বাংলা সাহিত্যে রেনেসাঁর কবি নজরুল

// মাজহার মান্নান ,কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

        '' ক্ষুরধার লিখনী তোমার
          হে প্রিয় কবি নজরুল
       শোষণের বিরুদ্ধে ছিলে সোচ্চার
          ফুটিয়েছো হুল।''

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের এই বিদ্রোহী কবি ১৮৯৯ সালের ২৫ মে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, দার্শনিক, সাংবাদিক, সম্পাদক ও রাজনীতিবিদদের একজন। তার কবিতায় বিদ্রোহী মনোভাবের কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নজরুলের কবিতা বাংলা সাহিত্যে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে কারণ তার কবিতা সামাজিক শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। নজরুলের কবিতার চরণগুলি যেন এক জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ। শোষকের স্বরুপ উম্মোচনে নজরুলের কাব্য যেন আরো মূর্ত হয়ে উঠে যখন তিনি লিখেন, ” যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্তে তাদের সর্বনাশ।” তিনি সর্বদা শোষণ, নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং তাঁর কলম সর্বদা সত্যের পক্ষে। তিনি লিখলেন, ” ক্ষুধার জ্বালায় মরেছি, সুধার কলস থাকিতে ঘরে, দারিদ্র ঋণ অভাবে জ্বলেছি, না চিনে পরস্পরে।” তিনি সর্বদা ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি লেখার জন্য কারাবরণ করেন এবং কারাগারে থাকাকালীন তিনি ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ রচনা করেন যা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম। কোন জুলুম, কোন অত্যাচার, জেল তাকে থামাতে পারে নি। নজরুলকে নিয়ে গর্ব করে লিখতে পারি—” জেল দিয়েও থামাতে পারেনি তোমার লিখনী শক্তি/
তোমার কাব্যে ব্যক্ত হয়েছে সাধারন মানুষের মুক্তি।”
আনন্দময়ীর আগমনের কয়েকটি চরণ বৃট্রিশ শাসনের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। কি লিখেছিলেন কবি। কাব্য রূপে এমন প্রতিবাদ করা যায় সেটা তো নজরুল আমাদের দেখালেন। তিনি লিখলেন, ” আর কত কাল থাকবি বেটি মাটির ঢিবির মূর্তি আড়াল, স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চারাল, দেব শিশুদের মারছে চাবুক বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি, ভূ ভারত আজ কসাইখানা আসবি সর্বনাশী।” এই চরণগুলি উপনেবেশিক শোষনের মূলে কুঠারাঘাত। নজরুলের সাহিত্যকর্ম সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাকে ঘৃণা করে এবং তার সাহিত্যকর্মে প্রেম, মানবতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিশ্বজনীনতা, মুক্তি ও বিদ্রোহের প্রাধান্য রয়েছে। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার এবং শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে লিখেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন ধারার জন্ম দেন এবং তা হল ইসলামিক সঙ্গীত বা গজল এবং এর পাশাপাশি তিনি অনেক চমৎকার শ্যামা সঙ্গীত এবং হিন্দু ভক্তিমূলক গান রচনা করেন। নজরুল প্রায় তিন হাজার গান রচনা করেছেন এবং অধিকাংশ গানের সুরকার ছিলেন তিনি নিজেই। নজরুল এমন একজন কবি ছিলেন যিনি মানব চরিত্রকে গভীরভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তার কাব্যে দেখিয়েছেন যে মানুষ একে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চায় এবং অন্যের খুঁত ধরতে মরিয়া হয়ে উঠে। তিনি লেখেন, ” আমরা সবাই পাপী, আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি।”

তিনি ভারত জুড়ে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখেছিলেন যা সারা ভারতে অনুরণিত হয়েছিল। নজরুল ইসলাম ১৯২২ সালে ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এবং স্বরাজ গঠনে সশস্ত্র বিপ্লবের উদ্ভবে ধূমকেতুর বিশেষ অবদান ছিল। ১৯১৭ সালের রাশিয়ান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। কামাল পাশার দ্বারা নজরুলের চিন্তা ও অনুভূতি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, ও কুসংস্কারের প্রতিবাদে নজরুলের কবিতা ছিল সর্বদা দিকদর্শী। বাংলা সাহিত্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আগমন নায়কের মতো এবং তার কবিতা, গান, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। নজরুলের কাজ আজও বাঙালি মুসলমানদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে, এবং নজরুল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ হয়ে উঠেছেন। তাঁর অগ্নিবীণা গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই ছিল মুসলিম বাঙালিদের জীবন, দর্শন ও চিন্তাধারা নিয়ে লেখা ইসলামী কবিতা।

