কাশ্মীর কৃষ্টি ও বিভূষণ

  মাজহার মান্নান , কবি ও প্রাবন্ধিক

রূপের ডালা সাজিয়ে বসে আছো তুমি

তোমা রূপে জুড়ায় প্রাণ, তুমি স্বর্গভূমি

চারু বুকে ঝকঝকে সোনালি রবি

চিত্তে দোলা দিয়ে করেছো কবি।

সাধারন একজন পর্যটককে জিজ্ঞাসা করা হল, কাশ্মির আপনার কেমন লাগলো। ঐ পর্যটক আসলে সাহিত্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ নয়, এবং শব্দ ভান্ডারেও খুব একটা মুন্সিয়ানা নেই। তাই সাতপাঁচ না ভেবেই বলল, ভাই গামলা ভরা সৌন্দর্য। ভদ্রলোকের উত্তর শুনে মনে হল শব্দ ভান্ডারে পান্ডিত্য কম হলেও প্রকাশভঙ্গিতে তিনি দুর্দান্ত। প্রতীকি অর্থে তিনি কাশ্মির রূপের বিশালতাকেই ঈঙ্গিত করেছেন। আমার কাছে কাশ্মিরকে মনে হয়েছে সৌন্দর্যের মহাসাগর, যে সাগরে রূপ লহরীর এক চিরায়ত বিচরন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে সেই অঞ্চলের সংস্কৃতির এক নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। সৌন্দর্য আর সংস্কৃতি মিলে এমন এক অবয়ব সৃষ্টি হয়েছে কাশ্মিরে যেটা শুধু পর্যটকদের মুগ্ধ করে তা নয়, তাদেরকে এক বিস্ময় আর রহস্যের মধ্যে ফেলে দেয়।  কাশ্মির দর্শন শেষে মুগ্ধ হন নি এমন পর্যটক বিশ্বে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটি এমনই এক সৌন্দর্যের আধার যেখানকার স্মৃতি একজন মানুষের সারা জীবন থেকে যায়।  কাশ্মির ভ্রমনের ইচ্ছা বাল্যকাল থেকেই ছিলো। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে সেই সুযোগটি এলো আমার জীবনে। বরফ এবং তুষারপাতের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা থাকায় শীতেই কাশ্মির ভ্রমনের সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমে বিমানে যাওয়ার পরিকল্পনা  করলাম। পরে সেই পরিকল্পনা থেকে সরে এলাম। আমি চেয়েছিলাম ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। তাছাড়া জম্মু থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত দুর্গম পাহাড়ী পথের থ্রিলিং জার্নির মজাটি হাতছাড়া করতে চাই নি। তাই কোলকাতার একটি ট্যুর প্যাকেজের সাথে আমরা বাংলাদেশ থেকে তিনজন যুক্ত হলাম। ২২ ডিসেম্বর কোলকাতার চিৎপুর থেকে জম্মু তাওয়াই এ উঠে পড়লাম। ৪৫ ঘন্টার টার্গেট জার্নি। কিন্তু ৭ ঘন্টা লেট। তাতে কি! আমরা গ্রুপে ৩৫ জন ছিলাম। আনন্দ, আড্ডা আর হৈ চৈ এর কোন কমতি ছিল না। সাথে পর্যাপ্ত খাবারও ছিল। কাজী নজরুলের স্মৃতি বিজরিত সেই আসানসোল রেল স্টেশনে নামলাম কিছুটা ভিন্ন স্বাদ আর অভিজ্ঞতা নিতে। আমাদের জাতীয় কবি কোন জায়গায় তার বাল্যকাল কাটিয়েছেন সেটা নিজ চক্ষে দেখার সৌভাগ্য হল। মনে পড়ে গেল বিদ্রোহী কবির লেখা তার বাল্য স্মৃতি। ” মাখতে মাখতে গমের আটা, ঘামে ভিজছে আমার গা টা।”” ট্রেনের জানালা দিয়ে দুপাশের প্রকৃতি দেখে মন ভরে গেলো। ইতিহাস খ্যাত পাটনা এবং লখনোতে যখন পৌছালাম তখন অনেক কথাই মনে পড়লো। লখনোতে যখন পৌছালাম তখন উপনিবেশবাদের নগ্ন চিত্রটি মনে পড়তে লাগলো। যাহোক ৫২ ঘন্টার লম্বা জার্নি করে আমরা জম্মু পৌছালাম। পাহাড় ঘেরা ঘন সবুজের কোলে গড়ে উঠা জম্মু শহর বেশ ছিমছাম আর পরিপাটি। কাশ্মিরের শীতকালীন রাজধানী জম্মু। জম্মুতে নেমেই একটি ভিন্ন ধরনের আবহাওয়া আর সংস্কৃতির সম্মুখীন হলাম আমরা। কনকনে ঠান্ডায় একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা হল। আমাদের ট্যুর পরিকল্পনায় জম্মুর কাটরাতে ২ দিন থাকার সিদ্ধান্ত ছিল। কাটরাতে হিন্দুদের পূণ্যস্থান বৈঞ্চব মন্দির অবস্থিত। কাটরা এক অদ্ভূত শহর। মাছ মাংশতো দূরের কথা, ডিমও সেখানে নিষিদ্ধ। একেবারেই ভিন্ন সংস্কৃতি।

