দুর্ভিক্ষ রুচির, নাকি সততার ?

// মাজহার মান্নান , কবি, কলামিস্ট

নাট্য অভিনেতা মামুনুর রশিদ হিরো আলমকে নিয়ে একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে, যার কারণে হিরো আলমের মত ব্যক্তিরা সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়। তার বক্তব্যটি হিরো আলমকে ঘিরে হলেও গভীর কিছু বার্তা আছে তার বক্তব্যে। তবে কিছু দুর্বলতাও তার বক্তব্যে স্পষ্ট। তার বক্তব্যের দুটি অংশ। প্রথমটি হল রুচির দুর্ভিক্ষ এবং দ্বিতীয়টি হল এই দুর্ভিক্ষের ফলে হিরো আলমদের মত ব্যক্তিদের উত্থান। রুচির দুর্ভিক্ষ আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে এবং জীবনাচারে চলছে এটা সত্য। নাট্য জগতে রুচির চরম দুভিক্ষ চলছে। সেটা নিয়ে মামুনুর রশিদ সরব হলে আরো বেশি ভাল হতো। মামুনুর রশিদ গুণীজন হিসাবেই বিবেচিত। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। সমাজের এমন অনেকে আছেন যারা লেবাসের অন্তরালে এমন কোন অন্যায় নেই যে করছেন না। সম্প্রতি নিত্য পন্যের বাজারে যে চরম অস্থিরতা চলছে তার নেপথ্যে কিছু লেবাসধারী মানুষ আছে। এই মানুষ গুলির রুচি নিয়ে মামুনুর রশিদের মত ব্যক্তিরাতো কিছু বলতে পারেন। সেখানে কেন আমরা নিরব? এত দুর্নীতি, এত ভেজাল, এত অনিয়ম? কই এগুলি নিয়ে তো প্রাজ্ঞজনদের মাথাব্যথা দেখি না। তবে হিরো আলম কি প্রাজ্ঞজনদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ালো? কিন্তু কেন? হিরো আলমের অন্যায়টা কি? তার যদি অপরাধ থাকতো তবে তো তার শ্রীঘরে থাকার কথা ছিল। হ্যাঁ, হিরো আলমের ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিত্ব এমন একটি বিষয় যা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। কিন্তু কারও ব্যক্তিত্ব যদি অন্যের ক্ষতির কারণ না হয় তবে সেটা নিয়ে আমাদের এত মাথা ব্যথা কেন? পুঁজিবাদী মানসিকতা থেকে কেন আমাদের শিক্ষিত সমাজ বের হতে পারছে না? স্যার ডাকা নিয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা গলদঘর্ম হচ্ছেন। তাদের স্যার না ডাকলে তাদের ইজ্জত থাকে না, তাদের রুচিতে বাধে, তাদের ব্যক্তিত্বে বাধে। হিরো আলম নির্বাচনের সময় অভিযোগ করেছিলেন তিনি এমপি হলে অনেকে তাকে স্যার ডাকতে চাইবেন না। তাই তাকে নির্বাচনে হারানো হয়েছে। তার অভিযোগ কতটা সত্য তা যাচাইসাপেক্ষ ব্যাপার। একটি জীবন গঠন করতে অনেক কাঠ খড়ি পোড়াতে হয়। তিলে তিলে সংগ্রাম করে জীবন গঠন করতে হয়। জীবন গঠনের কৌশল এবং পদ্ধতির ভিন্নতা রয়েছে। সবাইকে যে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করে বড় হতে হবে এমন কোন কথা নেই। প্রতিটি মানুষ তার সুপ্ত মেধা আর মননের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে থাকে। তবে প্রতিষ্ঠার কোন সুনির্দিষ্ট মানদন্ড নেই। মানদন্ড একটাই, আর সেটা হল একজন মানুষ কতটুকু মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পেরেছে তার জীবনে।

