এবাদত আলী
পাবনা জেলায় স্ংবাদিকতার দ্বার উন্মোচনে যাঁদের নাম স্মরণীয় বরণীয় হিসাবে উচ্চারিত হয় তাঁদের মধ্যে সাংবাদিক আনোয়ারুল হক ছিলেন অন্যতম। একজন ব্যাংকার হিসেবে গুরু দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন এযাবত কাল। সমগ্র বাংলাদেশে বিশিষ্ট সাংবাদিক হিসাবে যাঁর নাম খ্যাতির শীর্ষে নিরন্তর সাফল্য গাথা এমনি এক ব্যক্তিতের অধিকারী আমার শ্রদ্ধাভাজন প্রিয় আনোয়ারুল হক। । সাংবাদিক আনোয়ারুল হকের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ষাটের দশকের শেষ দিকে। আমি তখন সবেমাত্র পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে প্রথম বর্ষ মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়েছি। পাবনা শহর থেকে আমার গ্রামের বাড়ি দুর হওয়ায় আমি তখন জায়গির থাকতাম শহরতলীর গোপাল পুরে। অনুন্নোত এই এলাকায় তখন না ছিল রাস্তা-ঘাট না ছিল জণসাধারনের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা।
এক সময় গোপালপুর, বাহাদুরপুর ও বৈকুন্ঠপুর গ্রামে মহামারি আকারে কলেরা রোগ দেখা দিল। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন মারাও গেল। আক্রান্তের সংখ্যাও দিন দিন বাড়তে লাগল। গ্রামের কয়েকজন যুবককে সাথে নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগে গেলাম। তেমন কোন উপকার পাওয়া গেলনা। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তা ব্যক্তি জানালেন, ঢাকাতে চিঠি লিখেছি ওষুধ এলেই সিনেটারি ইনেস্পেক্টর গ্রামে যাবে কলেরা ভ্যাকসিন দিতে। গেলাম সদর এসডিও র কাছে। তাঁকে বিষয়টি জানানো হলো তিনি মনযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনলেন, বল্লেন ভ্যাকসিনের বড়ই অভাব। তবু আশ্বাস দিলেন দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার। আমরা এখানে ওখানে ঘুরা-ঘুরি করি উদ্ভান্তের মত। পাবনার ডিসির কাছেও যাই। ডি সি মিঃ খোরশেদ আলমের সঙ্গে সাক্ষাত করে তার কাছে বিষয়টি অভিযোগ আকারে তুলে ধরি। তিনি আশ্বাস দিলেন বটে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলোনা। । অগত্যা মাথায় বুদ্ধি এলো বিষয়টি সাংবাদিকদেরকে জানানো দরকার। কিন্তু সাংবাদিক পাবো কোথায়? তখনকার দিনে সংবাদপত্রের সংখ্যা যেমন কম, তেমনি সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা হওয়া ছিল দারুন সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাই সাংবাদিকের খোঁজ করতে লাগলাম। অগত্যা খোঁজ পেলাম পাবনা শহরের নতুন গলিতে প্রেসক্লাব আছে , সেখানে সন্ধ্যা বেলা সাংবাদিকদের দেখা পাওয়া যায়।আমরা কয়েকজন গেলাম প্রেসক্লাবে।
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ছোট্ট একটি কক্ষে প্রবেশ করলাম। কয়েকজন সাংবাদিক বসে আছেন। হারিকেনের আলোতে যাদের দেখা পেলাম এবং পরিচয় হলো তাদের মধ্যে সাংবাদিক রণেশ মৈত্র, আনোয়ারুল হক ও হাসনাতুজ্জামান হিরার কথা মনে আছে।
তাঁদেরকে ঘটনা খুলে বল¬াম। এসডিও বরাবর লেখা দরখাস্তের কার্বন কপি দেখানো হলো। তাঁরাগভীরভাবে পড়লেন এবং সবকিছু নোট করে নিলেন। সেই সাথে কিছু কথা জিজ্ঞাসা করলেন। সবশেষে বল্লেন ঠিক আছে বিষয়টি আমরা দেখছি। দু তিনদিন পর খবরের কাগজে তা ছাপা হয়।
সাংবাদিকদের দ্বারা যে কত দ্রুত কাজ হয় তা আমরা বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলেন কলেরা রোগে আক্রান্ত গ্রামবাসীও। যেন তেলেসমাতি কারবার। ডিসি, এসডিও, জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, মহকুমা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের গমনাগমণ শুরু হয়ে গেল। শুধু কি তাই, এলাকায় এক মাসের জন্য একটি স্বাস্থ্য ক্যাম্প স্থাপন করা হলো। কয়েক দিনের মধ্যেই গোটা এলাকা কলেরা মুক্ত হলো।