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক কবি যার কবিতায় সব সময়ই অগ্নি কণ্ঠে উচ্চারিত হত দরিদ্রের কথা, শোষিতের কথা ও নিপীড়িতদের কথা। তিনি সব সময় শোষিত-বঞ্চিত মানুষের পক্ষে লিখেছেন, প্রতিবাদ করেছেন বলিষ্ঠ কণ্ঠে। তিনি লিখেন, ” তোমরা থাকবে তেতলার পরে, আমরা থাকিবো নিচে, অথচ তোমায় দেবতা বলিবে, সে কথা আজ মিছে।”ইসলামী ঐতিহ্য ও মুসলিম সুফিবাদ তাঁর সাহিত্যে অনন্য স্থান দখল করে আছে। তাঁর কবিতা আধ্যাত্মবাদ এবং ইসলামী সাম্যকে ধারণ করে, এবং তিনি সর্বদা মুসলমানদের জন্য অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। তিনি লিখেন, ” চরণ ফেলি গো মরণ ছন্দে, মথিয়া চলি গো প্রাণ, মর্তের মাটি মহীয়ান করি, স্বর্গেরে করি ম্লান।” তাঁর গান ও কবিতা যুগ যুগ ধরে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তিনি শোষিত জাতিকে শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং তিনি লিখেছেন ‘বলো বীর, বল চির উন্নত মম শির’। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন মানবতাবাদের কবি তাই তিনি সকল ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে মানবতাবাদ ও সত্যের জয়গান গেয়েছেন। ধর্মের বিভেদ শুধু হানাহানি ডেকে আনে। তাইতো কবি এর বিপক্ষে। ” গাহি সাম্যের গান, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে, সব বাধা ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু- বৌদ্ধ -মুসলিম -ক্রিশ্চান।” তিনি তাঁর কবিতায় স্পষ্ট দেখিয়েছেন যে, মানুষের চেয়ে মহৎ আর কিছু নেই। কাজী নজরুল ইসলাম এমন একজন কবি ছিলেন যার কবিতায় দেশপ্রেম ফুটে উঠেছে এবং যিনি জাতীয়তাবাদের চেতনা মনে প্রাণে ধারণ করতেন। তার কবিতায় ফুটে উঠেছে, মুক্ত কণ্ঠে স্বাধীন বিশ্বে উঠিতেছে একতান, জয় নিপীড়িত প্রাণ, জয় নব অভিযান, জয় নব উত্থান।” তিনি ১৯১৭ সালে করাচিতে যান এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার ইচ্ছা থেকে যুদ্ধে যোগ দেন এবং তাঁর প্রধান স্বপ্ন ছিল ভারতকে স্বাধীন করা। তিনি তার অনেক লেখায় বলেছেন, সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীন করার বিকল্প নেই। তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি সংগ্রাম শুরু করেন এবং প্রতিবাদী কবিতার একটি সিরিজ প্রকাশ করেন এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তার নেতৃস্থানীয় ভূমিকার জন্য বেশ কয়েকবার কারাবরণ করেন। নজরুল নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করেছিলেন যে উপমহাদেশের কৃষকেরা সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার। জমিদারি প্রথার জাঁতাকলে পিষ্ট কৃষক না খেয়ে দিনতিপাত করতো। কৃষকের পক্ষে তিনি কলম ধরলেন, ” গাহি তাহাদের গান, ধরণীর হাতে দিলো যারা আনি ফসলের ফরমান।” তিনি সর্বদা সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিকতা ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন এবং কলম ধরেছেন। তার কলমে উঠে এসেছে, ” মহা মানবের মহা বেদনার আজি মহা উত্থান, উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান।” তিনি কোনো ধরনের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অপব্যাখ্যায় বিশ্বাস করতেন না। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িকতার মহান কবি এবং তাঁর লেখায় বাংলার নবজাগরণের কথা বলা হয়েছে। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, নজরুলের ধূমকেতু পত্রিকা কংগ্রেসের সামনে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেছিল। তিনি মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার কথা ভাবতেন এবং তার কবিতায় তা লিখেছেন। নজরুল অনুভব করেছিলেন যে সাহিত্য শুধুমাত্র অভিজাত বা শিক্ষিতদের জন্য হতে পারে না এবং তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বাধীনতার সাথে সামাজিক বিপ্লবের ধারণাকে মিশ্রিত করেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম ভারতে অসহযোগ আন্দোলনের সময় নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখতে থাকেন। নজরুল এমন একজন কবি ছিলেন যিনি কখনই অর্থ সম্পদ, বিত্ত বৈভবের কাছে নিজেকে সঁপে দেন নি। তিনি কারো মোসাহেবী করেন নি। পয়েকটিক জাস্টিসে তিনি বিশ্বাস করতেন। চাটুকারদের তিনি অবজ্ঞা করেছেন তার লেখনীতে। ” সাহেব কহেন, সেদিন বৃষ্টি ছিল অল্প, মোসাহেব কহেন, বাহ! কে বা শুনেছে এমন অপরূপ গল্প।”

নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্য ও ভাষায় একটি নতুন ধারার সূচনা করেন এবং সফলভাবে আরবি, ফারসি এবং অন্যান্য ভাষার সাথে বাংলা শব্দের সমন্বয় ঘটান। তিনি সাম্যের জয়গান করেছেন। মানুষের সাথে মানুষের সমতার কথা বলেছেন। নারী পুরুষের সমতার কথা বলেছেন। তিনি লিখলেন, ” পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ, কামিনী এনেছে যামিনী শান্তি, সমীরন বারিবাহ।”তিনি ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত এবং লোকসংগীতের একটি দুর্দান্ত সমন্বয় করেছিলেন। তার মতো অসাম্প্রদায়িক কবি হাজার বছর ধরে বাংলা সাহিত্যে দেখা যায়নি। তার লেখা কখনোই ধর্মীয়ভাবে পক্ষপাতদুষ্ট নয়, বরং হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের ঐতিহ্যকে সমান্তরাল করেছে। তিনি লিখলেন, ” তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব, সকল কালের জ্ঞান, সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখো নিজ প্রাণ।” নজরুল ইসলাম বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছেন এবং তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানরা বাংলা সাহিত্যের মূলধারায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। বাঙালি মসলিনকে একত্রিত করতে নজরুল ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। নজরুলের কাব্য তরুণ মনে ঝাঁকুনি তুলেছিলো। যুব শক্তিকে অনুপ্রানিত করতে তার কাব্য এক মহীরুহের ভূমিকা পালন করে। তার কলমে রচিত হয়– ” ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রলয় নতুন সৃজন বেদন, আসছে নবীন জীবনহারা অসুন্দরের করতে ছেদন।” নজরুলের কাব্যের মূল হল মানুষ। তিনি মনে করতেন মানুষের চেয়ে মহীয়ান জগতে কিছু নেই। মানুষের হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির বা কাবা নেই। নজরুল লালনের সাম্যবাদ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। দীপ্ত হাতে নজরুল লিখলেন– ” সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি/ এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোন এক মিলনের বাঁশি।”