অন্যায়ভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়াকে সমাজ মূল্যায়ন করে না, যদিও এদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এদেশে কাগজ ধারী শিক্ষিতের অভাব নেই। লুটে পুটে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। গরীবের রক্ত চুষে যারা বড় বড় বয়ান ছাড়েন তখন খুব লজ্জা পাই। মনে মনে ভাবি বঙ্গবন্ধু কখনোই এমন বাংলাদেশ চান নি। আপোমর জনতার ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধু নেতা হয়েছিলেন। গরীব দুখীদের হৃদয়ের জায়গা করে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বেঁচে থাকলে অন্য রকম বাংলাদেশ আমরা দেখতাম। যাহোক প্রতিটি মানুষ তার নিজ যোগ্যতা আর কর্ম গুণে বলীয়ান হয়ে থাকে। জর্জ ওয়াশিংটনের মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। তাতে কি আসে যায়। ওয়াশিংটনের মেধা তাকে অনন্য উচ্চতায় পৌছে দিয়েছে। কাজি নজরুল কি সংগ্রাম জীবনে করেছেন, কোথা থেকে উঠে এসেছেন তা সবার জানা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সংগ্রামী জীবন সম্পর্কেও আমরা জানি। এরকম শত শত উদাহরন আছে। সম্প্রতি সময়ের আলোচিত মুখ হিরো আলমের সংগ্রামী জীবন সম্পর্কেও আমরা অবগত আছি। হিরো আলমকে নিয়ে সমালোচনার অভাব নেই। তবে গঠনমূলক সমালোচনার চেয়ে কটু সমালোচনাই বেশি। সমালোচকদের সমালোচনা দেখে মনে হয়, মি. আলমকে পেলে তারা ভর্তা বানাবে। কিছু সমালোচকের আক্রোশের বিস্ফোরন সত্যি আমাকে বিস্মিত করে।

কি অন্যায় মি. আলম করে ফেললো যে তাকে নিয়ে এত অস্বস্তি আমাদের? অনেকে তাকে ভাঁড়, ছ্যাবলা, চানাচুর আলম, ডিশ আলম সহ নানা উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তাকে অসম্মান কম করা হয়নি। কিন্তু মি. আলমের ধৈর্য দেখে সত্যি মুগ্ধ হয়েছি। হিরো আলম সম্পর্কে সমালোচকদের বক্তব্যকে সত্য বলে ধরে নিলাম। কিন্তু হিরো আলমের শ্রেষ্ঠত্বকে কিভাবে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি? টক শোতে একজন অবসর প্রাপ্ত পুলিশ কর্ম কর্তাকে বলতে শুনলাম — হিরো আলম কে নিয়ে কিছু বলতে তার রুচিতে বাধে। কিন্তু কেন? হিরো আলম কি দুর্নীতিবাজ? সে কি রাষ্ট্রের অর্থ পাচারের সাথে জড়িত? সে কি নির্লজ্জ ঘুষখোর? সে কি রাষ্ট্র বিরোধী কোন কাজে জড়িত? সে কি দেশের আইন বিরোধী কোন কাজে লিপ্ত? যদি এমন কিছু হত তবে মিডিয়ার কল্যাণে তা জানা যেত। মি. হিরো একজন ইউটিউবার। তাতে দোষের কি! এমন লক্ষ ইউটিউবার আছে। তাদের নিয়ে কথা হয় না কেন? রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায় থেকে যখন কেউ দুর্নীতি করে, শোষন করে, লুটপাট করে তখন তাদের সম্পর্কে কথা বলতে তো আমাদের রুচিতে বাধা উচিত। যাহোক মি. হিরোর উত্থান নিয়ে কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না, কারণ তা সবাই জানে।

