ফেলে আসা দিন গুলো-২৬

এবাদত আলী
সাবেক জমিদারের কাচারি বাড়ি, খাল-বাকলা ওঠা অতি পুরাতন দোতালা দালান বাড়ি। এটাই ডেমরা তহসিল অফিস। এই অফিসের হেড তহসিলদার, তহসিলদারইনচার্জ অর্থাৎ বড় বাবু হলেন ময়মনসিংহ মুক্তাগাছার শাহেদ আলী মিয়া। তিনি পাবনা জেলাতেই আগাগোড়া চাকরি করছেন। সেই সুবাদে সাথিয়া থানার নন্দনপুরে একটি বাড়িও করেছেন। তার কাছে যোগদান পত্রের আরেকটি কপি জমা দিলাম। এই তহসিলে সহকারি তহসিলদার হিসেবে নজরুল হক, বাড়ি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার ষোলদাগে। অপরজন হলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ গেেেটর পাশের বাসিন্দা আব্দুল মজিদ খান এবং হিমায়েতপুরের আফজাল হোসেন। তহসিলদার সাহেদ আলী মিয়া থাকেন দোতালায় আর নজরুল হক থাকেন অফিসের বারান্দা সংলগ্ন বাম দিকের একটি রুমে। অপর দুজন থাকেন অফিসের উত্তর কোনের একটি রুমে। আমার থাকার জায়গা হলো এই রুমেই একটি সিঙ্গেল চোকিতে। তারা সকলেই মেস করে খেতেন। বিধায় আমিও তাদের মেসে শামিল হয়ে গেলাম। অফিসের হেড পিয়ন মকবুল হোসেন। তার বাড়ি সাথিয়া থানার মধুপুরে। পিয়ন আলিমুদ্দিনের বাড়ি অফিসের পাশেই। সিজনাল পাইক বা এস পাইক আব্দুল আজিজের বাড়ি আতাইকুলার বৃহস্পতিপুর। মেসে পাকের জন্য কোন লোক ছিলোনা তবে আব্দুল আজিজ খুব ভালো পাক করতে পারতো তাই তাকে দিয়ে পাকের কাজ চালানো হতো। বিনিময়ে তাকে আর মেসের কোন খরচ বহন করতে হতোনা।
ডেমরা তহসিল অফিসটি বেশ নিরিবিলি এলাকা। অফিসের সামনে একটি মাঠ। তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি জোলা, যা গিয়ে মিশেছে উত্তর পাশের বড়াল নদীতে। বড়াল নদীর তীর ঘেঁষে অতীতে গড়ে ওঠা ডেমরা জনপদ একটি হিন্দু প্রধান এলাকা। এখানে একটি হাইস্কুল, একটি প্রাইমারি স্কুল এবং একটি বড় বাজার রয়েছে। নদী তীরে রয়েছে একটি দাতব্য চিকিৎসালয়। এখানে সপ্তাহের দুদিন হাট বসে।
পর দিন যোগদানপত্র জমা দেয়ার জন্য থানা সদর বনওয়ারিনগর ফরিদপুর যেতে হলো। নতুন চাকরি তাই সার্কেল অফিসার রেভিনিউ বা সিও রেভ এবং তাঁর অফিস ষ্টাফের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাওয়া। সম্পুর্ন অপরিচিত বিধায় আমার সঙ্গে এস পাইক আজিজকে পাঠানো হলো।
ডেমরা থেকে মাইল পাঁচেক দুর ফরিদপুর সিও রেভ অফিস। কাঁচা রাস্তা ধুলি ধুসর এবড়ো থেবড়ো পায়ে চলা পথ ধরে চলা। এপথে একমাত্র গরু মহিষের গাড়ি ছাড়া অন্য কোন যানবাহন চলাচল করেনা। এ এলাকায় কারো মোটর সাইকেল নেই। বাইসাইকেল আছে যাদের সেই ভাগ্যবানদের সংখ্যাও অতি নগন্য। বর্ষা মৌসুমে যাতায়াতের জন্য একমাত্র নৌকাই ভরসা। অবশ্য বড়াল নদীতে বরো মাসই গয়না নৌকা এবং লঞ্চ চলাচল করে। তবে তাতে প্রচুর সময় নষ্ট হয়।