এ ঘটনার পর ইত্তেফাক এর রির্পোটার আনোয়ারুল হক ও অন্যান্য সাংবাদিকদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল। লেখালেখির অভ্যাস আমার আগে থেকেই ছিল, তার সাথে সাংবাদিকতার প্রতিও আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। পরবর্তীকালে কর্মজীবনে প্রবেশ করে সরকারি চাকুরির আড়ালে আবডালে নিজেকে পত্রিকার সংবাদদাতা হিসাবে প্রকাশ করার সুযোগ করে নেই। আর সে সুবাদেই সাংবাদিক আনোয়ারুল হকের কাছাকাছি আসার সুযোগ পাই।
১৯৭৮ সালের ৭ মে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। আমার সহপাঠি ও বাল্য বন্ধু আটঘরিয়ার বেরুয়ানের মেজর জেনারেল (অবঃ) এএসএম নজরুল ইসলাম রবির ছোট ভাই আমিরুল ইসলাম রাঙার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আমিসহ কতিপয় উৎসাহি ব্যক্তির সহযোগিতায় আটঘরিয়ার দেবোত্তরে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠিত হলে সৌভাগ্যবশতঃ আমি সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পাই। হয়তো বা সে সুবাদেই পাবনা প্রেসক্লাবের প্রবীণ সাংবাদিক রনেশ মৈত্র, আনোয়ারুল হক,সাংবাদিক রবিউল ইসলাম রবি, হাসনাতুজ্জামান হীরা,, মির্জা শামসুল ইসলাম,শিবজিত নাগ প্রমুখ সাংবাদিকদেরসান্নিধ্য লাভের অধিকতর সুযোগ লাভ করি।
সাংবাদিক আনোয়ারুল হক যখন ইষ্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাংকে (স্বাধীনতা লাভের পর পুবালি ব্যাংক) চাকুরি করতেন তখন থেকেই তাঁর সাথে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিলো।
১৯৯৫ সালের গোড়ার দিকে আমি ঐতিহ্যবাহি পাবনা প্রেসক্লাবের সদস্য পদ লাভ করি। এই সদস্য পদ লাভের ব্যাপারে সাংবাদিক আনোয়ারুল হকের নাম স্বরণযোগ্য। এদিন প্রেসক্লাবেরকার্য নির্বাহি কমিটির সভার দিন ধার্য থাকলেও প্রেসক্লাবের সভাপতি মির্জা শামসুল ইসলাম ঢাকায় অবস্থান করায় সেই মিটিংএ আনোয়ারুল হক সভাপতিত্ব করেন। শুধু তাই নয় প্রেসক্লাবের সদস্য পদ লাভের যে আবেদন করেছিলাম তার পক্ষে সুপারিশও তিনিই করেছিলেন।
২০০১ সালের ৫ জানুয়ারি এ আর সিমেন্টের সৌজন্যে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে পাবনা প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের এক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। এত দুটি দলে ভাগ করা হলে আমি আনোয়ার ভাইএর দলে পড়ি। তবে বর্ষিয়ান এই খেলোয়াড়কে নিয়ে খেলা জমেছিল বেশ ভালোই। ২০০৬ সালের ৮ এপ্রিল তারিখে পাবনা প্রেসক্লাবের বার্ষিক স্পোটর্স এন্ড ফ্যামিলি ডে তে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সম্পাদক দলের মধ্যে আরেকটি ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতির দলের নাম যমুনা এবং সম্পাদকের দলের নাম পদ্মা। আনোয়ার ভাইসহ প্রবীনদের নিয়ে খেলা মনে রাখার মত।
১৯৬১ সালের ১ মে পাবনা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠালাভ করে। সাংবাদিক এ কে এম আজিজুল হক সভাপতি ও সাংবাদিক রনেশ মৈত্র সাধারণ সম্পাদক এবং সাংবাদিক আনোয়ারুলহক ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক। এই প্রেসক্লাবের ৪০বছর পুর্তিতে২০০১ সালের ১২ মে থেকে ১৪ মে তিনদিন ব্যাপি ব্যাপক কর্মসুচি পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এতে প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বিশিস্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট অ্যাডভোকেট রনেশ মৈত্রকে আহবায়ক এবং দৈনিক নির্ভরের প্রধান সম্পাদক সাংবাদিক রবিউল ইসলাম রবিকে সদস্যসচিব করে ৪৪ সদস্য বিশিস্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রবীন সাংবাদিক আনোয়ারুল হক। আমিও (এবাদত আলী) সেই কমিটিতে একজন সদস্য হিসেবে স্থান লাভে সক্ষম হয়েছিলাম।