মি. আলম তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের শিকার পরতে পরতে হচ্ছেন। কিন্তু এই তাচ্ছিল্য তাকে ধীরে ধীরে মহান করে তুলছে। হিরো আলমের শিক্ষা নেই, কথা বলতে জানে না, এমন অভিযোগ প্রতিদিন শুনি। কিন্তু বাস্তবতা তা বলে না। নির্বাচনী প্রচারনার সময় তার বিভিন্ন বক্তব্যকে পক্ক মনে হয়েছে। একটি ফাউল কথাও তার মুখ থেকে বের হয়নি। কারও সম্পর্কে বিষেদাগার করতে শুনিনি। যথেষ্ট সংযত আর পরিমিতিবোধ লক্ষ্য করেছি। অথচ অনেক সনদধারী পন্ডিতের মুখের ভাষা শুনে লজ্জায় মুখ ঢেকে নিয়েছি। হিরো আলম এমন একজন ব্যক্তি যাকে ব্যাক থেকে সাপোর্ট দেয়ার কেউ নেই। নিজের দুর্বল দিকগুলো অকোপটে স্বীকার করতে দেখা যায় তাকে। হিরো আলমের ভাল দিকগুলি প্রকাশ করতে আমাদের কতটুকু সদিচ্ছা আছে? আজ পর্যন্ত হিরো আলমের চারিত্রিক দোষ সম্পর্কে খারাপ কিছু শোনা যায় নি। অভিযোগ একটাই সে নাকি ভাঁড়িমী করে। কি আশ্চর্য়! তার চেয়ে হাজার গুন ভাঁড়ামি আমরা রাজনীতিতে দেখি। ভন্ডদের বাহাস দেখে বিচলিত হই। হিরো আলমকেতো কোন ভণ্ডামি করতে দেখি না। মানুষকে সে বিনোদন দেয়। এটাতে খারাপের কি আছে? যার ভালো লাগে সে তাকে গ্রহন করবে। অসুবিধা কোথায়? লেজুরবৃত্তি, দালালি আর তেলবাজিতে যখন রাজনীতির মাঠ সয়লাব তখন হিরো আলমের মত একজন সাহসী তরুন সত্যি আমাদের অনুপ্রেরণা যুগায়।

হিরো আলমকে নিয়ে আমরা হাজারো তামাশা করতে পারি। কিন্তু তার সংগ্রামী মনোবলকে স্যালুট করতেই হয়। হিরো আলম এম পি হতে পারে নি। কিন্তু মানুষের ভালোবাসা সে পেয়েছে। ভোটারদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে। মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়াই নেতৃত্বের বড় গুণ। হিরো আলমকে তো জিরো বানানো গেলো না। কারণ জনগণ তার পাশে আছে। হিরো আলমকে দেশের সব মানুষ চিনে। এটা কি তার কম বড় পাওয়া। আমরা সারাদিন কাঁদলেও মিডিয়া আসবে না আমাদের কথা শুনতে। কিন্তু মি. আলম আজ মিডিয়া ব্যক্তিত্বে পরিনত হয়েছে। মানুষ মানুষের সহযোগিতায় উপরে উঠে। হানিফ সংকেতের আন্তরিকতায় রিকশাচালক আকবর আলী পরিচিত শিল্পীতে পরিনত হয়েছিলো।
মি. আলমের সবচেয়ে বড় গুণটিকে কি আমরা আবিস্কার করতে পেরেছি? তার সবচেয়ে বড় গুণ হল ধৈর্য এবং কোন কিছুর পিছে লেগে থাকা। তবে অসৎভাবে নয়, সৎভাবেই সে সেটা করে যাচ্ছে। সমালোচকদের তীক্ত মন্তব্য শুনেও সে তার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে না। এটা যে তার বড় গুণ। রাষ্ট্রের বড় বড় ডিগ্রিধারীদের যখন লেজুরবৃত্তি করতে দেখি, নির্বিচারে মিথ্যা বলতে দেখি, দুর্নীতি করতে দেখি তখন লজ্জায় মাথা হেট হয়। আর তখন গর্বে বুক ভরে যায় একজন হিরো আলমের জন্য যে সৎভাবে, সাহসিকতার সাথে হাজারো কাঁটা পদদলিত করে এগিয়ে যাচ্ছে। কারো লেজুরবৃত্তি করে নয়, দালালি করে নয়, নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে চলা তরুন হিরো আলম। যতই সমালোচনা থাকুক, হিরো আলম এগিয়ে যাবে। তবে তাকে নিয়ে ততোদিন গর্ব করবো যত দিন সে সৎপথে থেকে লড়ে যাবে।