ভারতের জম্মু কাশ্মিরের ছোট্ট একটি জায়গা কাটরা। এটি হিন্দু ধর্ম অনুসারীদের জন্য একটি পূণ্য স্থান। বৈষ্ণব মন্দির এখানেই অবস্থিত। খুব সকালে কাটরার রাস্তায় বের হলাম। ভাললাগার মত একটি জায়গা। জম্মু থেকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে ৪৫ কিলো এলেই কাটরা শহর। প্রচুর হোটেল এখানে। পর্যটকদের কেনাকাটার জন্য আছে দারুন ব্যবস্থা। মানুষ গুলি বেশ আন্তরিক। এখানে মাছ, মাংস, এমন কি ডিমও খাওয়া যাবে না। সম্পূর্ণ ভেজ হতে হবে। সবজি, ভাত আর রুটি ছাড়া তেমন খাবার নেই। তবে এখানকার খাবার প্রস্তুত প্রনালী দারুন। সারারাত এখানে মার্কেট খোলা থাকে। বাহারি খাবারে ডালা সাজিয়ে বসে থাকে দোকানিরা। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শহর। সকাল ৫ টা থেকে হাজার হাজার হিন্দু ধর্মেের অনুসারীরা প্রকান্ড পর্বতের চূড়ায় উঠে বৈষ্ণব দর্শনের জন্য। সময় লাগে ৬ থেকে ৭ ঘন্টা।কাটরা থেকে শ্রীনগর ৩০০ কিলো। নয়ন জুড়ানো পাহাড়ী রাস্তা, বরফ আর ১০ কিলো দীর্ঘ পাহারী টানেলের অভিজ্ঞতা আমাদের হল। ট্যূর কোম্পানির নিজস্ব কুক রান্না করে খাবার সরবরাহ করেছিল আমাদের। কাটরা থেকে ২৬ ডিসেম্বর আমরা শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। এক সুদীর্ঘ দুর্গম পাহাড়ী পথ। ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি চলছে তবুও পথের যেন শেষ হয় না। কাজী নজরুলের কবিতার সেই লাইনগুলি মনে পড়ে গেলো– ” দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাপার”।   পাহাড়ী আকাঁবাঁকা পথে মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে ৬ ঘন্টা সময় কেটে গেলো বুঝতে পারলাম না। শুভ্র পাহাড়ের চূড়া, পাহাড়ের বাঁকে বয়ে চলা লেকের বরফ গলা নীল স্বচ্ছ পানির কলতান আর ঝর্ণার গর্জন এক রোমাঞ্চকর ভুবনে নিয়ে গেলো আমাদের। সুউচ্চ পাহাড়ের গায়ে লক্ষ মানুষের বাস। কি করে সম্ভব? ভাবতেই গা শিউরে উঠছিলো। কি কঠিন আর চ্যালেঞ্জিং জীবন পাহাড়ীদের! জম্মু থেকে শ্রীনগর যেতে বেশ কয়েকটি টানেল পার হতে হয়। সেগুলির মধ্যে দুটি টানেলের দৈর্ঘ প্রায় ২০ কিলোমিটার। টানেলে যখন গাড়ি দ্রুত ছুটে যাচ্ছিলো তখন গা ছমছম করছিলো। আধুনিক এবং সাহসী প্রকৌশলের এক অনন্য নজীর টানেলগুলি। জম্মু থেকে বানিহাল পর্যন্ত দুর্গম পাহাড়ী সড়ক। বানিহাল থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত রেল পথ রয়েছে। শ্রীনগরে প্রবেশের ৩০ কিলোমিটার আগে থেকেই এক ভিন্ন ধরণের সংস্কৃতি চোখে পড়বে। কাশ্মিরের বাড়ি ঘর গুলিতে কিছুটা পশ্চিমা ধাঁচ লক্ষ্য করা গেছে। চোখ জুড়ানো নানা নকশায় তৈরি এসব বাড়ি। বিস্তীর্ণ সমতল ভূমিও চোখে পড়েছে যেখানে মহা মূল্যবান কেশর চাষ হয়। এই কেশরের আরেক নাম জাফরান। ২ লাখ টাকা কেজি এই জাফরানের একটি টুকরো চায়ের কাপে দিলে এক ভিন্ন স্বাদের চা উপভোগ করা যায়। বিরানীতে জাফরানের ব্যবহার সেই সুপ্র্চীন কাল থেকে চলে আসছে। শ্রীনগর থেকে পেহেলগাম সড়কের দু পাশে সারি সারি আপেল বাগান। গাছে ঝুলে থাকা আপেলগুলি পর্যটকদের মুগ্ধ করে। শ্রীনগরের প্রবেশ পথে অসংখ্য ক্রিকেট ব্যাটের দোকান, কারখানা ও শোরুম চোখে পড়বে। খুব সুলভ মূল্যে এসব ব্যাট ক্রয় করা যায়। ব্যাট তৈরির জন্য যে কাঠ লাগে সেটা কাশ্মিরে প্রচুর হয়। সরাসরি কারখানা থেকে পছন্দসই ব্যাট কেনা যায়। আখরোট, বিভিন্ন ধরণের বাদাম, বিভিন্ন ধরনের মশলার জন্য কাশ্মির বিখ্যাত। বাহারি ফলের পসরা সাজিয়ে বসে থাকেন দোকানিরা। কাশ্মির মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হওয়ায় এখানে ইসলামী সংস্কৃতির প্রাধান্য বিদ্যমান। শ্রীনগরের খায়েমচকে বাহারি খাবারের স্বাদ নিতে পর্যটকরা ভুল করেন না। সন্ধ্যার পর খাবার হোটেলগুলিতে এক অন্যরকম আবহ তৈরি হয়। কাশ্মিরী খাবারে মশলার পরিমান বেশি থাকে তবে চরম সুস্বাদু। শ্রীনগরের লালচকে কেনাকাটার জন্য রয়েছে হাজারও দোকান। কি চাই পর্যটকদের? সকল ধরণের পোশাক ও কসমেটিকস  এখানে পাওয়া যায় সুলভ মূল্যে।

কাশ্মিরের ঐতিহাসিক একটি স্থান হল ডাললেক। টুরিস্টদের এক অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র। তিনদিকে সুউচ্চ পর্বত মালা বেস্টিত ডাললেক সাধারন কোন লেক নয়। এর অবস্থান এবং প্রকৃতি অনুযায়ী এটাকে একটি মিনি সাগর বলা যায়। ১৪ কিলো লেকটির আয়তন। গভীরতা অনেক এবং স্বচ্ছ পানি। এই লেকের বিবরন অল্প কথায় দেয়া সম্ভব নয়। তবু কিছু চিত্র তুলে ধরছি। এটি কাশ্মিরের প্রাণ। বলতে গেলে কাশ্মিরের ৯০ শতাংশ ব্যবসা এই লেক কেন্দ্রিক। এই লেকে প্রায় ৩০ হাজার হাউজবোট আছে যেগুলি হোটেল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। প্রায় ২ হাজার শিকারা ( ছোট নৌকা) আছে। লেকের চারদিকে কয়েক হাজার দোকান। কিছু ভাসমান দোকান আর কিছু স্থায়ী। লেকের প্রবেশ পথ থেকে একটু আগালে সুউচ্চ পর্বত মালার পিকে একটি মন্দির অবস্থিত যেখানে গাড়ি নিয়ে উঠা যায়। গাড়িতে ২০ মিনিট লাগে। ঘুরে ঘুরে উঠে গাড়ি এবং গাড়ি থেকে লেকের সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। এই লেকের সাথেই মোঘল গার্ডেন, নেহেরু গার্ডেন, নিশাত গার্ডেন, শালিমার গার্ডেন, টিউলিপ গার্ডেন অবস্থিত। এই গার্ডেন গুলির সৌন্দর্য বলে শেষ করা যাবে না। লেকে হাজার হাজার পাখি যা আপনার নয়ন জুড়াবে। লেকের চারদিকে শতশত খাবারের দোকান। দারুন দারুন খাবার।  এই খাবার গুলি আমাদের দেশে নেই। দারুন সুস্বাদু। শ্রীনগর শহরটি অনেকটা সমতল ভুমির উপর হলেও ডাললেক কিন্তু পাহাড় বেষ্টিত। লেকের কোলঘেষে রাস্তাটিকে মনে হবে ইউরোপের কোন রাস্তা। শ্রীনগরের লালচক মার্কেটে দুনিয়ার সব কিছু পাবেন। তবে লেকের ধারে শাল চাদরের গ্যারেজ আর ডিপো রয়েছে। কাশ্মিরের খাবার গুলি অনন্য। মাংশের শত ধরনের রান্না পাবেন। দারুন দারুন হোটেল আছে। কাশ্মিরের মানুষ খুব আন্তরিক। এখানকার প্রতিটি মানুষ ফর্সা আর সুন্দর। রমনীদের কথাতো বলাই বাহুল্য। শিকারায় চড়ে লেকের স্বচ্ছ জলে ২/৩ ঘন্টা কাটিয়ে দেয়া যায় যা এক রোমাঞ্চকর অনুভূতির জন্ম দেয়। শিকারায় চড়ে যখন পর্যটকরা ঘুরে তখন ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীরা তাদের নিজস্ব নৌকা নিয়ে হাজারও পদের পন্য বিক্রি করতে আসে। সেটা এক ভিন্ন জগত। পর্যটকদের নৌকার সাথে সাথে তারা তাদের নৌকা চালায় এবং পর্যটকদের অনুপ্রেরণা যুগায় তাদের পন্য কিনতে। আবার শিকারার মাঝি খুব কৌশলে পর্যটকদের ভাসমান মার্কেটে তার পছন্দের দোকানে নিয়ে যান। সেখানে তার কমিশন থাকে। কাশ্মিরের স্থানীয় জনগণ এক বিশেষ ধরণের ঐতিহ্যগত পোশাক পরে থাকে যেটা আলখাল্লা হিসাবে পরিচিত। অনেকটা পাঞ্জাবির মত। তবে আলখাল্লার ভিতরে তার তাদের হাত দুটি লুকিয়ে রাখে যেটা তাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি। কাশ্মিরের জনগণ খুব অতিথি পরায়ন এবং আন্তরিক। পর্যটকদের সাথে তারা খুবই সৌজন্য রেখে কথা বলে। তাদেরকে খুব বন্ধু সুলভ মনে হয়েছে আমার। প্রচন্ড সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় কাশ্মিরীদের। অনেক অস্বচ্ছল ব্যাক্তি রয়েছে সেখানে। কিন্তু তাদের এক বিশেষ ধরণের ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে। কোন ভিক্ষুক আমার চোখে পড়েনি। তারা শত কষ্ট করে জীবন নির্বাহ করবে কিন্তু ভিক্ষা করবে না। কাশ্মিরে রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা প্রায়ই শুনে থাকি।  কিন্তু পর্যটকদের উপর সেটার কোন প্রভাব পড়ে না। অনেকে ভয় পান কাশ্মির ভ্রমন করতে। আসলে ভয়ের কিছু নেই। কাশ্মির ভ্রমন আমার কাছে যথেষ্ট নিরাপদ মনে হয়েছে। আমি আগেই বলেছি কাশ্মির সংস্কৃতির সাথে সৌন্দর্যের এক অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হয়েছে। কাশ্মিরের সৌন্দর্য শুধু পাহাড়, লেক,  ঝর্ণা, বরফ, ফুল, ফল আর গাছপালার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কাশ্মিরের মানুষগুলির আচরন, আতিথিয়তা, তাদের আন্তরিকতা, ভাষা, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, খাবারের বৈচিত্র্য সহ নানা বিষয় কাশ্মিরকে সৌন্দর্যের স্বর্গভূমিতে পরিনত করেছে।

