// এবাদত আলী
আখেরী নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর ওফাতের পর দীন ইসলামের ঝান্ডা উড্ডীন রাখার জন্য ওয়ারেছাতুল আম্বিয়া বা নবীগণের ওয়ারেছ হিসেবে এই দুনিয়াতে যুগে যুগে যেসকল ওলি আল্লাহর আবির্ভাব ঘটেছে তন্মধ্যে সৈয়দ মহি উদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানী (র.) সর্Ÿোচ্য মর্যাদার অধিকারি। সেকারণে তাঁকে গাউসুল আজম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
গাউসুল আজম হজরত আব্দুল কাদের জিলানী (র.) হিজরি ৪৭১ সনে পবিত্র রমজান মাসের প্রথম তারিখে বাগদাদের জিলান শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবু সালেহ মুছা জঙ্গী। মাতার নাম সাইয়েদা উম্মুল খায়ের ফাতেমা। তিনি ছিলেন হজরত ইমাম হাসান (রা.) এর বংশধর সৈয়দ আব্দুল্লাহ সাওমেয়ীর কন্যা। যিনি ছিলেন একজন বুজর্গ ও ধার্মিক। হজরত আব্দুল কাদের জিলানী (র.) এর বাল্যকালেই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। কাজেই মাতার নিকট তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। বাল্যকালে যখন তাঁকে শিক্ষা লাভের জন্য মক্তবে ভর্তি করা হয় এবং তাঁকে পবিত্র কোরআন শিক্ষা দানের জন্য তাঁর উস্তাদজী আউজুবিল্লাহ বিসমিল্লাহ পাঠদান করতেই তিনি আউজুবিল্লাহ বিসমিল্লাহসহ সুরা ফাতিহা এবং পর পরই পবিত্র কোরআনের প্রথম আয়াত আলিফ-লাম-মিম-যালিকাল কিতাবুলা রাইবাফিহ সহ বরাবর পাঠ করে যেতে লাগলেন। উস্তাদজী আশ্চার্যান্বিত হয়ে অতি ধৈর্যের সাথে তাঁর তেলাওয়াত শ্রবণ করতে লাগলেন। আঠারো পারা পর্যন্ত গিয়ে হজরত আব্দুল কাদের জিলানী (র.) থেমে গেলেন। হজরত আব্দুল কাদের জিলানীর মাতা উ¤মুল খায়ের ফাতেমা (র.) পবিত্র কোরআনের আঠারো পারার হাফেজ ছিলেন। খোদার কুদরতে হজরত আবদুল কাদের জিলানী (র.) মাতৃগর্ভ থেকেই আঠারো পারা পর্যন্ত কোরআন শরীফ মুখস্ত করেছিলেন।
যে রাতে হজরত আবদুল কাদের জিলানী (র.) ভূমিষ্ঠ হন, সেই রাতে তাঁর পিতা হজরত আবু সালেহ মুছা জঙ্গী তার গৃহে সুললিত কন্ঠের সুমধুর আওয়াজ শুনতে পেলেন, ‘হে আবু সালেহ তোমার জীবন ধন্য। যেহেতু তোমার ঔরশে আল্লাহর পেয়ারা নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর পরম বন্ধু জন্মগ্রহণ করেছেন। তুমি ঐ বালকের নাম রাখবে মাহবুবে সোবহানী মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আব্দুল কাদের। ঐ নামে সে জগতে বিশেষভাবে পরিচিত হবে। কথিত আছে যে রাতে হজরত বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (র.) জন্মগ্রহণ করেন সেই রাতে জিলান শহরে এগারশ’ রমণী পুত্র সন্তান প্রসব করেন। পরবর্তীকালে উক্ত শিশুগণ হজরত বড় পীরের সহবতে থেকে কামেল ওলি হয়েছিলেন।
হজরত বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (র.) কে উচ্চ শিক্ষার জন্য জিলান নগরী থেকে পাঁচশ’ মাইল দুরবর্তী বাগদাদ নগরে পাঠানো হয়। যাবার সময় তাঁর মাতা চল্লিশটি দীনার তাঁর জামার আস্তিনের ভিতর বোগলের নিচে সেলাই করে দেন। পথিমধ্যে একস্থানে তাঁদের কাফেলা ডাকাতদের কবলে পড়ে। ডাকাতগণ কাফেলার বেশ কিছু লোককে হত্যা পুর্বক দীনারসহ মালামাল লুট করতে থাকে। এক সময় জনৈক দস্যু হজরত আব্দুল কাদের জিলানীর নিকটে গিয়ে বললো তোমার নিকট যা আছে তা দিয়ে দাও। তখন তিনি বললেন আমার নিকট চল্লিশটি দীনার আছে এবং তা জামার আস্তিনে লুকানো আছে। ডাকাতকে বালক উপহাস করছে এই ভেবে তাকে ডাকাত সরদারের কাছে নেয়া হলো এবং আস্তিনের সেলাই কেটে তা বের করা হলো। ডাকাত সরদার কৌতুহলি হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলো তুমি কেন বল্লে যে তোমার কাছে দীনার আছে এবং ওমুক স্থানে লুকায়িত আছে। তা না বল্লে তো আমরা ঐ দীনারের খোঁজ পেতামনা। তাছাড়া অন্যান্যদের মত আমাদের নিকট প্রাণ ভিক্ষার জন্যওতো কোন অনুনয় বিনয় করলেনা এর কারণ কি? তিনি বল্লেন আমি বাড়ি থেকে রওনা হবার সময় আমার মাতা