ফেলে আসা দিন গুলো-২৫

এবাদত আলী
সুলক্ষণই হোক আর কুলক্ষণই হোক সরকারি চাকরিটা হঠাৎ করেই পেয়ে গেলাম। কথায় বলে যেন তেন সরকারি চাকরি দুধ ভাত। নছিবের গুনে চাকরিটা যখন জুটে গেল তখন যোগদান তো করতেই হবে। কিন্তু আমার লেখাপড়ার কি হবে? আমি তখন ১৯৬৯ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বাংলা অনার্সে প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে মাত্র নয়মাস ক্লাশ করেছি।
এখনকার মত চাকরির বাজারে তখন আগুন লাগেনি। কোটা পদ্ধতি নিয়েও তেমন কোন টানা হেচড়া ছিলোনা। তবে পুর্ব-পাকিস্তানিদের প্রতি বৈশ্যম্যের কারণে তখনো অতি সহজে সরকারি চাকরি মিলতো না।
সত্যিকথা বলতে কি আমার চাকরিটা হঠাৎ করেই ভাগ্যগুনে হয়েছিলো। আমার ছোট ভগ্নিপতি মকবুল হোসেন অ্যাডিশনাল অ্যাসিসটেন্ট তহশিলদার পদে এক বছর আগে যোগ দেয়। সে জানায় যে এই পদে লোক নিয়োগ করা হবে। আমি সেমতে সাদা কাগজে হাতে লেখা একখানা দরখাস্ত দাখিল করি পাবনা ডিসি অফিসে। ইন্টারভিউ এর জন্য ডাক পড়ে ৭ এপ্রিল ১৯৬৯ পাবনা শহরের তাড়াশ হাউজ বা রায়বাহাদুরের বিল্ডিং এ জয়েন্ট ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ে।
নির্ধারিত তারিখে ইন্টারভিউ দিবার জন্য হাজির হই। শুধু মাত্র মৌখিক পরীক্ষা। বোর্ডের সদস্যগণের ৫টি প্রশ্নের সবগুলির সঠিক উত্তর দিলে জয়েন্ট ডিসি বললেন দেখে তো মনে হয় আপনি কলেজের ছাত্র চাকরি দিলে কি জয়েন করবেন? আমি বল্লাম ইন্টারভিউ দিতে যখন এসেছি তখন চাকরি পেলে অবশ্যই জয়েন করবো। চার দিনের মাথায় ফলাফল পাওয়া গেল। নিয়োগ পত্র হাতে পেলাম। দি ফলোইং পারসোনস আর অ্যাপয়েন্টেড এজ এডিশনাল টেমপরারি এ্যসিসটেন্ট তহশিলদারস আন্ডার দি গভরমেন্ট এ্যাকুয়ার্ড ষ্টেটস, পাবনা, ইন দি স্কেল অফ রুপিস ১০০-৩- ১৪৫।
মাসিক ১০০শ টাকা বেতনের চাকরি।
নিয়োগ পত্রের এক নম্বর ক্রমিকেই আমার নাম। এমনিভাবে পাবনা সদরের দোগাছির আব্দুল বারি, সাথিয়া ছোনদহের রহমতুল্লাহ, সুজানগর সাতবাড়িয়ার আফাজ উদ্দিন, বনকোলার আবুল হোসেন, সদরের ভাউডাঙ্গার জাবেদ আলী, সিরাজগঞ্জ সুবর্নগাতির আব্দুল কুদ্দস খান, ফরিদপুর থানার রামনগরের মোখতার হোসেন, কুষ্টিয়া কুমারখালির তাহের পুরের রিয়াজ উদ্দিন, সিরাজগঞ্জ বেলকুচির বানিয়াগাতির আব্দুর রশিদ মিয়া, চন্দনাগাতির ওসমান গনি মিয়া, সাথিয়া পুন্ডুরিয়ার তপন কুমার সরকার, বেলকুচির চরকলাগাছির আবুল কালাম খন্দকার, রায়গঞ্জের চর বর্মগাছার চাঁদ হোসেন এবং সাথিয়া খান মাহমুদপুরের আব্দুস সামাদ এই ১৫ জনের নাম সন্বলিত নিয়োগপত্র হাতে পেলাম। পাবনার জয়েন্ট ডেপুটি কমিশনার এ কে রশিদ আহমেদ সাক্ষরিত নিয়োগ পত্রে ২২৫০ টাকার শিয়রিটি বন্ড এবং ৭৫০ টাকা সিকিউরিটি মানি জমা দিয়ে এবং মেডিকেল সার্টিফিকেটসহ যোগদান করতে হবে।
আমার পোষ্টিং অর্ডার হলো বনওয়ানিগর ফরিদপুর থানার ডেমরা তহশিল অফিসে। বন্ড সমুহের কাজ সমাধা করে চাকরিতে যোগদানের জন্য পাবনা তাড়াশ ভবনে গিয়ে ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসের ২২ তারিখে যোগদান পত্র দাখিল করে পরদিন ডেমরা তহশিলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