কাশ্মিরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঋতুভেদে বৈচিত্র ধারণ করে। কোন ঋতুতে কাশ্মির বেশি সুন্দর এটা নিয়ে পর্যটকদের মধ্যে রয়েছে নানা গুঞ্জন। শীতে কাশ্মির এক সাদা শুভ্র রূপ ধারণ করে যা স্নো প্রেমিদের তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। যারা ফুল পছন্দ করেন তারা বসন্তে কাশ্মির ভ্রমন পছন্দ করেন। কাশ্মিরকে ফুলের স্বর্গও বলা যায়। যারা আপেল ও জাফরান সহ নানা ফল মূলের দৃশ্য উপভোগ করতে চান তারা শরতে কাশ্মির ভ্রমন করে থাকেন। আমার যেহেতু তুষারের প্রতি দুর্বলতা আছে তাই শীতকালকেই কাশ্মির ভ্রমনের উপযুক্ত সময় মনে করেছি আমি। সমগ্র কাশ্মিরই অপরুপ সুন্দর। তবে তিনটি স্পট এক অনন্য সৌন্দর্যে ভরপুর। সেগুলি হল- গুলমার্গ, সোনামার্গ এবং পেহেলগাম। আগেই বলে রাখি কাশ্মির বলতে শুধু শ্রীনগর অঞ্চলকে বুঝায় না। লাদাখকেও কাশ্মির বলা হয়। কাশ্মিরের দুটি অংশ। একটি হল গগনচুম্বী সাদা ও ঘিয়ে রং এর পা্থরের পাহাড়ের বিস্তৃত অঞ্চল যেটার শুরু যোজিলা পাস থেকে এবং সেটা কার্গিল দিয়ে লাদাখের শেষ সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। ২০১৭ সালে আমি লাদাখ ভ্রমন করেছিলাম। লাদাখ থেকে গাড়িতে মানালি এসেছিলাম তিন দিনে। সেটা ছিল এক ভয়ংকর এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। কাশ্মিরের আরেকটি অংশ হল সবুজ অংশ যেটার মধ্যে শ্রীনগর, গুলমার্গ, সোনামার্গ ও পেহেলগাম রয়েছে। লাদাখের পাহাড় গুলি এতই উচুঁ এবং পাথুরে যে অক্সিজেন ও নরম মাটির স্বল্পতায় সেখানে গাছপালা নেই। কিন্তু গুলমার্গ, সোনামার্গ আর পেহেলগামে ঘন সবুজ গাছপালার চাদরে পাহাড়গুলি আবৃত হওয়াতে সেখানকার সৌন্দর্য আলাদা। ২৮ ডিসেম্বর আমাদের সোনামার্গ ভ্রমনের সিডিউল ছিল। রাতে শ্রীনগরে মাইনাস ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছিল এবং তখন সোনামার্গের তাপমাত্রা দেখাচ্ছিলো মাইনাস ১৪ ডিগ্রি। আমরা সবাই ভয়ে ছিলাম এত কম তাপমাত্রায় কিভাবে যাবো। কিন্তু সকালে দৃশ্যপট বদলে গেলো। ঝকঝকে সোনালি রোদে কাশ্মিরের আকাশ এক অদ্ভূত সৌন্দর্য ধারণ করলো। আমরা সবাই পুলকিত হলাম। প্রকান্ড বরফের মুখোমুখি হবো এমনটি ভেবে বারবার রোমাঞ্চিত হলাম। যতই সোনামার্গের কাছাকাছি আসছিলাম ততোই চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিলো। মনে মনে ভাবছিলাম এমন সৌন্দর্য দেখার জন্যই তো এত অপেক্ষা। স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করতেই সবাই ও মাই গড,  ও মাই গড বলে আনন্দ চিৎকার করতে লাগলো।  ঘন সবুজের চাদরে মোড়া পাহাড়ে শুভ্র তুষারের খেলা সত্যি আমাদের স্বপ্নলোকে নিয়ে গেলো। বরফ,ভাসমান মেঘ, স্বচ্ছ নীলাভ জলের লেক আর সোনালী রোদের মিলন মেলায় পর্বতমালা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো আমাদের। পাহাড়ের গায়ে সারি সারি সবুজ বৃক্ষরাজিকে মনে হচ্ছিলো শুভ্র সমুদ্রে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছবি তোলার নেশা বরাবরই ছিলো। কিছু স্মৃতি সংরক্ষণ করলাম ক্যামেরায়। সাহসী পর্যটকরা বরফে শুয়ে, বসে, বরফ হাতে ধরে এবং নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে লাগলো। এত বরফের মাঝেও চা, কফি সহ বাহারি খাবারের কোন কমতি ছিল না। সোনামার্গে পৌছানো মাত্র অশ্ববাহীরা এবং স্থানীয় গাড়ি চালকেরা কথার ফুলঝুরি নিয়ে হাজির। তাদের কথার জালে বন্দি হয়ে ঘোড়ায় না চড়ে পারলাম না। তবে বরফের উপরে ঘোড়ায় চড়ে কিছুটা পথ পাড়ি দেয়া বেশ দোলা দিয়েছিলো মনে। নিজেকে রাজা রাজা মনে হচ্ছিলো। বরফ সম্পর্কে আমাদের অনেকের ভুল ধারণা আছে। অনেকে মনে করে যে বরফ মানেই হাড় কাঁপুনি ঠান্ডা আর কষ্ট। মোটেও তা নয়। তুষার আবৃত অঞ্চলে যদি রোদ থাকে এবং বাতাস না থাকে তবে তেমন কোন শীতই অনুভব হবে না। আমি বেতাবভ্যালিতে শুধু একটি শার্ট পরে দীর্ঘ সময় ঘুরাঘুরি করেছি,  ছবি তুলেছি, বরফ হাতে ধরে সময় কাটিয়েছি। কিন্তু রোদ না থাকলে এবং বাতাস থাকলে তীব্র ঠান্ডা অনুভব হবে। যাহোক, বরফে যারা যায় তারা গরম পোশাকেই যায়। তাই কোন অসুবিধা হয় না। সোনামার্গের সৌন্দর্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়েছিলাম কিছুটা সময়ের জন্য। এমন সৌন্দর্য প্রকাশের মত শব্দ ভান্ডার আমার ছিলো না। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাইতো আবেগপ্রবণ হয়ে বলেছিলেন তাকে যেন এই ভূস্বর্গে দাফন করা হয়। আমরা যোজিলা পাস পর্যন্ত যেতে পেরেছিলাম। নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে আমরা সবাই মুগ্ধ হলাম। সোনামার্গের সৌন্দর্য চোখে না দেখে শুধু  ভাষায় প্রকাশ করে সেটা বুঝানো সম্ভব নয়। কোন স্থানে ভ্রমনে গেলে সেই স্থানের ব্যবস্থাপনা কেমন সেটা খেয়াল করার চেষ্টা করি। আমাদের দেশের পর্যটন কেন্দ্র গুলিতে অব্যবস্থাপনা পরতে পরতে দৃশ্যমান হয় এবং নিরাপত্তা নিয়েও সংশয় থাকে। কিন্তু কাশ্মিরের স্পটগুলির ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তায় সত্যি মুগ্ধ হলাম। ওমন একটি অচেনা দুর্গম অঞ্চলে একবারের জন্যও নিজেদের অনিরাপদ মনে হয় নি। বরফের মাঝে কেশরের ( জাফরান) এক কাপ চা পানের সুযোগ পেলাম। আহ! সে কি অনুভব! সেখান থেকে আমার আসতে মন চাইছিলো না। কিন্তু ট্যুর ম্যানেজারের হোটেলে ফেরার পুনঃপুন তাগিদ সৌন্দর্য উপভোগে কিছুটা ছেদ ফেলেছিলো। কার মন চায় স্বপ্নরাজ্য থেকে এত দ্রুত বিদায় নিতে। সোনামার্গের স্থানীয় লোকদের সংস্কৃতি বুঝার চেষ্টা করলাম। কঠোর সংগ্রামী জীবন হলেও ওদের মনে এক ধরনের স্বস্তি খুঁজে পেলাম। ওরা মনে করে ভূস্বর্গের অধিবাসী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টিকর্তা তাদের দিয়েছে। ভ্রমন মানে শুধু ঘুরে বেড়ানো নয়। ভ্রমনে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়, বহুমাত্রিক সংস্কৃতির সানিধ্য লাভ করা যায়। আমার কাছে পুরো সোনামার্গকে মনে হয়েছিলো শিমুল তুলার চাদরে ঢাকা একটি প্যারাগনিক ভূমি। মনে হচ্ছিলো নব বধূ ঘোমটা টেনে বরের জন্য বসে আছে। কখন বর এসে বলবে, ওগো তোমার রূপ যে আমাকে টেনে এনেছে। বধূ হেসে বলবে, এই স্বর্গোদ্যানে তোমাকে স্বাগত হে প্রিয়। যাহোক বেলা পড়ে আসায় শীত বায়ুর দাপট টের পাচ্ছিলাম। বরফের উপর দিয়ে দু কিলোমিটার হেটে গিয়ে নির্ধারিত গাড়িতে উঠলাম। মনে পড়ে গেলো নজরুলের সেই কবিতার লাইন— ”আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই, ওই পাহাড়ের ঝর্ণা আমি ঘরে নাহি রই।”

