একটি ভাষণ এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম

মাজহার মান্নান
 কালজয়ী সেই ভাষণ আজ ঐতিহাসিক নথি
অনন্তকাল বাঙালি চেতনায় জুগিয়ে যাবে গতি
মানতে পারেনি বঙ্গবন্ধু শোষণ জুলুমের ঘানি
জন সমুদ্রে শোনালেন তাই অমর কবিতাখানি

” এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই তবে তার সেই বজ্রকণ্ঠ বেঁচে আছে এবং অনন্তকাল বেঁচে থাকবে সেটা।  ৫১ বছর আগে জাতির জনকের সেই অনন্য ভাষণটি আজ সমগ্র বিশ্বের একটি বড় সম্পদ এবং একটি ঐতিহাসিক নথি। মাত্র ১৮ মিনিটের এবং ১১০৮ শব্দের সেই ভাষণটি শোষক গোষ্ঠীর ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলো এবং বিশ্ব বিবেককে জাগিয়ে তুলেছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটির যেমন রয়েছে রাজনৈতিক মূল্য ঠিক তেমনি রয়েছে এর তাত্বিক, নৈতিক, আদর্শিক, কাব্যিক এবং নান্দনিক মূল্য। কাব্যিক ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ সেই ভাষণটি একদিকে শোষকদের সাজানো বাগানকে তছনছ করে দিয়েছিলো, অন্যদিকে শোষিতের হৃদয়ে গোলাপ  ফুটিয়েছিলো এবং শিকলমুক্ত হতে স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। এটি এমনই একটি ভাষণ যেটা বারবার শোনার পরেও শোনার আকাংঙ্খা থেকে যায় এর কাব্যিক ছন্দ, শব্দ চয়ন, ভাষার মাধুর্য, বহুমাত্রিকতা এবং অলংকরনের জন্য। ভাষণের প্রতিটি শব্দই  শোষিত মানুষের মনবাসনার এক জীবন্ত  বহিঃপ্রকাশ। শব্দ বিন্যাস, বাচনিক কাঠামো এবং নান্দনিক উপস্থাপনার জন্য ভাষণটি অমরত্ব লাভ করেছে। দীর্ঘ ২৩ বছর চেষ্টা করেও পাক শাসকেরা যে কণ্ঠটিকে রোধ করতে পারে নি সেই কণ্ঠটি কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়কে জয় করেছিলো। মহান নেতার কণ্ঠে উচ্চারিত মাত্র ১১০৮ শব্দ মুক্তিযুদ্ধ ঘটিয়েছিলো, সাহস আর শক্তির সঞ্চার করেছিলো বাঙালির হৃদয়ে। কি যাদুকরী শক্তি ছিলো ঐ শব্দ গুলিতে? একটি ভাষণ সকল বাঙালিকে একই মঞ্চে সমবেত করেছিলো যেখান থেকে শুরু হয়েছিলো গেরিলা যুদ্ধ। ভাষণটি বাঙালির আবেগের জায়গাটিকে স্পর্শ করেছিলো প্রবলভাবে যে কারণে তারা বুকের তাজা রক্ত দিতে কুণ্ঠাবোধ করে নি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ( বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিলো রাজনীতির সেই মহাকবির জন্য যেখানে দাঁড়িয়ে কবি তার ইপিক রচনা করবেন। কবির সেই ঐন্দ্রজালিক কণ্ঠটি শোনার জন্য প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ চাতক পাখির মত অপেক্ষা করছিলো মঞ্চের চারপাশ ঘিরে।  কখন আসবে সেই কবি যিনি আশার বাণী শোনাবেন এবং  যার কাব্যখানি দুই যুগের শোষণের কবর রচনা করবে। কবি নির্মেলুন্দগুনের সেই লাইন গুলি মনে পড়ে যায়-

      ” সেদিন পলকে দারুন ঝলকে তরীতে উঠিলো জল
          হৃদয়ে লাগিলো দোলা
         জনসমুদ্রে জাগিলো জোয়ার সকল দুয়ার খোলা
         কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী
        গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন
         তার অমর কাব্যখানি।

বিশ্বের যত খ্যাতনামা ভাষণ রয়েছে সেগুলির সবই ছিল লিখিত, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটি ছিল অলিখিত। কথার জাদুকর, বাগপটু, অনলবর্ষী বক্তা বঙ্গবন্ধু খুব সাবলীলভাবে সহজাত ভঙ্গিতে যে কথাগুলি সেদিন উচ্চারণ করেছিলেন সেটা বাঙালিদের মাঝে দায়িত্ববোধের সৃষ্টি করেছিলো, আর সেই দায়িত্ববোধটি ছিলো নরক যাতনা থেকে লড়াইয়ের মাধ্যমে নিজেদেরকে মুক্ত করা। বাঙালিদের কাছে তখন ভারী কোন অস্ত্র ছিলো না যুদ্ধ করার মত, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটি যুদ্ধ ময়দানে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসাবে ভূমিকা রেখেছিলো। যুদ্ধ মাঠে মনবল চাঙ্গা রাখার জন্য সেই ভাষণটি টনিক হিসাবে কাজ করেছিলো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বজ্রকণ্ঠ অনুষ্ঠানটি মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা আর সাহস যুগিয়েছে যুদ্ধ চলাকালীন ৯ টি মাস। একটি মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে করতে হয়, শত্রুদের মোকাবেলার রণকৌশল কি, যুদ্ধ ময়দানে অবিচল থাকতে হয় কিভাবে, অধিকার কিভাবে আদায় করতে হয় ইত্যাদি বিষয়ের দিক নির্দেশনা রয়েছে ভাষণটিতে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি আজ শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের বৃহৎ রিসোর্সে পরিনত হয়েছে। প্রচুর গবেষণা হয়েছে ভাষণটিকে নিয়ে। এ পর্যন্ত ১৩ টি ভাষায় ভাষণটি অনুদিত হয়েছে যার ফলে বিশ্বের বিপুল সংখ্যক মানুষ এটি শোনার এবং পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তার ভাষণের সবটুকু জুরে অনেক বার্তা রয়েছে। তবে সেগুলির মধ্যে ‘ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ অংশটি এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এ চরণটি দ্বারা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, মুক্তির কথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছেন। বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে এমন একটি ডাক শুনতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দেয়ার জন্য মঞ্চে উঠেন তখন উপস্থিত লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত হয় —

     ” দেশ বাঁচাতে অস্ত্র ধর
       বাংলাদেশকে স্বাধীন কর।”

বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল খুবই পরিপাটি  মার্জিত, পরিশালিত এবং ভারসাম্যপূর্ণ।  রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সীমার মধ্যে থেকেই ভাষণটি ছিলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ যেন এক দাবানল। বঙ্গবন্ধু ভাষণটি এমন ছান্দোসিকভাবে উপস্থাপন করেছিলেন যে নিউজউইক ম্যাগাজিন তাকে রাজনীতির কবি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলো। ২০১৭ সালে ৩০ অক্টোবর ইউনেসকো ভাষণটিকে ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশের উচ্চ আদালত কালজয়ী এই ভাষণটিকে শিক্ষার সকল স্তরের পাঠ্য বইতে সংযুক্ত করতে নির্দেশনা জারি করেছে। শিশু, কিশোর এবং যুবকেরা এই ভাষণটি শুনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিতে তার স্বীয় দর্শন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্বের কৌশল, রাজনৈতিক প্লান, দূরদর্শীতা, সাহসিকতা, আত্মত্যাগ, ইচ্ছাশক্তি, জনগণের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি, ভালোবাসা ব্যক্ত হয়েছে। আর এ কারণেই এই ভাষণটি সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলো, এক কাতারে সামিল করতে পেরেছিল, মোটকথা একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলো। বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনগণের আবেগ নিয়ে কখনই খেলতেন না, তিনি জনগণের আবেগকে মর্যাদা দিতেন। নিজের অনুভূতিকে গণ অনুভূতির সাথে একাত্ম করতে পেরেছিলেন যেটা তার ভাষণে স্পষ্ট। ভাষণে বঙ্গবন্ধু দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন ” আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে, রক্তের দাগ এখনো শুকায় নাই। আর সেই রক্তের উপর দিয়ে হেটে আমি সাধারণ এ্যাসিম্বেলিতে যোগ দিতে পারি না। জনগণ আমাকে সেই অধিকার দেয় নাই।” বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্ব আইকন, নেতৃত্বের জাদুকর, এবং ইতিহাসের এক বিরাট মহীরুহ। তিনি ছিলেন সৎ, বলিষ্ঠ, অদম্য, দুর্বার, নির্লোভ, মুক্তির দিকপাল, মহাকান্ডারি, এবং মানবতাবাদের ক্যানভাসে গণতন্ত্রের দিশারি। তিনি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, এক বিরাট বটবৃক্ষ, বাতিঘর এবং স্বৈরাচার শাসনের বিরুদ্ধে এক প্রবল ঝড়। সাত কোটি বাঙালির প্রাণের প্রদীপ বিশ্ববরেণ্য এই নেতা ছিলেন দেশপ্রেমের এক মূর্ত প্রতীক। তিনি মানুষের মুক্তি চেয়েছেন। ক্ষমতার প্রতি লালায়িত ছিলেন না আর এটা প্রমাণিত হয়েছে তার সেই ভাষণে। ” আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি।”বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন ভিশনারি লিডার যিনি গণ মানুষের মন পড়তে পারতেন, বুঝতে পারতেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষনটি ছিলো সর্বজনীন, মানবতাবাদের এক মস্ত দৃষ্টান্ত। এমন ভাষণ বিশ্বে বিরল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি যখন শুনি তখন মনে পড়ে যায় মার্টিন লুথার কিং এর ” আই হ্যাভ এ ড্রিম’ ভাষণটি এবং আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ ভাষণটি। কিউবা নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রশংসা করে বলেছিলেন – তার ভাষণটি একটি অনন্য ভাষণ এবং একটি অনন্য দলিল। নেনসল ম্যান্ডেলা এই ভাষণের প্রশংসা করে বলেছিলেন, এটি বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ধাবিত করেছিলো। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির কথা ঘোষণা করেছিলেন। তার কালজয়ী সেই ভাষণকে মেগনাকার্টা অব বাংলা বলে অভিহিত করা হয়েছে। ২০১৪ সালে ২৫০০ বছরের সেরা ভাষণ নিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে বই প্রকাশ করা হয়েছে এবং উক্ত বইয়ের ২০১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি স্থান পেয়েছে এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম শিরোনামে। টাইম ম্যাগাজিন ১৯৯৭ সালে  বলেছিলো, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছিলো, ভাষণটি ছিলো বাঙালির স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে ২৩ বছরের শোষণ, অত্যাচার ও জুলুমের চিত্র নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ” জীবন দিয়ে আমরা আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছি, ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালে জয় লাভ করেও গদিতে বসতে পারি নাই, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছিলো, ১৯৬৬ সালের ৬ দফার আন্দোলনে ৭ জুনে আমার ছেলেদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, ১৯৬৯ সালে আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান আমাদের শাসনতন্ত্র ও গণতন্ত্র দিতে চেয়েছিলেন, সেক্ষেত্রেও আমাদের সাথে প্রতারনা করা হয়েছে।” বঙ্গবন্ধু অত্যান্ত দক্ষতার সাথে এবং দূরদর্শীতার সাথে তার ভাষণটি উপস্থাপন করেছিলেন যেন পাক সরকার তাকে কোনভাবেই বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রমাণ করতে না পারে। ধারাবাহিক সংগ্রামের এক বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছিলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। ইতিহাসের এই মহাবীর হিমালয়ের মত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, যা ভেদ করা কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক মিথ্যাচারকে ঘৃণা করতেন। তিনি সব সময় ন্যায্য কথা বলতে পছন্দ করতেন। এই মহান নেতা ছিলেন স্পষ্টভাষী। তিনি বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাধারণ অধিবেশনে বসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বারবার মিথ্যাচার করেছেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে দৃপ্তকণ্ঠে বলেন, ” যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তবে তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো।” বঙ্গবন্ধু এ্যাসেম্বেলিতে যোগদান করে সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা বলতে চেয়েছিলেন, গণতন্ত্রের কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান হুঁশিয়ারি উচ্চারন করেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্থানের কোন মেম্বার যদি আসে তবে তা কষাইখানায় পরিনত হবে। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। আর বাংলার জনগণ যখন মালিক হবার চেষ্টা করেছে তখন স্বৈরাচারেরা বুকে গুলি চালিয়েছে। তিনি ভাষণে বলেন, ” আমাদের টাকা দিয়ে যে অস্ত্র কেনা হয়েছে বহিঃশত্রু মোকাবিলা করার জন্য সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বাংলার নিরীহ মানুষের উপর।” বঙ্গবন্ধু সেদিন মঞ্চে ১৮ মিনিটি ছিলেন। নিজের মনের কথাগুলি এবং জনগণের কথাগুলি সাবলীল ভঙ্গিমায় ব্যক্ত করেছেন। তবে তার ভাষণের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল – তিনি শুধু ভাষণ দিয়ে যান নি, জনগণের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেছেন। ভাষণে তিনি বলেন, ” আমার উপর কি তোমাদের বিশ্বাস আছে?” লক্ষ লক্ষ হাত নেড়ে জনগণ জানালো তাদের শতভাগ বিশ্বাস আছে।  বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মুক্তিযুদ্ধের একটি মাস্টার প্লান দিয়েছিলো। তিনি প্রতিটি ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলতে বলেছিলেন এবং যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে বলেছিলেন। তিনি বলেন, ” আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।” ১/২ লাইনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল ঘোষণা করেছিলেন আর এ কারণেই ভাষণটি অনন্য। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে দুই বার গুরুত্বপূর্ণ লাইনটি ( এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম)  উচ্চারন করেছেন। ভাষণের প্রথম ধাপে এবং শেষ ধাপে তিনি এই লাইনটি উচ্চারণ করে এটাই বুঝাতে চেয়েছিলেন যে মুক্ত হতে হলে লড়াই করতে হবে, যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনতে হবে স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক নির্দেশনা ছিল। সেগুলি হল- ১. মার্শাল ল প্রত্যাহার করে নেয়া ২. আর্মিদেরকে প্রত্যাহার করে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া ৩. সকল হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত নিশ্চিত করা ৪. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তিনি   তার ভাষণে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন, কিন্তু এতে গরীব মানুষ যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেই নির্দশনাও দিয়েছিলেন। এমন ভারসাম্যপূর্ণ ভাষণ বিশ্বে সত্যি বিরল। এই ভাষণে তিনি জনগণকে ‘ তোমরা’ সম্মোধন করেছেন। একজন বড় মাপের জাতীয় নেতার পক্ষেই এমনটি করা সম্ভব। জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তার প্রতিপক্ষকেও মার্জিতভাবে রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে সম্মোধন করেছেন। শব্দ চয়ণে তিনি ছিলেন অত্যান্ত যত্নবান। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার বিষয়টি।  ৭ মার্চের ভাষণের পর বাঙালিরা ১৮ দিন সময় পেয়েছিলো যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ভাষণটিই ছিলো যোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র, বড় স্বপ্ন। ”রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো” – এই চরণটি উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের স্পিরিটকে আরো বেশি বেগবান এবং শাণিত করেছেন। লড়াকু সৈনিকেরা স্বাধীনতা নিয়েই ঘরে ফিরবে এমনই স্পিরিট প্রতিফলিত হয়েছে এই চরণে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বাঙালির মুক্তির পথ দেখিয়েছিলো।  তাই বাঙালির অস্তিত্বের মাঝেই এই ভাষণটি বেঁচে থাকবে।