক দল পাকিস্তানি সৈন্য কাশিপুর শিল্প নগরী হতে পায়ে হেঁটে রাজশাহীর দিকে পালিয়ে যাবার সময় রাতের বেলা পথ হারিয়ে ২ জন সৈন্য দলছুট হয়ে শহরের অদুরে বালিয়াহালট গোরস্থানে লুকিয়ে থাকে। পরদিন সকাল বেলা স্থানীয় লোক জন তাদের দেখে ফেলে এবং জনতা এক জোট হয়ে তাদেরকে ঘিরে ফেলে। তারা আত্মসমর্পণ করার জন্য বার বার আকুতি জানায়। কিন্তু হানাদার বাহিনীর আকুতি গ্রাহ্য হয়না। তাদের দু জনকেই হত্যা করা হয়।
অপর সৈন্যরা রাতের বেলা পাকা সড়ক ধরে না গিয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে পালাবার সময় পথ ভুল করে পাবনা শহর থেকে ৬ মাইল পশ্চিমে মালিগাছা ইউনিয়নের টেবুনিয়া বাজারের অদূরে মজিদপুর জিয়াল গাড়া বিল নামক স্থানে একটি গমের ক্ষেতে আশ্রয় নিয়ে লুকিয়ে থাকে। পর দিন ২৯ মার্চ ভোর বেলা জোতকলসা গ্রামের কৃষক গহের আলী শেখ গম খেতের মধ্যে প্রাতঃক্রিয়া সারতে গেলে তিনি পাকিস্তানি মিলাটারিদেরকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে লোক জড় করতে থাকলে সৈন্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। । (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।