রাতে শ্রীনগরে হাড় কাঁপুনি ঠান্ডা শুরু হল। কোন মতে ডিনার সেরে রুম হিট করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ শুভ এসে বললো দাদা, কাল ২৯ ডিসেম্বর গুলমার্গে স্নোফল হওয়ার পূর্বাভাস আছে। তার কথা শুনে এক ভিন্ন কল্পনার জগতে চলে গেলাম। সত্যি স্নোফল হবে! এটা পাওয়াতো মহা সৌভাগ্যের বিষয়। শীতে কাশ্মির গেলে বরফ সবাই দেখতে পারবে। কিন্তু স্নোফল পাওয়ার সৌভাগ্য সবার হবে না।  ট্যুর ম্যানেজার রাতেই বলে রেখেছে সকাল আটটায় গুলমার্গের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছাড়বে। সময়মত গাড়ি ছাড়লো। কিন্তু সূর্য মামা লাপাত্তা। তবে কি স্নোফলের পূর্বাভাস সঠিক! বড্ড ঠান্ডা টের পাচ্ছিলাম। হঠাৎ ট্যুর ম্যানেজার সজল দাদা দৌড়ে এলো। আমাদের গাড়ি গুলমার্গের পাহাড়ে উঠতে পারবে না, নিষেধ আছে। তাই লোকাল গাড়ি নিতে হল। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতেই শুরু হল স্নোফল। ও মাই গড! গায়ের উপর তুলার মত বরফ টুকরো পড়ছে। আহ! কি আনন্দ। ক্রমেই বাড়তে লাগলো। মূহূর্তেই স্বপ্নের জগতে চলে গেলাম। আবার সজল দাদার আনন্দ চিৎকার– আপনারা দ্রুত ওভার কোট আর বুট ভাড়া করেন। গুলমার্গের পাহাড় পিকে প্রচন্ড স্নোফল শুরু হয়েছে। দেরি না করে দ্রুত বুট আর কোট ভাড়া করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়ি ছুটতে শুরু করলো। ২০ কিলোমিটার পাহাড়ী রাস্তায় শুধু উপরে উঠতে হবে। চরম থ্রিলিং জার্নি শুরু হল। কিন্তু স্নোফল চলাতে সড়কে অল্প সময়েই বরফ জমে গেলো। গাড়ির চাকা কয়েকবার স্লিপ করলো। আমাদের অনুরোধে চালক গাড়ির চাকায় শিকল বাঁধলো যেন স্লিপ না করে। এরপর ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো গাড়ি। শুরু হল আমাদের হেভেনলি বিউটি দর্শন। গুলমার্গের পাহাড়গুলির গাছ ভিন্ন ধরনের। প্রকান্ড সব পাইন গাছ সহ নানা জাতের গাছ এবং গাছের নিচে সাদা তুষারের  গালিচা। গাছের পাতায় বরফকুচির পতন দোল দিয়ে যাচ্ছিলো যেন নাচুনি সাদা বুড়ির অবয়ব ধারণ করলো। তুষারপাত যখন চলে তখন প্রকৃতির সব কিছুই যেন হিম হয়ে আসে। গুলমার্গের পাহারী রাস্তায় শত শত বাঁক এবং প্রকৃতির সব সৌন্দর্য মনে হয় এখানে এসে ভিড় জমিয়েছে। যতই উপরে উঠছি ততোই উত্তেজনা আর শিহোরনের মাত্রা বাড়ছিলো। স্নোফল কোনমতেই থামছে না। চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। মনে হচ্ছিলো যেন আমরা শুভ্র সাগরে ঢেউয়ের তালে ভেসে চলেছি। চোখে পড়লো একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা গুলমার্গ ১ কিলো। ওয়াও! স্বপ্ন তবে সত্যি হচ্ছে! মনে এলো দু লাইন কবিতা—-