১ম দিন পাবনা বনমালী ইনস্টিটিউট চত্বরে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাঝ দিয়ে জাতীয় পতাকা এবং প্রেসক্লাবের পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন পাবনা জেলা প্রশাসক সৈয়দ হাসিনুর রহমান এবং প্রেসক্লাবের পতাকা উত্তোলন করেন এমপি অধ্যাপিকা জান্নাতুল ফেরদৌস। ১৪ মে সোমবার বিদায়ি বৈশাখের শেষ বিকেলে সমাপনি দিনেবনমালী মঞ্চে যে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন প্রবীন সাংবাদিক আনোয়ারুল হক। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. প্রফেসর সাইদুর রহমান এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন দেশের খ্যাতনামা সাংবাদিক ও কলামিস্ট দৈনিক প্রভাত এর সম্পাদক কামাল লোহানি। পাবনার সিভিল সার্জন ডা. শাসসুদ্দিন মন্ডল, বিশিস্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট রনেশ মৈত্র, প্রেসক্লাবের সভাপতি আব্দুস সাত্তার বাসু, সাংবাদিক রবিউল ইসলাম রবি, পাবনা পৌরসভার চেয়ারম্যান মোশারোফ হোসেন, সমতার নির্বাহী পরিচালক আব্দুল কাদের প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। এক সময় অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক আনোয়ারুল হকের উৎসবের সমাপনিবক্তব্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের যবনিকাপাত ঘটে। যে স্মৃতি আজো অমলিন।
এইতো গত বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি পাবনা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার অদুরে রিয়া রুপন শিশু পার্কে প্রেসক্লাবের সদস্যদের ফ্যামিলি ডে উদযাপনে অন্য সকলে বিআরটিসির দ্বিতল বাসে গেলেও আনোয়ার ভাইয়ের কারণে সঙ্গে একটি মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন প্রেসক্লাব সম্পাদক আঁখিুনর ইসলাম রেমন। তাতে আনোয়ারুল হক ছাড়াও প্রেসক্লাবের সভাপতি প্রফেসর শিবজিত নাগ ও তার ভাতিজা দীপ্ত নাগ, এইচকেএম আবু বকর সিদ্দিক এবং আমিও যাত্রি ছিলাম। যদিও আনোয়ারুল হক তখন অসুস্থ তবু আমরা তাঁর সঙ্গে সৌহার্দপুর্ণ আলাপ আলোচনা করে পুরো সময় কাটিয়েছিলাম এবং মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলেছিলাম যা আজ শুধুই বেদনার স্মৃতি।
দৈনিক ইত্তেফাকের প্রবীণ সাংবাদিক, ভাষা সৈনিক আনোয়ারুল হক ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি হঠাৎ করেই আমাদের মাঝ থেকে চির বিদায় নিলেন। ৮২ বছর বয়সে তিনি সকলকে শোক সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। খবর পেয়ে ছুটে গেলাম পাবনা শহরে তার শালগাড়িয়ার বাসায়। ৩১ জানয়ারি দুপুর সাড়ে বারোটায় তাঁর মরদেহ পাবনা প্রেসক্লাবের সামনে নেয়া হলে পাবনা জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন, পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস, পাবনা প্রেসক্লাবের পক্ষে সভাপতি প্রফেসর শিবজিত নাগও সাধারণ সম্পাদক আঁখিনুর ইসলামের নেতৃত্বে সাংবাদিকবৃন্দসহ পাবনার সর্বস্তরের মানুষ তার কফিনে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পেসক্লাবের সহ সভাপতি আক্তারুজ্জামান আক্তার ও কামাল আহমেদ সিদ্দিকির আহবানে উপস্থিত সকলকে নিয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে দুহাত তুলে তাঁর রূহের মাগফেরাত কামনায় আমি মোনাজত পরিচালনা করি।
অতঃপর পাবনা শহরের চাঁপা বিবি জামে মসজিদে বা‘দ জোহর তাঁর নামাজে জানাজা অনুষ্টিত হয় এবং আরিফপুর গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।