মুসলিম নবজাগরণে নজরুলের অবদান ছিল সত্যিই অসামান্য। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ২২ বছর বয়সী কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে লিখেছিলেন এবং আজ সেই কবিতার ১০০ বছর পূর্তি উদযাপিত হয়েছে। তাঁর কাব্যশক্তির সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে এই কবিতায় এবং এই কবিতাটি দাঁড়িয়েছিল উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। আশ্চর্যজনক যে, অসীম দক্ষতায় এই কবিতায় বিভিন্ন পুরাণের নির্যাস সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এই শতবর্ষী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা যুগের পর যুগ শোষিত-বঞ্চিত মানুষের জন্য উৎস হিসেবে কাজ করবে। একজন যোদ্ধার, একজন বিদ্রোহীর মনের কথা ফুটে উঠলো নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায়। ”আমি মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।” নজরুলের সৃষ্টি একদিকে যেমন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি একই সঙ্গে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুক্তি ও সংগ্রামের পথের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নজরুলের অবস্থান ছিল অকুতোভয় বীরের মত। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবকে তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন। তার রচনায় সেটার প্রতিফলন দেখা যায়। ” তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বৈশাখীর ঝড়।” নজরুল ইসলাম তাঁর লেখালেখি জীবনে অনেক নির্যাতন ও কারাবরণ সহ্য করেছেন, তবুও তিনি আশা ছাড়েননি এবং আরও সাহস নিয়ে তিনি লিখতে শুরু করেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম তুলে নেন। শ্রমিক, দিনমজুর, কুলি, জেলেদের নিয়ে তিনি অনবদ্য কাব্য রচনা করেছেন। ” দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে, চোখ ফেটে এলো জল, এমন করে কি জগত জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল? ” কোন হুমকি বা নির্যাতন তাকে তার অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি এবং তিনি তার জীবনের শেষ পর্যন্ত অবাধে লিখতে থাকেন। কোন হুমকি বা অত্যাচার তাকে তার অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি এবং তিনি তার জীবনের শেষ অবধি স্বাধীনভাবে লেখালেখি করতে থাকেন। মানুষের লোভ লালসাকে তিনি ঘৃণা করতেন। লোভের কারণে মানুষ দানব হয়ে উঠে। লোভের যাতনায় মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তিনি লেখেন, ” বন্ধু, তোমার বুক ভরা লোভ, দু চোখে স্বার্থ ঠুলি, নতুবা দেখিতে তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।” নজরুল বিশ্বাস করতেন শ্রমজীবিদের শ্রমের বিনিময়ে সভ্যতা গড়ে উঠেছে। নব নব সভ্যতার তারাই চালিকা শক্তি। সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের কবি তিনি। শ্রেণি সংগ্রামে বিশ্বাস করতেন নজরুল। এক্ষেত্রে তিনি কার্ল মাকর্সের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সর্বহারাদের প্রতি কবির মমত্ববোধ প্রকট। শ্রমিকদের নিয়ে তিনি লিখলেন-” সিক্ত যাদের সারা দেহ মন, মাটির মমতা রসে/ এই ধরণির তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে।”

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু গতানুগতিক ধারায় কাব্য লিখে যান নি। তিনি কাব্যের ব্যাকরণ, ছন্দ, মাত্রা, লয়, অনুপ্রাস, অলঙ্করণ সব কিছু নিখুঁতভাবে অনুসরন করেছেন। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে চরম মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি। যদিও মাত্রাবৃত্ত ছন্দের আবিস্কার করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু এই ছন্দের বহুমাত্রিক ব্যবহারে পান্ডিত্য দেখান নজরুল। ৪+৪ মাত্রার মাক্রাবৃত্ত তার ‘ আনোয়ার ও মোহরম ” কবিতা এই ছন্দের অনন্য দৃষ্টান্ত। এছাড়াও স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দে দারুন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি। মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রথম উদ্ভাবক তিনি। তার বিদ্রোহী কবিতাটি মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। তার আগমনী কবিতা ৬ মাত্রার মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। ধুমকেতু কবিতায় তিনি অক্ষরবৃত্ত ছন্দের পান্ডিত্য দেখিয়েছেন। ছান্দসিক কবি নজরুল ছন্দের তালে তালে শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। পাঠক হৃদয় একদিকে যেমন ছন্দে পুলকিত হয়েছে, অন্যদিকে তার ঝাঁঝালো শব্দচয়ন তাদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনুপ্রানিত করেছে। আর এখানেইতো একজন কবির প্রকৃত অর্জন। কাজী নজরুলের জীবন ছিলো সংগ্রামময়। তিনি ধনীর দুলাল ছিলেন না। কঠোর সাধনায় তার উত্থান হয়েছে। দারিদ্রের কষাঘাতে পিষ্ট হয়েছেন তিনি। কিন্তু দারিদ্র্যকে তিনি কষ্টের সোপান হিসাবে না নিয়ে তার সংগ্রামী চেতনার চালিকা শক্তি হিসাবে নিয়েছিলেন। তিনি লিখলেন, ” হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান, তুমি মোরে দানিয়াছো খ্রিষ্টের সম্মান।” আমরা যদি সত্যিকার অর্থে নজরুলের কাজকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারি, তাহলে আমরা দিনের আলো দেখব এবং আমরা একটি শুদ্ধ ও সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে পারব। চেতনায় নজরুলকে ধারণ করতে হবে। ভুপেন হাজারিকার একটি জনপ্রিয় গানের কলিতে চমৎকারভাবে চিত্রিত হয়েছে– ” হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় নজরুল।” নগন্য একজন কবি হিসাবে বলতে চাই–
তোমার নিপুন হাতে
রচিত হয়েছে শত গীতি
সুরের ঝংকারে তৈরি করেছো
বিশ্ব সম্প্রীতি।