” How sweet, how gray iceberg

   Lovely & White Gulmarg.”

গুলমার্গে প্রবেশ করেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। একি! এতো বরফের মহাসাগর! কোথায় পার্কিং করবে গাড়ি! এত বরফে হাটবো কিভাবে? ঘন বরফের কারণে গাড়ি আর আগাতে পারলো না। নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। বরফে পা ঢুকে যেতে লাগলো। ভাগ্যিস বুট পরে ছিলাম। ধীরে ধীরে বরফ সাগরে হাটছিলাম। মনে হচ্ছিলো চন্দ্রপৃষ্ঠে অভিযাত্রী হিসাবে অবতরন করেছি। স্নোফলের মাত্রা তখন আরো বেড়েছে। ঘন স্নোফলে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো। শাহীন ভাই তাড়া দিলো গন্ডোলা রাইডের দিকে যেতে। সময় খুব কম। কিন্তু কিভাবে যাবো সেখানে! প্রায় এক কিলো পথ। হেটে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। বরফ সাগরে এক কিলো হাটা কি যেনতেনো ব্যাপার! কিন্তু আমাদের আবেগকে দমানোর সাহস কার! হেটেই রওনা হলাম হিমশৈলের বুক চিরে। গন্ডোলায় গিয়ে দেখি আমরাই শেষ যাত্রী। আমাদের চারজনকে নিয়ে গেট বন্ধ করে দিলো। ইস! কি কপাল! এক মিনিট দেরি হলে গুলমার্গের রোপওয়েতে চড়ার সুযোগ অধরাই থেকে যেতো। চেপে বসলাম গন্ডোলায়। দোল দিতে দিতে উপরে উঠছে তার বেয়ে। আহ! মনে হল মহাকাশ অভিযানে বের হয়েছি। আমাদের পদতলে মর্তের সব সৌন্দর্য যেন খেলায় মেতে উঠেছে। নিজ হৃদ কম্পে এক স্বর্গ অনুভূতি নাড়া দিলো। এত ভারী স্নোফল যে গন্ডোলার সেকেন্ড ফেজ বন্ধ করে দিয়েছে। ফাস্ট ফেজে নেমে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। কল্পনাতেও আসেনি এমন সৌন্দর্য নিজ চোখে দেখবো। শুধু চোখ নয়, পুরো পঞ্চ ইন্দ্রিয় ধন্য হলো। মনে পড়লো দুটি লাইন–

