ফেলে আসা দিন গুলো-২১

এবাদত আলী

১৯৬৮ সালে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ হতে এইচ এসসি পরীক্ষা দিবার পর লম্বা ছুটি। এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি ছাড়া কোন কাজ নেই। তাই এবার একটি মহৎ কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো। প্রথমে প্রস্তাবটি দেই আমার সহপাঠি বন্ধু তজিমকে। সঙ্গে সঙ্গে সে রাজি হয়। এরপর আমার সহপাঠি এবং অন্যান্য শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিকট প্রস্তাব দিলে সকলেই রাজি হয়। আমরা যে এলাকায় জায়গির থাকি সেই এলাকা অর্থাৎ পাবনা সদর থানার হিমায়েতপুর ইউনিয়নের চকচিরোট, বৈকুন্ঠপুর, বাহাদুরপুর ও মালিগাছা ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে কোন বিদ্যালয় নেই। তাই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমরা অগ্রসর হই। তাতে বাধা আসে পদে পদে। কারণ এই এলাকায় শিক্ষিতের হার বলতে গেলে শুন্যের কোঠায়। কিশোর বয়স থেকেই ছেলেদেরকে তারা অর্থ উপার্জনের জন্য পাবনা শহর এবং শহরতলির হোসিয়ারি শিল্প ও বিড়ি শিল্প প্রতিষ্ঠানে পাঠায়। কেউ কেউ হাল আবাদের সহযোগি বানায়। ছেলেদেরকে লেখাপড়া করতে দিলে আয় রোজগার করতে পারবেনা বলেই তাদের এতো আপত্তি। আমরাও নাছোড় বান্দা। এলাকায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়বো।
কাজে যখন নামা তখন সমালোচনা তো হবেই।‘ বাহদুরপুর আলোক সমিতি’র সেক্রেটারি হিসেবে আমাকেই উক্ত চারটি গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামের প্রধান বর্গকে ডাকার ব্যবস্থা করতে হলো সমিতি প্রাঙ্গনে। আমাদের আহবানে নির্দিষ্ট দিনে চকচিরোট গ্রামের আকবার মেম্বর, গোপালপুর গ্রামের হায়দার ডাক্তার, নবাব আলী ওরফে লবু কবিরাজ, প্রখাত বাউল শিল্পী মরহুম আনার ফকিরের পিতা শুকুর আলী, বৈকুন্ঠপুর গ্রামের প্রধান মুনির উদ্দিন ব্যাপারি, বাহাদুরপুরের সাধু প্রামানিক, জয়ধর ডাক্তার, আল্লেক ব্যাপারি, ফয়েজ উদ্দিন, দিলবার প্রাং, আফুরি গ্রামের জোনাব আলী, কুমারগাড়ির এস্কেন প্রামানিকসহ কমবেশি সকলেই সভাস্থলে হাজির হলেন।
বাহাদুরপুর আলোক সমিতির সভাপতি মোঃ হারেজ আলীর (পরে টেবুনিয়া ওয়াছিম পাঠশালার প্রধান শিক্ষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে মৃত) সভাপতিত্বে সভা শুরু করা হলো। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন কথা। কেউ পক্ষে কেই বিপক্ষে কথা বলা শুরু করলো। এমন সময় বাহাদুরপুর গ্রামের রেশন ডিলার মোঃ আব্দুল করিম বলেন আপনারা যদি সত্যি সত্যিই স্কুল নির্মাণ করেন তবে বাহাদুরপুর মৌজায় রাস্তার কিনারে আমার যে এক বিঘা জমি আছে সেই জমি আমি দান করে দেবো। ৫শ টাকা বিঘা জমির মুল্যমানে ১ বিঘা জায়গা মাগনা (বিনামুল্যে) পাবার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সকলে রাজি হয়ে গেলেন।