পথে কালিয়ানি খেয়া ঘাট পার হবার পর আবদুল আজিজ পাটনিকে বল্ল ইনি আমাদের ছোট নায়েব সায়েব মানে কাচারির ছোট বাবু। সঙ্গে সঙ্গে পাটনি তার হাতের লগিটা বোগলের মধ্যে ধরে দুহাত জোড় করে প্রণাম জানিয়ে বল্ল বাবু পেন্নাম। আমার কেমন যেন লজ্জা বোধ হচ্ছিলো, কিন্তু পক্ষান্তরে আমি মাথা ঝাঁকিয়ে তার উত্তর দিলাম। খেয়া ঘাটরে পাটনির সঙ্গে কাচারির স্টাফের পরিচয় থাকতেই হবে। কারণ কাচারি অর্থাৎ তহসিল অফিস থেকেই প্রতি বছর খেয়া ঘাট, সরকারি খাস জলা-জলকর, খাস পুকুর, লঞ্চ-স্টিমার ঘাট, হাট-বাজার, গরু মহিষের খোয়াড় ইত্যাদি নিলামে ডাক হয়। তাই কাচারির স্টাফ বা বাবুদের কদর খুব বেশি। তারাই এলাকার জমিদার। খেয়াঘাটের পাটনিরা তাই তাদের কাছে পারাপারের কোন কোন পয়সা নেয়না।
যাক আমরা একসময় বনওয়ারিনগর সিও রেভ অফিসে পৌঁছে গেলাম। বনওয়ারি লাল সাহার কাচারি বাড়ি সার্কেল অফিসার রেভিনিউ বা সিও রেভ অফিস। সিও রেভ ধীরেন্দ্র কুমার সাহা সংক্ষেপে ডি কে সাহা। তবে ডিকে সাহা , তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর হাতে যোগদানপত্র দিলাম। তিনি অনেক উপদেশবাণী শোনালেন যা নাকি পরবর্তী সময়ে কাজে লাগবে। দেখা হলো সি ও রেভ অফিসের কানুনগো সেকেন্দার মিয়ার সঙ্গে। তিনিও বেশ কিছু উপদেশ দিলেন। অফিসের হেডক্লার্ক অর্থাৎ বড় বাবু, সার্ভেয়ার, নাজির, সাটিফিকেট এসিষ্টেন্ট, মিউটেশন এসিষ্টেন্ট, প্রসেস সার্ভার পিয়নসহ অন্যান্যদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হলো। সেদিনের মত আমরা ডেমরা তহসিল অফিসে ফিরে এলাম।
নতুন চাকরি, নতুন জায়গা , নতুন পরিবেশ। এলকার মানুষ গুলোও নতুন। সকলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বেশ সময় লাগছিলো। সকাল ১০টা হতে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অফিসের সময়। কিন্তু আমাদের কোন সময় নির্ধারিত ছিলনা। অফিসের পাশের রুমেই অবস্থান। তাই যখন প্রয়োজন অফিসে বসা প্রয়োজন নেই তো রুমের মধ্যে অবস্থান করা। এ যেন প্রাইভেট প্রেকটিশনার ডাক্তারের মত। রোগি আছে তাই ডাক্তার আছে। রোগি নেই তো ডাক্তারও নেই। তবে খাজনা আদায়ের চাপ বেশি হলে তখন অফিসেই থাকতে হয়।
প্রথম দিকে খাজনা আদায় সম্পর্কে আমার কোন কাজ ছিলোনা। আমাকে দিয়ে বড় বড় যোগগুলো করানো হতো। সারাদিন বড়বাবুসহ অন্যান্য সহকারিগণ যে টাকা দাখিলাতে আদায় করতেন তা একটি রেজিষ্টারে উঠানো হতো যার নাম রেজিষ্টার থ্রি বা আমদানি বহি। এই আমদানি বহির সারাদিনের আদায়কৃত টাকার যোগ করে তা রেজিস্টার ফোর বা ক্যাশ বহিতে উঠানো হতো। এই যোগের নাম বারিজ করা। এগুলোর বেশিরভাগই আমাকে দিয়ে করানো হতো। তারা বলতেন এইভাবে শিখতে শিখতে পাকা তহসিলদার হওয়া যাবে। আমি নতুন লোক মনে মনে ভাবি আমার পরিশ্রম হয় হোক তবুওতো পাকা নায়েব বা তহসিলদার হওয়া যাবে। কিন্তু এই কাজ বেশি দিন করতে হলোনা। । (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।