” তোমারে দেখিবো করিছিনু পণ

  ধন্য ধন্য আজি মোর দেহ মন। ”

সাগর তীরে পর্যটকদের ছুটাছুটি করতে দেখেছি, স্নান করতে দেখেছি। কিন্তু বরফে স্নান — এটা কি কল্পনা করা যায়। ঠিক তাই চোখে পড়লো গুলমার্গে। শতশত পর্যটক তীব্র শীতে বরফে শুয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে। শুয়ে, বসে, হামাগুড়ি দিয়ে ছবি তুলছে। মনে হল তারা সবাই আবেগের কাছে পরাজিত। আমি গড়াগড়ি দেয়ার সাহস করলাম না। কেননা ডিজিটাল বোর্ডে চোখ পড়তেই হতভম্ব হয়ে গেলাম। তাপমাত্রা শো করছে মাইনাস ১০। কিন্তু কোন এক পর্যটকের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে গেলাম নরম কোমল শ্বেত বরফে। সুযোগ হাতছাড়া না করে গড়াগড়ি দিলাম। সে এক অন্যরকম অনুভূতি হল। গন্ডোলা কর্তৃপক্ষ বাঁশি হুইশাল দিচ্ছিলো এবং সতর্ক ঘন্টা বাজিয়ে যাচ্ছিলো দ্রুত নিচে নামার জন্য। নিচে নেমে গাড়ির কাছে আসতেই আতকে উঠলাম। শত শত গাড়ির সিরিয়াল যারা ফেরার জন্য প্রস্তুত। প্রতিটি গাড়িতে তুষার পড়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে সে গুলিকে এক একটা বরফ খন্ড মনে হচ্ছিলো। ৪.৩০ এ গাড়িতে উঠলাম কিন্তু গাড়ির চাকা ঘুরে না। খবর এলো রাস্তায় শত শত গাড়ি বরফে আটকা পড়েছে। অর্ধশতাধিক গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। এমনিতেই প্রচন্ড ঠান্ডা, তদুপরি ওমন খবরে গা হিম হয়ে আসতে লাগলো ভয়ে। কি আছে আমাদের ভাগ্যে! আমাদের গাড়িতে শিশু ও মহিলা সহ ৯ জন ছিলাম। গাড়িতে উঠার পর এক জায়গাতেই ২ ঘন্টা কেটে গেলো। চারিদিকে ঘন অন্ধকার নেমে এলো। কিন্তু স্নোফল চলছেই। সকল প্রকার নেটওয়ার্ক স্তব্দ হয়ে গেলো। ২০ কিলোমিটার রাস্তা নামতে আমাদের ১৩ ঘন্টা লেগে গেলো। সারারাত তুষারপাতের মধ্যে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় আমাদের সময় কাটলো ভয়ংকর পাহাড়ী রাস্তার বাঁকে ছোট্ট একটি গাড়িতে। ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৭ টায় গুলমার্গ থেকে এক শ্বাসরুদ্ধকর যাত্রা শেষে  শ্রীনগর হোটেলে ফিরলাম। সবার চোখে ঘুমের তীব্র নেশা। কিন্তু শিডিউল অনুযায়ী বেলা ১১ টার মধ্যে আমাদের পেহেলগামের উদ্দেশ্যে বের হতে হবে। কোন রকমে নাস্তা সেরে ঘুমোতে গেলাম। ঘুমের ঘোরে টের পেলাম দরজায় খটখট শব্দ। গাড়ি রেডি তাই পেহেলগামের উদ্দেশ্যে বের হতে হবে। ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হলাম কিন্তু ক্লান্তির ছাপ চোখে মুখে স্পষ্ট। শ্রীনগর থেকে পেহেলগাম ৯৮ কিলোমিটার। পাহাড়ী ৯৮ কিলো জার্নির ধকল একেবারে কম নয়। কিন্তু চিত্তহারী মনোহর সৌন্দর্যে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। একি ভয়ংকর সুন্দর! কোন ভাষা দিয়ে এমন রুপের বর্ণনা দেবো। সোনামার্গ দেখে ভেবেছিলাম এমন সৌন্দর্য কাশ্মিরে হয়তো আর নেই। কিন্তু যখন গুলমার্গ গেলাম সেটা আরো সুন্দর। ভাবলাম এটাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু পেহেলগামে এসে বিমোহিত হলাম। পেহেলগামের রূপ সুধার জাদুতে অনুরক্তি ঘটলো আমাদের। পেহেলগামেও প্রচুর তুষারপাত হয়েছে। থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষে পেহেলগামকে অপরূপে সাজানো হয়েছে। সাদা ধবধবে বরফের মাঝে আলো ঝলমলে পেহেলগাম রূপের রাণীতে পরিনত হয়েছে। সুরের ঝংকারে আর রঙিন বিজলী বাতির ডামাডোলে পেহেলগামের রিসোর্টগুলি যেন স্বপ্নপুরীতে পরিনত হয়েছে। তাপমাত্রা মাইনাস ৪, তবুও মনে হল পেহেলগামের রাস্তায় আরো কিছুক্ষণ থাকি। রাতে হোটেলে উঠেই জানতে পারি পানির তীব্র সংকট। ঠান্ডায় পাইপের ভিতর পানি জমে গেছে। কোন রকমে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে উঠে হোটেল কক্ষের জানালা খুলতেই চক্ষু চড়ক গাছ। মেসমারাইজিং বিউটি চোখে ও মনে এক অন্য রকম প্রশান্তি এনে দিলো। আমাদের হোটেল সহ চারপাশের হোটেল ধবধবে শুভ্র বরফে ঢাকা। পেহেলগামের রিসোর্টগুলি বড় বড় পাহাড় বেষ্টিত। সব গুলি পাহাড় সাদা চাদরে আবৃত হয়ে এমন এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে যেটা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। বরফে মুড়ানো গিরি শৈলে রূপালি মেঘের খেলা দেখে মনে হল সাদা পরীদের নৃত্য চলছে। এমন রূপ দর্শনে সহজাতভাবেই দুটি চরণ মনে এলো—