মোঃ হারেজ আলীকে সভাপতি এবং জমিদাতা রেশন ডিলার মোঃ আব্দুল করিমকে সেক্রেটারি নিযুক্ত করে স্কুল বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হলো। এবার ঘর উঠাতে যে বাঁশের প্রয়োজন তা যাদের বাঁশঝাড় আছে তারা বাঁশ দিবে। যাদের উলু খড় আছে তারা উলু খড় কেটে পৌঁছে দিবে। যারা ঘরামির কাজ করতো তারা বিনা পারিশ্রমে কাজ করে দিবে বলে জনৈক প্রধান দায়িত্ব নিলেন। মাটি কাটা শ্রমিকেরা স্বেচ্ছাশ্রমে মাটির কাজ করে দিবে। পরদিন থেকেই কাজ শুরু হয়ে গেল। আমরা যারা ছাত্র তারা বাঁশ কাটতে বেরিয়ে পড়লাম। দেখতে দেখতে শতাধিক বাঁশ জমা হয়ে গেল। উলু খড় পাওয়া গেল। বিনাশ্রমে ঘরামি কামলা পাওয়া গেল। বিশ হাত দৈর্ঘ একটি ছনের ঘর উঠানো হলো। পাটখড়ির জোগাড় হলো যা দিয়ে বেড়া দেওয়া হলো। ঘরের দরজা দরজা জানালা দান হিসেবে পাওয়া গেল। স্কুল প্রতিষ্ঠা হলো।
এখন শিক্ষক নিয়োগের পালা। সকলে মিলে আমাকে প্রধান শিক্ষক এবং তজিমকে সহকারি শিক্ষকের দায়িত্ব দিলো। অনুরোধে ঢেকি গেলা আর কি। স্কুল পরিচালনা কমিটি কর্তৃক আমার মাসিক বেতন ত্রিশ টাকা এবং তজিমের মাসিক বেতন পঁচিশ টাকা ধার্য করে দিলো।। ছাত্র ছাত্রি জোগাড় হলো আশাতীত। এলাকার সকলেই তখন এই স্কুলের প্রতি সুনজর দিলো।
১৯৬৮ সালে এক শুভ দিনে স্কুলের পাঠদানের শুভ উদ্বোধন করা হলো। খেলা-ধুলার আয়োজন করা হলো। ব্যাপক সাড়া মিললো। এরপর ইসলামি জালছার আয়োজন করা হলো। ইসলামি জালছার প্রধান ওয়ায়েজিন হলেন মওলানা মোঃ ইসহাক আলী। স্কুলের উন্নতি কল্পে অনুষ্ঠিত জালছায় এলাকাবাসি প্রচুর টাকা-পয়সা দান করলো যা দিয়ে স্কুলের একটি নিজস্ব ফান্ড তৈরি হলো। প্রথমে শিশু শ্রেণি থেকে ক্লাশ থ্রি পর্যন্ত পাঠ দান শুরু করা হলো।
এখন সরকারের নজরে আনার জন্য পাবনার ডিসি সাহেবের নিকট দরখাস্ত নিয়ে যাওয়া হলো। ডিসি কে,এম হেদায়েতুল হক সি এস পি। আমি এবং সেক্রেটারি আব্দুল করিম ডিসির চেম্বারে দেখা করে সব কিছু খুলে বল্লাম। তিনি এ ব্যাপারে খুব উৎসাহি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন এসডিও এবং ডিইও এর কাছে। আমাদের বললেন উনারা আপনাদের স্কুল পরিদর্শনে যাবেন। তারপর সকল ব্যবস্থা করা হবে। আমি নিজেও যাবো আপনাদের স্কুল দেখতে। পর দিনই এসডিও সাহেব এবং তারপরদিন ডিইও সাহেব এলেন। দিন কয়েক পরে এলেন ডিসি সাহেব। তারা পরিদর্শন করে খুটিনাটি বিষয়ে পরামর্শ দিলেন। এলাকার সাধারণ মানুষ এতে খুব খুশি। এক কথায় সকলেই বাহাদুরপুর প্রথিমিক বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলো। যা পরবর্তীকালে বাহাদুরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।