ফেলে আসা দিন গুলো-২৩

এবাদত আলী

আমি অতি অল্প বয়সেই লেখা লেখিতে মেতে উঠেছিলাম। আর লেখার নেশাটা এমনি পেয়ে বসেছিলো যে, কারো নিষেধ শুনতাম না। বয়সে না পাকলেও হয়তো আমার বুদ্ধিতে পাক ধরেছিলো। তাই তো ভাবতাম কবি সাহিত্যিক হওয়াটা খুবই শুনাম সুখ্যাতির কথা। লেখা পড়া শিখে বি এ এম এ পাশ করে কিইবা হবে জীবনে। পন্ডিত কালিদাস, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মহা কবি কায়কোবাদ প্রমুখ খ্যাতিমান ব্যক্তি গন অতি সামান্য লেখা পড়া শিখেই তো ফেমাস হয়েছেন। বড় বোন মাজেদার মুখে শুনেছিলাম বি এ ক্লাসে কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা পড়ানো হয়। তাই সেই ফরমুলাই হলো আমার জীবনের মূল মন্ত্র। প্রথম প্রথম ছড়া। তার পর কবিতা। কিন্তু কোনটাই আমার মনপুত হয়না। লেখার পর একান্ত নিরিবিলি শুয়ে শুয়ে আমর লেখা ছড়া, কবিতা বার বার পড়তাম। পড়ার পর পছন্দ না হওয়ায় তা ছিড়ে ফেলতাম। আমি তখন যা লিখতাম তাকে কোন মতেই ছড়া- কবিতা বলা যায়না।
কিন্তু তাই বলে তো আর হাল ছেড়ে দেওয়া যাবেনা! আমার মনের মধ্যে কে যেন প্রেরণা যোগায় –তুমি লেখ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রণাথ ঠাকুরের ছেলে বেলার প্রথম লেখা ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ দিয়ে যখন শুরু, এবং
আমসত্ত দুধে ফেলি
তাহাতে কদলি দলি
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে। ”
এ ধরণের কবিতার মাঝ দিয়ে যার বিশ্বজোড়া খ্যাতির সোপান তৈরি সে তুলনায় আমার মত লেখকের ছড়া কবিতার ধাঁচ ধরণতো দুর্বল হবেই হবে। এতে মন খারাপ করে কিংবা হতাশাগ্রস্থ হয়ে লেখা লেখি তো আর বাদ দেওয়া যায়না।
আমার লেখা ছড়া ও কবিতা গুলো একদিন আমার সহপাঠি বন্ধূ আবু সাইদ মোঃ নজরুলের কাছে নিয়ে গেলাম। ওর ডাক নাম রবি। ভারত উপমহাদেশের দু জন খ্যাতিমান কবির নামেই ওর বাবা ওর নাম রেখেছিলেন। চেহারা সুরতে কবিত্ব ভাব থাকলেও ওর ভিতরটা ছিলো চাপা। তা বলে সে কোন দিন আমাকে নিরুৎসাহিত করেনি, বরং আমাকে বরাবর উৎসাহই যুগিয়েছে। যাক তার কাছে ছড়া ও কবিতার খাতা নিয়ে গেলে সে এক কবির গল্প শোনালো। এক কবি,“ কপাল ভিজিয়া গেল – দু নয়নের জলে” এমনি ধরনের কবিতার লাইন লিখে নিয়ে জনৈক প্রতিষ্ঠিত কবির নিকট দেখাতে নিয়ে গেলে কবি ভাবলেন এর উৎসাহ নষ্ট করা ঠিক হবেনা। তাই তিনি পরবর্তী দু লাইন লিখে দিলে কবিতাটি দাঁড়ায়—-
কপাল ভিজিয়া গেল
দু নয়নের জলে
কবিকে উবদা করে ঝুলাও
আম্র গাছের ডালে।