রুচির দুর্ভিক্ষে হিরো আলমদের উত্থান হয়। মামুন সাহেব মিঃ আলমকে সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন। কিন্তু রুচির দুর্ভিক্ষে কি শুধু হিরো আলমেরই উত্থান হয়েছে নাকি আরো কারো হয়েছে? যদি হয়ে থাকে তবে তাদের নাম মামুন সাহেব উচ্চারন করলেন না কেন? আসলে এখানেই আমাদের অসুবিধা। যার ক্ষমতা আছে, দাপট আছে সে মন্দ হলেও তাকে নিয়ে কথা বলতে আমরা ভয় পাই। আমরা সত্য বলতে চাই কিন্তু পুঁজিবাদী আর শোষণতান্ত্রিক মানসিকতা আমাদের তা করতে দেয় না। মামুনুর সাহেব রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলেছেন। মানলাম তার কথা ঠিক আছে। কিন্তু প্রশ্ন হল এই রুচির দুর্ভিক্ষ যাদের কারণে হল তাদের নাম কেন তিনি বললেন না? রুচির দুর্ভিক্ষতো আর রাতারাতি হয়নি। বেশ সময় লেগেছে। তবে কারা এর নেপথ্যে ছিল? তাদের বিরুদ্ধে কতটুকু তৎপর ছিলেন প্রাজ্ঞজনেরা? যারা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করছে দেশ থেকে তারা কোন রুচির মানুষ? নূন্যতম দেশপ্রেম কি তাদের আছে? আসলে প্রশ্নটি রুচির নয়, প্রশ্নটি হল সততার।

আজ আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সততার, নায্যতার বড় অভাব। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি সব জায়গায় আজ সততার খরা চলছে। বিদ্য লাভ করে যারা আলোকিত মানুষ দাবি করেন তাদের মধ্যেও সততার অভাব প্রকট। যদি সত্যি সততা থাকতো তবে কি দেশে এত দুর্নীতি থাকতো। শিক্ষিতজনেরাইতো দুর্নীতির সাথে বেশিরভাগ জড়িত। আজ খাদ্যে ভেজাল এক মহামারি রূপ ধারণ করেছে। কারা এর নেপথ্যে? হিরো আলম সম্পর্কে যতদুর জানা যায় তিনি তার এলাকার মানুষের বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকেন। তবে অন্যের হক মেরে বা অন্যায় করে টাকা কামিয়ে তিনি তা করছেন তা নয়। নিজের সামর্থ্য থেকে যতটুকু পারছেন করছেন। যিনি ঘুষ খান তিনি কোন রুচির মানুষ? ঘুষখোর, সুদখোর, দুর্নীতিবাজদের সাথে একই মঞ্চে অনেক প্রাজ্ঞজনকে বাহাস করতে দেখা যায়। তখন কি তাদের রুচিতে বাধে না? রুচি এমন একটি শব্দ যেটার সংজ্ঞা দেয়া খুব কঠিন। পরিপাটি পোষাক আর ফিটফাট হয়ে চলাকে যদি রুচি বুঝি তবে সেটা হবে রুচির সবচেয়ে নিকৃষ্ট সংজ্ঞা। সক্রেটিস বলেছিলেন যে ব্যক্তি তার চিন্তা চেতনায় শুদ্ধ তিনি সুরুচির পরিচায়ক। একজন মানুষের রুচি তার সততা, নায্যতা, নিরপেক্ষতা, বিবেকের সাথে জড়িত। যে ব্যক্তির বিবেক নাই তিনি কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তি। একজন অন্যায়কারী কখনই রুচিবান মানুষ হতে পারে না। বড় দালানে বাস করলে, দামি গাড়িতে চড়লে, দামি পোষাক পরলেই সে রুচিবান হয় না। রুচিবোধ চরিত্রের এমন একটি দিক যা একজন মানুষকে বিবেকবান করে তোলে।

রুচির অবক্ষয় আজ চরমে। রুচির অবক্ষয় হয়েছে বলেইতো আজ তরুন প্রজন্ম মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে, ধর্ষণের মত জঘন্য ঘটনা ঘটছে। একজন অন্যজনের বিরুদ্ধে বিষেদাগার করছে। রাজনীতিতে রুচির আজ চরম সংকট চলছে। সেটাতো মামুন সাহেব বললেন না। যাহোক হিরো আলমকে নিয়ে এটাইতো প্রথম মন্তব্য নয়। তাকে অনেক কথাই শুনতে হয়। তবে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে মিঃ আলম আরো বিশুদ্ধ মানুষে পরিনত হোক এটাই কাম্য।