ফেলে আসা দিন গুলো-২৮

// এবাদত আলী
সরকারি চাকুরির সুবাদে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করি। ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ই ডিসেম্বর উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এই দু‘টি নির্বাচনেই আমি পাবনা জেলার ফরিদপুর থানার বৃলাহিড়িবাড়ি অর্থাৎ বি এল বাড়ি ইউনিয়নের বাশুড়িয়া সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাই। আমরা ডেমরা কাচারির সকল স্টাফ পোলিং অফিসার হিসেবে নির্বাচনে নিয়োগ লাভ করি। আমাদেরকে নদী পথে নৌকায় করে বাশুড়িয়া যেতে হয়। বাশুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন একটি বাড়িতে আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
এবারেই প্রথম ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় এবং ভোটারগণ ব্যালট পেপার ভোটের বাক্সে ফেলেন। এর আগে নির্বাচনে ব্যালট বাক্স হিসেবে বড় বড় ড্রাম ব্যবহার করা হতো। নির্বাচনি বুথের ভিতরে ড্রামের গায়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতাকারি প্রার্থির নাম এবং নির্বাচনি মার্কা বা প্রতিক সেঁটে দেওয়া হতো। ভোটারগণ ব্যালট পেপার নিয়ে বুথের ভিতরে গিয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থির ড্রামে তা ফেলে দিতেন।
এতে ভোটারগণ ভোট দিতে গিয়ে ব্যালট পেপারের পরিবর্তে কোন কোন ড্রামে আম-কাঁঠালের পাতা ফেলতেন। অনেক ভোটার ভোটের ব্যালট বাইরে নিয়ে যেতেন। কেউবা আগুন শুদ্ধ বিড়ি সিগারেট ফেলে বাইরে আসতেন। এতে আগুনে ড্রামের ভিতরের ব্যালট পেপার পুড়ে যেতো। তাই এবারে ভোটার তালিকা অনুসারে পোলিং অফিসারদের নিকট হতে ব্যালট পেপার নিয়ে গোপন বুথে গিয়ে সিল মেরে সেই ব্যালট পেপার অফিসারদের সামনের বাক্সে ফেলেতে হতো। ফলে ব্যালট পেপার নিয়ে বাইরে যাওয়া এবং ব্যালট বাক্সে যেকোন জিনিষ ফেলা সম্ভব ছিলোনা।
১৯৭০ সালে ৭ ও ১৭ ডিসেম্বরে প্রাদেশিক পরিষদ ও জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পাবনা জেলার পাবনা সদর মহকুমার ফরিদপুর, চাটমোহর ও শাহজাদপুর থানা নিয়ে গঠিত নির্বাচনী এলাকায় জাতীয় পরিষদ সদস্য (এম এন এ) পদে পুর্ব পাকিস্তান আওয়াী লীগের প্রার্থী শাহজাদপুরের সৈয়দ হোসেন মনসুর এবং চাটমোহর ও ফরিদপুর নিয়ে গঠিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য পদে মোজাম্মেল হক সমাজী নিরঙ্কুশ ভোটে জয়লাভ করেন। শুধু এখানেই নয়। সমগ্র পুর্ব পাকিস্তনেই আওয়ামী লীগের নেতাগণ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। পাবনা ৫ আসন অর্থাৎ পাবনা সদর, আটঘরিয়া ও ঈশ্বরদী থানা নিয়ে গঠিত জাতীয় পরিষদ এলাকার এমএনএ নির্বাচিত হন আমজাদ হোসেন এবং পাবনা সদরের এমপিএ নির্বাচিত হন আব্দুর রব বগা মিয়া এবং আটঘরিয়া ও ঈশ্বরদীর এম পি এ নির্বাচিত হন এ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন। বেড়া, সাথিয়া ও সুজানগর নির্বাচনী এলাকার এম এন এ নির্বাচিত হন অধ্যাপক আবু সাঈদ এবং সাথিয়া ও সুজানগরের এমপিএ মাস্টার আহমেদ তফিজ উদ্দিন এবং বেড়া ও সাথিয়ার এমপিএ নির্বাচিত হন আহমেদ রফিক। ১৯৭০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আহমেদ রফিক জয়লাভ করেন এরই ৫ দিন পর ২২ ডিসেম্বর আহমদ রফিক তার দক্ষিণ রাঘবপুরের নিজ বাসায় প্রবেশের সময় নকশাল বাহিনী দ্বারা খুন হন। ২৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসায় আসেন, সমবেদনা জানান এবং এদিন আরিফপুর গোরস্থানে দিয়ে কবর জিয়ারত করেন। এদিন বিকালে পাবনা পুলিশ লাইন মাঠে শহীদ আহমদ রফিকের স্মরণে শোক সভায় বক্তব্য দেন।
আমি ১৯৬৯ সালের ২২ এপ্রিল তারিখে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৭১ সালে সরকারি চাকুরি হতে আমাকেসহ পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৪শ জনকে একই স্েঙ্গ ছাঁটাই করা হলে ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখ হতে বেকারত্বের খাতায় নাম লেখাতে হয়। ফলে সারাদিন ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আমার আর কোন কাজ থাকেনা। ‘নেই কাজ তো খৈ ভাজ’ ধরনের অবস্থা।