” শ্বেতবর্ণ শুক্ল হে মহীধর

  স্মৃতিপটে থেকে যাবে নাহি হবে পর।”

সকালের নাস্তা করে আমরা বেতাবভ্যালির উদ্দেশ্যে বের হলাম। ইউটিউবে বেতাবভ্যালি দেখেছি। কিন্তু বাস্তবের বেতাবভ্যালি এক অন্যরকম একটি জায়গা। পেহেলগাম থেকে বেতাবভ্যালি যাওয়ার যে রাস্তা এবং রাস্তার চারপাশের যে সৌন্দর্য সেটা জীবনে কখনই ভুলে থাকা যাবে না। সানি দেওয়ালের বেতাব ছবির শ্যুটিং এখানে হয়েছিলো বলে এই ভ্যালির নাম বেতাবভ্যালি। জাবো হাম জাওয়াহোঙ্গি গানের দৃশ্য ধারণ এখানেই হয়েছিলো। এছাড়াও বাজরাঙ্গী ভাইজান সহ বহু জনপ্রিয় ছবির দৃশ্যায়ন এখানে হয়েছিলো।

এক কথায় বলতে পারি বেতাবভ্যালিতে একবার প্রবেশ করলে আর সহজে বের হতে ইচ্ছা করবে না। জায়গাটি এতই মহোনীয় যে সেখানে বসে থাকতে যে কারো ভাল লাগবে। পুরো ভ্যালি একটি বরফের পাটাতনে পরিনত হয় যার উপর দিয়ে হাটতে খুব ভাল লাগে। সারি সারি বৃক্ষের মাঝে শ্বেত তুষার এবং সেটার উপর সোনালি সূর্যের ঝিলিক এক কুহকী পরিবেশ তৈরি করে। পুরো ভ্যালিটি সম্মোহনী এবং মনোহর শোভনে মুগ্ধকর এক বাতাবরণ। ভ্যালির মাঝখান দিয়ে প্রবাহমান স্বচ্ছ জলধারা। এই পানির উৎস রিডার নদী। পাহাড়ে জমা বরফ গলে পানি রিডার নদীতে প্রবেশ করে। বরফের মধ্য দিয়ে পানির প্রবাহ নয়ন জুড়িয়ে দেয়। বেতাবভ্যালির দৃশ্যে আমাদের হৃদয় বশীভূত হল। 

ট্যুর ম্যানেজার হেসে বলল, দাদা রূপ লহরী বাইসারেনে যেতে হবে। আরুভ্যালি এবং চন্দনওয়ারিও মিস করা যাবে না। ছুটে চললাম আরু ভ্যালির দিকে। যতই যাচ্ছি ততোই মোহিত হচ্ছি। মনে হল স্বর্গভূমি বুঝি আমাদের জন্যই সেজে বসে আছে। আকাশ আর পাহাড়ের মাঝে খুব একটা দূরুত্ব খুঁজে পেলাম না। আকাশ, পাহাড়, মেঘ সব মিলেমিশে একাকার। আরুভ্যালি আসলেই এক রূপভান্ডার। সৌন্দর্যের ডিপো এই আরুভ্যালি। মায়াবি আরুভ্যালির প্রেমে পড়ে গেলাম। কিন্তু প্রেমকে দীর্ঘায়িত করার সুযোগ নেই। ছুটতে হল চন্দনওয়ারির দিকে। সুইজারল্যান্ডখ্যাত বাইসারেনকেও মিস করা যাবে না। চন্দনওয়ারি আর বাইসারেনের সৌন্দর্যের কথা নাই বা বললাম। শুধু কাব্যিক ভাষায় বলতে চাই—

” রূপ তরঙ্গে সৌষ্ঠব লাবণ্য তটে

  তোমা কোলে হে স্বর্গভূমি

  আবার আসিবো বটে

  আবার আসিবো বটে।”