অর্থাৎ দু চোখের পানিতে কপাল ভিজাতে গেলে কবিকে উবদা করে গাছে ঝুলানো ছাড়া আর কিইবা করার থাকতে পারে! প্রকৃত পক্ষে কপালের পরিবর্তে কপোল লিখলেই কেবল গন্ড বেয়ে দু নয়নের জল পড়তো। বন্ধুর ওমন কথা শুনে আমার দারুণ লজ্জাবোধ হলো। নিশ্চয়ই আমার শব্দ চয়নেও এ ধরণের গোলযোগ রয়েছে। তাই অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে রাজশেখর বসুর চলন্তিকা ডিকশনারি কিনে ফেললাম।
তখন আমি সবে মাত্র পাবনা শহরের রাধানগর মজুমদার একাডেমী ( আর, এম, একাডেমী )তে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। গ্রামের বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাকে শহরতলীর একটি গ্রাম গোপাল পুরে জায়গির থাকতে হলো। কানেস্তারা টিনের একটি চার চালা ঘর। ঘরের মেঝেতে পার্টিশন দেওয়া। কুঁদানো পায়ার একটি নড়বড়ে চৌকিতে আমাকে শয়ন করতে হতো। গরমের দিনে কানেস্তারা টিন উত্তপ্ত হয়ে উঠতো। গা পুড়ে যেতো। বৃষ্টির দিনে টিন চুইয়ে পানি পড়ে বিছানাসহ শরীর ভিজে যেতো। আমি ভিজতাম আর বৃষ্টিকে নিয়ে কবিতা লিখতাম। কবি নজরুলের ছেলে বেলার কষ্টের কথা পড়ে পড়ে লজিং বাড়িতে আমার সামান্য কষ্টের কথা ভুলে থাকতাম। ভাবতাম আসলে জীবনটাই তো কষ্টের। মাঝে মধ্যে লম্বা ছুটি পেলে বাড়ি গিয়ে ছোট বোন ঝরনাকে আমার লেখা ছড়া, কবিতা গুলো শুনাবার জন্য কাছে ডাকতাম। ঝরনা কি কন মিঞা ভাই বলে কাছে এলে ওর হাতে কয়েকটি কাঠি লজেন্স ধরিয়ে দিতাম। আমি ছড়া কবিতা পড়ে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতাম কেমন লাগছেরে! ঝরনা বলতো খুউব ভালো। লেখার পর কেউ না পড়ে থাকলে বা কাউকে শোনাতে না পারলে লেখক বর্গই নাকি যাতনায় ছটফট করতে থাকে। ঝরনা নিজে শুনে বাড়ির আর কাউকে যেন না বলে সে জন্য আবার ওকে এক্সটা কাঠি লজেন্স দিতে হতো। তখন বুঝতে পারিনি যে আমার ছোট বোন ঝরনা আমার কবিতাকে নয় কাঠি লজেন্সকেই মজার লাগছে বলতো। আসলে ছোট বেলায় আমি অধিক বোকা ছিলাম কিনা কে জানে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মনেরও যে পরিবর্তন হয় সেটা তখন বুঝতে পারিনি। সে সকল খাতা পত্তর এখন দেখলে হাসি পায়। পন্ডিত কালিদাস, মহাকবি কায়কোবাদ, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো দুরে থাকুক আমার পাশের বাড়ির খেঁদির মা যে পাঁচালী বলে বেড়ায় তার মতোও হয়নি। তখন আমার কাছে সে সবের মূল্যই ছিলো অনেক বেশি। তখন ভাবতাম চেষ্টা করতে করতেই এক দিন হয়ে যাবে। কেউ তো আর এক লাফে গাছের মগ ডালে চড়তে পারেনা। প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিমল মিত্র বলেছেন “লেখকদের ধৈর্য হারাতে নেই।” আমি এই কথার উপর পুর্ন আস্থা রেখে তাই লেখা লেখি অব্যাহত রেখেছি। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।