আমাকে মিথ্যা কথা বলতে বারণ করেছেন তা যদি কঠিন বিপদের সময়ও হয়। আর প্রাণ রক্ষার জন্য তোমাদের নিকট প্রাণ ভিক্ষা চাইবো কেন? প্রাণ রক্ষা বা সংহারের মালিক তো একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। একথা শোনার পর ডকাতদের জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল। তারা তাদের হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে সৎ পথে জীবন যাপন করতে আরম্ভ করলো। কিতাবে উল্লেখ আছে পরবর্তীকালে উক্ত একষট্টিজন ডাকাত সদস্য বড় পীর সাহেবের নিকট বয়াত গ্রহণ করেছিলেন।
বাগদাদে তখন বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হতো। হজরত আব্দুল কাদের জিলানী (র.) বাগদাদের নিজামিয়া মাদরাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর পীর হজরত আবু সাঈদ মাখজুমী (র.) এর নিকট হতে এলমে মারেফাত বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের কঠিন সাধনা করেন।
উল্লেখ আছে তিনি একাধিকক্রমে পঁচিশ বছর ইরাকের গহীন জঙ্গলে বসে সাধনা করেছিলেন। তিনি সকল সমই মোরাকাবা মোশাহেদাতে মশগুল থাকতেন। এসময় তিনি প্রায়ই শাক-পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করতেন। তিনি বলেছেন, এক রাত্রিতে আমার ইচ্ছা হলো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেই তারপর উঠে ইবাদতে লিপ্ত হবো। মনের এই কুপ্রবৃত্তিকে শাস্তি দানের জন্য আমি তখুনি এক পায়ের উপর দাঁড়িয়ে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত শুরু করলাম এবং ঐ অবস্থায়ই সমগ্র কোরআন শরীফ খতম করেছি। অতঃপর পনেরো বছর পর্যন্ত আমি প্রত্যেক রাতেই এক পায়ে দাঁড়িয়ে কোরআন শরীফ খতম করেছি।
হজরত বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (র.) কোন সময়ই বিনা অজুতে থাকতেননা। অজু নষ্ট হলে তৎক্ষণাত অজু সমাধা করতেন। জানা যায় এশা’র নামাজের জন্য তিনি যে অজু করেছেন সেই অজুতেই ফজরের নামাজ আদায় করতেন। হজরত বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (র.) এর কারামতি বা অলৌকিক ঘটনা রয়েছে বিস্তর। শেখ আব্দুল কাদের সামী হতে বর্ণিত আছে, একদা রমজান মাসে হজরত বড়পীর সাহেব একাধিকক্রমে সত্তুর জন লোকের নিকট হতে ইফতারের দাওয়াত গ্রহণ করলেন। একে অন্যের অসাক্ষাতে দাওয়াত দিয়ে গেল এবং তিনি সকলের দাওয়াত রক্ষার্থে সকলের দাওয়াতই কবুল করলেন। সেদিন তিনি অলৌকিক ক্ষমতা বলে ইফতারের সময় মুহুর্তের মধ্যে সকলের বাড়িতে ইফতার করে নিজ বাড়িতে ফিরে এসে স্বীয় মুরীদদের সাথে একত্রে বসে ইফতার করলেন। পরদিন দাওয়াত দাতাগণ একে অপরকে বলে যে, হুজুর গতকাল আমার বাড়িতে ইফতার করেছেন। অন্যজন বলে না তা কি করে হয়, তিনিতো আমার বাড়িতে ইফতার করেছেন। এদিকে হজরত বড়পীর সাহেবের একজন খাদেম একথা কিছুতেই বিশ্বাস করলেননা কারণ তিনি নিজ বাড়িতে সকলের সঙ্গে ইফতার করেছেন। হজরত বড়পীর উক্ত খাদেমকে সঙ্গে করে বাড়ি থেকে বেশ কিছু দুরে একটি গাছের নিচে গিয়ে বসলেন। খাদেমসহ তিনি আল্লাহর জেকেরে মশগুল হলেন। একসময় তিনি উক্ত খাদেমকে বললেন, গাছের উপরে তাকিয়ে দেখো। তখন তিনি দেখেন যে, গাছের শাখা-প্রশাখায় একজন করে বড়পীর বসে আছেন এবং আল্লাহর জেকের করছেন। অপরদিকে হজরত বড়পীর তার পাশেই বসে রয়েছেন। এঘটনার পর খাদেম খুবই লজ্জিত হয়ে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এধরনের অলৌকিকত্ব বা কারামতির অনেক ঘটনা রয়েছে যা স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করে শেষ করা যাবেনা।
এই আওলিয়কুল শিরোমনি গাউসুল আজম হজরত মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানী (র.) হিজরি ৫৬১ সনের ১১ রবিউস সানী সোমবার প্রাতঃকালে ৯০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। বাগদাদ নগরে তাঁর পবিত্র মাজার শরীফ অবস্থিত। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।