ফেলে আসা দিন গুলো – ২০

এবাদত আলী
পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়ন কালে কলেজের ছাত্রদের মাঝে বিভিন্ন মতবিরোধ দেখা দেয়। ছাত্র লীগের শাখা ছিলো খুবই তৎপর। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন তখন দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। মেনন গ্রুপ ও মতিয়া গ্রুপ নামে দুটি গ্রুপ কলেজে নেতৃত্ব দিতে শুরু করে। ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই মহাদেশে আরো একটি মারাত্বক বাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনীর রূপকার চারু মজুমদার। যার পৈত্রিক নিবাস ভারতের শিলিগুড়িতে এবং তিনি ছিলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ১৯৩৭ সালের প্রাক্তন ছাত্র। ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার নকশালবাড়ি নামক গ্রামে প্রায় ৮০ হাজার খেত মজুররা দেশি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করে। নকশাল বাহিনী নামে তাদের পরিচিতি ঘটে। তারা জোতদারদের মাঠের পাকা ফসল কেটে নেয় এবং স্থানীয় ভাবে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই নকশাল বাহিনীতে যোগ দেন এই কলেজেরই ছাত্র নেতা আমিনুল হক বিশ্বাস ওরফে টিপু বিশ্বাস, আক্তরুজ্জামান আক্তার, জামশেদ এবং তাদের সহযোগীরা। আমাদের সঙ্গে অর্থাৎ ছাত্র লীগের সঙ্গে তাদের বাকবিতন্ডা লেগেই থাকতো। আরো একটি ছাত্র সংগঠন ছিলো তার নাম এনএসএফ। এই সংগঠন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের নিজস্ব বাহিনী। এই সংগঠনের কলেজ শাখার নেতা ছিলেন আব্দুল বাতেন। তবে তাদের সংখ্যা ছিলো খুবই নগন্য।
এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়ন কালে আমরা সকল সময়ই আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। তার মধ্যেও কলেজে ধারা ভাষ্যকার হিসেবে ছিলো আমার একছত্র আধিপত্ত। কলেজের যে কোন অনুষ্ঠানে উপস্থাপক হিসেবে আমাকেই প্রধান্য দেওয়া হতো। কারণ কলেজের জিএস ছিলেন ছাত্র লীগের সোহরাব উদ্দিন সোবা। বলতে গেলে সোবা ভাই আমাকে ছাড়া আর কাউকে বুঝতেন না। আমি যত দিন এডয়ার্ড কলেজের ছাত্র ছিলাম তত দিন কলেজের বার্ষিক ত্রীড়ানুষ্ঠানের ধারাভাষ্যকার হিসেবে আমার নাম থাকতোই।
১৯৬৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি গীতি নকশার মধ্য দিয়ে কলেজে বসন্ত বরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ‘ রূপময়ী রূপে রূপ’ এই গীতিনকশার ধারাবিবরণীতে কন্ঠ দেই আমি ( এবাদত আলী) ও লায়লা আরজুমান্দ বানু বীথি। সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন ভক্তি দাস চাকি, শওকাতুর রহমান স্বপন, ফিরোজা বেগম, লিলি বিশ্বাস, গোলাম সরোয়ার খাঁন সাধন (১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ) প্রমুখ। এ বছরে আরেকটি গীতি নকশা পরিবেশিত হয়। এটি র রচয়িতা বাংলা বিভাগের অধ্যাপক একেএম হাসানুজ্জামান। গীতি নকশার নাম ছিলো ‘ ফাগুন যেন আগুন ঝরায়’। এতেও আমি ও লায়লা আরজুমান্দ বানু বীথি ধারা বিবরণীতে অংশ নেই। এবছর ৮ ফেব্রুয়ারি এক আদেশ বলে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ সরকারি করণ করা হয় এবং ১ মার্চ হতে তা কর্যকর হয়। কর্মরত শিক্ষক মন্ডলী ০১-০৩-১৯৬৮ তারিখে প্রভাষক এবং সহকারি অধ্যাপক হিসেবে সরকারি নিয়োগ লাভ করেন। তাঁদের মধ্যে ইংরেজি বিভাগে মোঃ সোলায়মান মিয়া, আবু আহমেদ রশিদুল্লাহ, বাংলা বিভাগে এনকে মোঃ হাববুন নবী, খোন্দকার খালিকুজ্জামান যিনি এমকে জামান নামে পরিচিত ছিলেন। মোঃ ইদরিস আলী, একেএম হাসানুজ্জামান, মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, অর্থনীতির প্রভাষক ফকরুল ইসলাম, গোলাম রসুল, মজিবর রহমান ভূঁইয়া, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের এটিএম সিরাজুল হক, সেখ আবুল কালাম আজাদ, দর্শন শাস্ত্রে মোঃ আবু সাইদ মিয়া, মোঃ গোলাম মওলা, মোঃ বদিউর রহমান, প্রভাষক উর্দু মোঃ আবিদ সারমিস্তিী, প্রভাষক আরবী, মোঃ আব্দুল হামিদ, বাণিজ্যে মোঃ আফাজ উদ্দিন, সামসুদ্দিন খান, গণিতে এ্ইচএম মাহমুদার রহমান আলমাজি, রসায়নে আব্দুল হালিম, মোঃ বয়েন উদ্দিন ও মোহাম্মদ আলী।
কলেজ প্রাদেশিকীকরণের দুদিন পর মার্চের ৩ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা। এতে ধারা বিবরণীতেও আমার ভুমিকা ছিলো। এ মাসেই কলেজে বার্ষিক মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিিিথ হয়ে এলেন পিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ। কলেজ সরকারিকরণ হলে কলেজের প্রিন্সিপাল আমিনুল হককে বিদায় নিতে হয়। তিনি ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসের ১০ তারিখে কলেজ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেন। এবছর কলেজ থেকে বিদায় নিলেন অধ্যাপক হাবিবুন্নবী, অধ্যাপক আব্দুল হালিম শিকদার, অধ্যাপক আবু সাঈদ মিয়া।
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগদান করেন ডক্টর শামসুদ্দিন মিয়া। বিভিন্ন বিভাগে ক’জন অধ্যাপকও যোগদান করলেন। বাংলায় অধ্যাপক অসিত কুমার মজুমদার, অধ্যাপক ফিরোজা বেগম (তিনিই পাবনা সরকারি এরয়ার্ড কলেজের প্রথম মহিলা অধ্যাপক)। কলেজের উত্তর পাশে জিমনাশিয়াম মাঠে ৯ ডিসেম্বর এক বিচিত্রানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নবাগত প্রিন্সিপাল ও অধ্যাপকদের বরণ করে নেয়া হয়। প্রানবন্ত এই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে আমার পরিচিতি বহুগুনে বৃদ্ধি পায়। বলতে গেলে সেকারণেই কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ছাত্র লীগের প্যানেলে বার্ষিকী সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দিতা করার জন্য নাম প্রস্তাব করা হয়।এডওয়ার্ড কলেজ বার্ষিকী সম্পাদক পদে অপর প্রার্থী শাহজাহান আলী মনোনয়ন চান। আমাদের দুজনের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রতিযোগীতা শুরু হয়। কেউ দমবার নয়। অবশেষে অধ্যাপক আবু সাঈদ সকলকে ডিগ্রি কলেজের ছাদে ডেকে সব শুনলেন। আমার পক্ষে মতামত বেশি হলে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এতে অভিমান করে শাহজাহান আলী ছাত্র লীগ থেকে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। এবছর অর্থাৎ ১৯৬৭-৬৮ শিক্ষা বর্ষে পুর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ এডওয়ার্ড কলেজ শাখা ছাত্র লীগের প্যানেলে যারা নির্বাচনে অংশ নেন তারা হলেন ভিপি পদে তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরি, জি এস পদে সোহরাব উদ্দিন সোবা, আমোদ-প্রমোদ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার খান সাধন, সাহিত্য-সাংস্কৃতি সালাহ উদ্দিন আহমেদ, সমাজ কল্যান কামরুজ্জামান, কমন রূম আমিনুল ইসলাম, ম্যাগাজিন সম্পাদক পদে েেমাঃ এবাদত আলী, ক্রীড়া সম্পাদক পদে রফিকুল ইসলাম বকুল, জিমনাষ্টিক সম্পাদক সুজিত কুমার চক্রবর্তী ও মহিলা কমন রূম সম্পাদক পদে সৈয়দা নুরজাহান কিসমত। এই নির্বাচনে ছাত্র লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।