ইকবাল কবীর রনজু, চাটমোহর (পাবনা)
মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারী)। ঘড়ির কাটা তখন সকাল আটটা ছুই ছুই। রোদেলা সকাল। অন্য দিনের তুলনায় শীতের তীব্রতা কিছুটা কম। তখনও রাস্তায় খুব একটা লোক চলাচল শুরু হয়নি। পৌষের শীত উপেক্ষা করে কেউ কেউ হাটতে বেড়িয়েছেন। যানবাহন চলাচলও খুব কম। এরই মধ্যে চাটমোহর থানা বাজার এলাকায় পুরাতন টেলিফোন ভবনের পাশে চাটমোহর উপজেলা যুবলীগের বারান্দায় বসে কুলোয় করে কি যেন ঝাড়ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ শেফালী খাতুন। দুর থেকে দেখে বুঝবার উপায় নেই। কাছে যেতেই চোখে পরলো কুলোয় একেবারেই ছোট ছোট লোহার কুচি। সেগুলো ঝেড়ে মরিচা ও ময়লা পৃথক করছিলেন শেফালী খাতুন। এ লোহার কুচি গুলো বিক্রি করে অর্জিত টাকায় জীবনধারণের অন্যতম উপকরণ খাবার, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনতে হবে শেফালীকে।
লোহার কুচি ঝাড়ার পাশাপাশি কথা বলছিলেন শেফালী। তিনি জানান, উপজেলার লাউতিয়া গ্রামে বসবাস করতেন শেফালীরা। বারো বছর বয়সে বাবা আব্দুর রহমান মারা যান। এর কিছুদিন পরে মারা যান মাও। চার বোন ও এক ভাই তারা। উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় বারো বছর বয়সে তার হাতে ওঠে ভিক্ষের ঝুলি। ভাই বোনদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য এছাড়া অন্য কোন বিকল্প ছিলনা তার সামনে। ভিক্ষে করতে আসতেন চাটমোহর সদরে।
গায়ের রঙ কালো হলেও যুবতীকালে চেহারায় চাকচিক্য থাকায় শান্তাহার এলাকার আলম খাঁন বিয়ে করেন তাকে। কিছু দিন পরেই বউ পছন্দ না হওয়ায় শেফালীকে ছেড়ে যান তার স্বামী আলম খাঁন। অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করে চাটমোহর সদরেই বসবাস করছেন তিনি। তবে কোন ধার ধারেন না শেফালীর। ইতিমধ্যেই অন্য চার ভাই বোন গত হয়েছেন। তাই এখন আর কোন পিছু টান নাই শেফালীর। স্বামী থেকেও নাই। তাই নিজের চিন্তা নিজেকেই করতে হয়। জীবন চালাতে এর ওর ফাই-ফরমাস খাটেন। যে যায় দেয় তাই নেন হাত পেতে।
একটি চুম্বক দেখিয়ে শেফালী আরো জানান, অবসর সময়ে বিভিন্ন ওয়ার্কশপে গিয়ে চুম্বকের সাহায্যে লোহার কুচি সংগ্রহ করেন তিনি। বাজার থেকে পরিত্যক্ত সবজি কুড়িয়ে আনেন। কিন্তু চাল তো কিনতে হয়। অন্যান্য খরচ আছে। দিনে প্রায় চল্লিশ টাকার ওষুধই লাগে। এসব কোথা থেকে আসবে প্রশ্ন রাখেন শেফালী।
মাথা গোঁজার কোন ঠাঁই না থাকায় প্রায় ৩৮ বছর যাবত রাত যাপন করছেন মানুষের দোকানের সামনের বারান্দায়। শীতে কষ্ট করতে হয়। ঝড় বৃষ্টিতে থেমে যায় জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। তবুও চলতে হয় জীবনের পথে। সকাল হয়, এর ওর ফাইফরমাস খাটতে ব্যস্ত হয়ে পরেন শেফালী। কখনও কখনও কোন কাজ থাকেনা। তখন বেশি বেকায়দায় পরেন শেফালী। বেঁচে থাকতে লোহার কুচিতে, পরিত্যক্ত সবজীতে শেফালীকে খুঁজতে হয় জীবনের অর্থ।