১৯৬৬ হতে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে লেখাপড়া করার সুবাদে এবং এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদে ছাত্র লীগের প্যনেলে ম্যাগাজিন সেক্রেটারি পদে নির্বাচন করার ফলে পাবনা শহরের সকল ছাত্র লীগ ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক থাকায় নেতৃবৃন্দ তাই আমার এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের দায়িত্ব দেন । এলাকার যুব সমাজ ও ছাত্র সমাজের কাছে ছাত্র লীগের নেতা হিসাবে পরিচিতি থাকায় সেই কাজটি আমার জন্য সহায়ক হয় ।
আমার সখের নতুন ফনিক্স সাইকেলখানাকে সঙ্গি হিসাবে কাজে লাগাই। সকালে চারটে খেয়ে বাড়ি থেকে বের হই। ফিরি রাতের বেলা।
কথায় বলে যেখানে রাত সেখানেই কাত। আমারও যেন ঠিক সেই অবস্থা। পাবনা শহরের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে নতুন করে সখ্যতা গড়ে ওঠে। আমার অগ্রজ পাবনা জেলা ছাত্র লীগের সভাপতি আব্দুস সাত্তার লালু (স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে আততায়ীর হাতে নিহত), এডওয়ার্ড কলেজের সাবেক জিএস সোহরাব উদ্দিন সোবা (বর্তমানে মৃত), ছাত্র নেতা মোহাম্মদ নাসিম সাবেক মন্ত্রী (বর্তমানে মৃত), আমার সহপাঠিও বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু (বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রি বাংলাদেশ সরকার।) ফজলুর রহমান পটল (পরে বিএনপিতে যোগদান ও ক্রিড়া প্রতিমন্ত্রী, বর্তমানে মৃত ),
সুজানগরের তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (বর্তমানে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা), পাবনা শহরের রবিউল ইসলাম রবি, মোহাম্মদ ইকবাল (পরে জাসদ নেতা, বর্তমানে মৃত), এম মুক্তার আলী, আব্দুল লতিফ মাষ্টার (বর্তমানে মৃত), আফ্ফান আলী, আমার অনুজ প্রতিম ছাত্র নেতা পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পাবনা জেলা শাখার বলিষ্ঠ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল (পরে বিএনপির এমপি, ২০০০ সালের ১০ই নভেম্বর সিরাজগঞ্জের কোনাবাড়ি নামক স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত), সালাহ উদ্দিন সোহেল, আমার সহপাঠি গোলাম সরওয়ার খান সাধন (সঙ্গীত শিল্পী, স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ), পাবনা শহরের বেবী ইসলাম, গাছপাড়ার নুরুল ইসলাম নুরু, শহরের জহুরুল ইসলাম বিশু, (পরে বিএন পিতে যোগদান, পাবনা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান) , আটঘরিয়ার ডেঙ্গার গ্রামের শাহজাহান আলী (পরে অ্যাডভোকেট ও বিএনপি নেতা) ছাত্র লীগ নেতা কামরুজ্জামান, আমিনুল ইসলাম মুক্তাসহ অনেকের সাথে নতুন করে আবার সখ্যতা গড়ে ওঠে।
বিশেষ করে রফিকুল ইসলাম বকুলের সাথে বেশি বেশি যোগাযোগ হয়। কারণ আমার গ্রামের বাড়ি মালিগাছা ইউনিয়নের বাদলপাড়া গ্রাম এবং আশে পাশের গ্রামগুলো তে আগে থেকেই তার পদচারণা ছিল। তাছাড়া পাবনা শহরের পশ্চিমাঞ্চলের ছাত্রদের মধ্যে বেশিরভাগ ছাত্রই তখন ছাত্র লীগের সদস্য ছিলেন।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ হতে যখন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মত পাবনা জেলাতেও (সিরাজগঞ্জসহ) অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় তখন পাবনা জেলা ছাত্র লীগের সভাপতি ও জেলার স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসাবে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’কে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন । তার নেতৃত্বে রফিকুল ইসলাম বকুলসহ পাবনা জেলার ছাত্র-জনতা এক কাতারে শামিল হয়। জেলা আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতেৃত্বে আমাদের এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়। ফলে পাবনা শহরের নেতৃবৃন্দ একাধিকবার আমাদের এলাকায় আসেন এবং ছাত্র ও যুবসমাজকে চাঙ্গা করে রাখেন। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।