// ইকবাল কবীর রনজু, চাটমোহর (পাবনা)
প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়ের কন্ঠে “আমি মেলা থেকে তাল পাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি, বাঁশি কই আগের মতো বাজেনা, মন আর তেমন যেন সাজে না, তবে কি ছেলে বেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি” এ গানটি অনেকে অনেক বার শুনেছেন। শুধু এ গানটিই নয় তাল পাখা নিয়ে রচিত এমন অনেক গান, কবিতা আমাদের সাহিত্যে স্থান করে নিলেও আধুনিকতার প্রভাবে সে সাহিত্য এখন ইতিহাসের অংশ হবার উপক্রম হয়েছে। কালের বিবর্তনে তাল পাখার প্রয়োজনীয়তা কমলেও এখনো এ শিল্প বিলুপ্ত হয়নি। আসন্ন পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে ব্যস্ততা বেড়েছে চাটমোহরের পাখা পল্লীর কারিগরদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফাল্গুন থেকে ভাদ্র এ সাত মাস আমাদের দেশে অধিক গরম অনুভূত হয়। প্রচন্ড গরমে স্নিগ্ধ শীতল বাতাসের পরশ দিতে পাবনার চাটমোহরের মহেশপুর, হিয়ালদহ, ছোটগুয়াখরাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের তালপাখা তৈরির কারিগররা পাখা তৈরী ও বিক্রি করেন। লোডশেডিং এর সময় যখন বৈদ্যুতিক পাখা বন্ধ থাকে তখন গরীবের একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে তালের পাখা।
এক সময় চাটমোহরের মহেশপুর গ্রামের দেড় শতাধিক পরিবারের আয়ের উৎস ছিল তাল পাখা তৈরী। গ্রামটি পরিচিতি লাভ করেছিল ‘তালপাখার গ্রাম’ হিসেবে। গরম কালে তালের পাখা বিক্রি করে বাড়তি আয় করতো তারা। গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে পাখা তৈরী করতো। বাড়ির বৌঝি, ছেলে মেয়েরা তাদের এ কাজে সহায়তা করতো। শীতকালে কেউ রিক্সা-ভ্যান চালাতো, কেউ সেলুনে কাজ করতো, কেউ শহরে যেত কাজের সন্ধানে, কেউবা দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে অন্যের বাড়িতে শ্রম বিক্রি করতেন। ঠিক কবে থেকে এ গ্রমে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয় এর সঠিক কোনো তথ্য কেউ দিতে না পারলেও পাখা তৈরীর কারিগররা জানান বংশ পরম্পরায় তারা এ কাজটি করে আসছিলেন। কালের বিবর্তনে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
তাল পাখা তৈরীর কারিগর, হিয়ালদহ গ্রামের আবুল কালাম জানান, জ্ঞান বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই তাল পাখা তৈরীর কাজ করে আসছি। একসময় এ গ্রামের আট পরিবার তাল পাখা তৈরীর সাথে যুক্ত থাকলেও এখন দুইটি পরিবার তাল পাখা তৈরী ও বিক্রি করছেন। একই গ্রামের আব্দুল ওয়াহাব ও হাসিনা খাতুন প্রায় ৫০ বছর যাবত তাল পাখা তৈরীর কাজ করে আসছেন। তারা জানান, তালগাছের এক একটি পাতা দশ থেকে বারো টাকায় কিনতে হয়। একটা গাছের কয়েকটি পাতা কাটতে শ্রমিককে দিতে হয় ১০০ টাকা। এছাড়া পরিবহণ খরচও আছে। তালপাতা বাড়িতে আনার পর রোদে শুকিয়ে আবার ছায়ায় ঠান্ডা করতে হয়। তারপর নির্ধারিত মাপে তালপাতা কাটতে হয়। বাঁশের তৈরি কাঁঠির মধ্যে তালপাতা পরিয়ে গুনা দিয়ে আটকাতে হয়। তারপর সুতা দিয়ে সেলাই করতে হয়। সবশেষে রং দিয়ে ইচ্ছামত ফুল, পাখি, গাছপালার ছাপ দেওয়া হয় তাল পাখায়। বর্তমান প্রতিটি তালপাখা পাইকারী ১০ থেকে ১২ টাকা করে বিক্রি করছেন তারা। এলাকার পাখা ব্যবসায়ীরা গঙ্গা ¯œনোৎসব ও বৈশাখী মেলায় বেশি পাখা বিক্রি করেন। পাইকাররা পাখা কিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন। সামনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলা হবে। তাই এসময়ে তালপাখা তৈরির কারিগরদের ব্যস্ততা বেড়েছে।
এলাকাবাসী জানান, চাটমোহরের মহেশপুর, হিয়ালদহ, ছোটগুয়াখরাসহ বেশ কিছু গ্রামে অসচ্ছল পরিবারের সদস্যরা পাখা তৈরীর কাজ করতেন। একসময় অনেকে এ পেশাটির সাথে যুক্ত থাকলেও ক্রমশই সে সংখ্যা কমে আসছে। অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। যারা এ পেশায় এখনো কোন রকমে টিকে আছেন কালের বিবর্তনে তারাও হয়তো এ পেশা ছাড়তে বাধ্য হবেন।