আমার গ্রাম পাবনা সদর থানার মালিগাছা ইউনিয়নের বাংগাবাড়িয়া -বাদলপাড়া থেকে ডেমরার দুরত্ব কত তাও জানিনা। কিভাবে যেতে হবে তাও অজনা ছিলো। টাকা জমা দিতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিলো আবদুস সামাদ ও তার শশুরের সঙ্গে। তার শশুর বাড়ি ডেমরার নিকটে ধুলাউড়িতে। সামাদের পোষ্টিং অডার হয়েছে সিরাজগঞ্জের ঝাওইলে। তিনি যাবার সময় হাঁটা পথে ডেমরা হয়েই যাবেন।
আমাদের বাড়িতে নুরুজ্জামান নামে এক ভবঘুরে ছেলে থাকতো এবং ফাই ফরমাশ খাটতো। ওর মাথায় একটা নকশি কাঁথা, একটি সিঙ্গেল লেপ, একটি বালিশ ও একটি বিছানার চাদরের বোচকা এবং তার উপরে একটি টিনের সুটকেস যাতে লুঙ্গি, গামছাসহ আমার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ভরা তা চাপিয়ে দিয়ে মা- বাবাকে কদমবুচি এবং পাড়া প্রতিবেশিদের নিকট হতে দোয়া চেয়ে নিয়ে আমরা দুজন পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম। বাড়ি থেকে মালিগাছা পাকা সড়ক কমছে কম তিন মাইল। সেখান থেকে রিকশায় তিন আনা ভাড়া দিয়ে পাবনা শহরের মোটর গ্যারেজে পৌছে মোটরগাড়ির জন্য অপেক্ষা। ঘন্টা দুয়েক পর একটি বাস নগরবাড়ির দিকে রওনা হলে আমরা তাতে উঠে পড়লাম। আমরা আতাইকুলা মাধপুরে নামলাম। এরপর আবার পায়ে হাঁটা পথ। এই পথ অর্থাৎ এই কাঁচা রাস্তাই চলে গেছে সাথিয়া থানায়। আমরা দুজনে চলি আর পথের কথা অর্থাৎ আব্দুস সামাদের বাড়ি খান মাহমুদপুর আর কতদুর বলে হাতড়াতে থাকি।
উত্তপ্ত রোদের মধ্যে হাঁটতে গিয়ে দুজনের অবস্থাই কাহিল। অবশেষে পড়ন্ত বিকেলে সেই আব্দুস সামাদের বাড়ি পাওয়া গেল।
সামাদ এবং তার মা-বাবা আমাদেরকে পেয়ে দারুন খুশি। তার ছেলের যাত্রা পথের আপতঃত সাঙ্গিতো জুটলো। আমরা হাত-মুখ ধুয়ে খানা-পিনা করে ক্লান্ত দেহে বিশ্রাম নিলাম। এক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। বিদ্যুতের আলো বিহীন সারা গ্রামই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। ঝিঁঝিঁ পোকারা মহানন্দে একটানা সুর করে ডেকে চলেছে। যেন তাদের ডাকাডাকির প্রতিযোগিতা। দুরে থেমে থেমে শেয়ালের ডাক। সঙ্গে সঙ্গে কুকুরেরাও অবিরাম ডেকে চলেছে। নিদ্রাহীন রাতে কোনমতে ভোর হলো। একটু বেলা হলে আমরা সকলে মিলে পাশের একটি জোলায় নেমে গোসল করলাম। গরম ভাত খেয়ে ডেমরার পথে রওনা। সামাদের বেডিং পত্র বহনের জন্য তার ছোট ভাইকে নেয়া হয়েছে। বড় ভাইয়ের চাকরির কারণে তারা সবাই খুব খুশি। তাই বড় ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে অফিস দেখে আসা যাবে।
আমাদের হাঁটা শুরু হলো। এযাত্রা যেন অনন্তের যাত্রা। কতক্ষণে শেষ হবে তা কে জানে। এমনি ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এক সময় আমরা ধুলাউড়ি গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম। আব্দুস সামাদের শশুর আব্দুল মান্নান আমাদের জন্য পথের দিকে চেয়ে ছিলেন। আমাদেরকে পেয়ে তিনি দারুন খুশি। আমাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করা হলো। খানিক সময় বিশ্রাম নিয়ে আবার পদযাত্রা শুরু। এবার আমাদের সাথে যোগ দিলেন আব্দুল মান্নান। ডেমরা তার খুবই পরিচিত এলাকা। সপ্তাহের হাটবারে তারা হাট করতে যান। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পর একসময় ডেমরা তহশিল অফিস পাওয়া গেল।। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট