এবাদত আলী
পাবনা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে বার্ষিক বনভোজন। বনভোজন অনুষ্ঠিত হবে গাজীপুর জাতীয় উদ্যান ভাওয়ালের গড়ে। প্রেসক্লাবের সদস্য হিসাবে বনভোজনে যাবার জন্য মন আনচান করতে থাকে। জেলা কানুনগো পদে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহনের পর হাতে অফুরন্ত সময়। কথায় বলে একেতো নাচুনি বুড়ি তার উপরে ঢোলের বাড়ি। আমার অবস্থাও যেন তাই। পুর্ব নির্দ্ধারিত তারিখ অনুযায়ি ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালের শুক্রবার ভোরবেলা আমার ছোট ছেলে তানভীর মাহমুদ সৈকতকে সাথে নিয়ে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গনে গিয়ে হাজির হলাম। সকাল ৭ টায় রওনা হবার কথা থাকলেও অনেকেই বিলম্বে এলেন। বনভোজন কমিটির আহ্বায়ক পাবনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও নতুন বিশ্ববার্তার প্রধান সম্পাাদক রবিউল ইসলাম রবি, পাবনা প্রেক্লাবের সভাপতি রুমি খোন্দকার, সাধারন সম্পাদক উৎপল মির্জা সহ প্রায় সকলেই তখন উপস্থিত। কিছু রাশভারি সদস্যের পরিবার পরিজন নিয়ে আসতে বিলম্ব হওয়ায় অনেকেই তখন বিরক্ত বোধ করছিলেন। কিন্তু উপায় কি? কথায় বলে সখের তোলা আশি টাকা। তাই সৌখিনদের আগমণ আগে ভাগে হলেও কম সৌখিনদের তো আর ফেলে যাওয়া যায়না। বনভোজন বলে কথা।
আমাদের যাত্রা সেজান ও অঙ্কুর এক্সপ্রেস নামক দুটি বিলাস বহুল কোচে। আমার ভাগে অঙ্কুর এক্সপ্রেস। সিটে গিয়ে বসতেই দৈনিক সংবাদ ও একুশে টিভির পাবনা প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান স্বপন আমার পাশে বসলেন। অন্যান্যদের মধ্যে বনভোজন কমিটির আহ্বায়ক রবিউল ইসলাম রবি, প্রবীন সাংবাদিক আনোয়ারুল হক, প্রেসক্লাবের সদস্য ও সরকারি শহীদ বুল বুল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর শিবজিত নাগ, প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি শ’ই শিবলি ও দৈনিক নতুন বিশ্ববার্তার সম্পাদক শহীদুর রহমান,দৈনকি ইছামতির বার্তা সম্পাদক ও বাংলাভিশনের পাবনা প্রতিনিধি আঁখিনূর ইসলাম রেমন, দৈনিক প্রথম আলোর পাবনা প্রতিনিধি ফারুক হোসেন চৌধুরী, দৈনিক ডেসটিনিরি পাবনা জেলা প্রতিনিধি মোসতাফা সতেজ, দৈনিক ভোরের কাগজের পাবনা প্রতিনিধি গোলাম খাজা সাদী সহ অনেকের সাথেই সাক্ষাত হলো। এক সময় আমরা রওনা হলাম। ফাগুনের প্রথম দিনের কোকিল ডাকা সকাল। বিদায়ী হালকা শীতের কুয়াশা ভেদ করে কোচ চালক আরজু হর্ন বাজাতে বাজাতে ঢাকা রোড ধরে দ্রুত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চল্লে। মাধপুর যেতেই বামে মোড় নিয়ে সাথিয়া হয়ে বেড়া বাস ষ্ট্যান্ডে ওঠা। সেখান থেকে বাঘাবাড়ি হয়ে হাটিকুমরু গোলচত্বর। এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু সেতুর সংযোগ সড়কের শুরু। নিকট অতীতে এই এলাকাটি বিরান চর ভুমি ছিলো। যমুনা নদীর উপরে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মিত হবার ফলে এলাকাটি এখন জনবসতি এবং ব্যবসায় কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। কিছুদুর গিয়ে একটি নিরিবিলি হোটেল ও রেষ্টুরেন্ট এর সামনে কোচ দুটি থামানো হলো। এক সঙ্গে এতগুলো যাত্রী দেখে রেষ্টুরেন্টের বয় বেয়ারাগণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোচ থেকে নেমে প্রায় সকলেই টয়লেটের খোজ করে, কিন্তু খাবারের খোজ কেউ করেনা, এমনকি এক গ্লাস পানিও না। সকলেই যে যার মত আবার কোচের সিটে গিয়ে বসতেই নাস্তা দেওয়া হলো-সেই সাথে এক বোতল করে পানি। নাস্তা শেষে আবার সামনের দিকে চলা।
বঙ্গবন্ধুু সেতুর টোল প্লাজার প্রবেশ মুখে বঙ্গবন্ধু সেতুর উদ্বোধনী নাম ফলকে বঙ্গবন্ধু সেতুর নাম দেখে বিস্মিত হলাম। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন তারিখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু সেতুর আনুষ্ঠুানিক উদ্বোধন করেছিলেন। পরবর্তী কালে ২০০১ সালে বিএনপি জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই বঙ্গবন্ধরু নাম মুছে দিয়ে শুধু মাত্র যমুনা সেতু করা হয়। উদ্বোধনের সময় সেতুর উভয় প্রান্তে পৃথক বোর্ডে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার যে ছবি ছিলো তাও মুছে ফেলা হয়। শুধু কি তাই? দুই প্রান্তের গোল চত্বরে থাকা উদ্বোধনী ফলকে শেখ হাসিনার নাম সংববলিত শ্বেতপাথরের নাম ফলক ও মুছে ফেলা হয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথে আবার যমুনা সেতুর নাম হয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু। হয়তো বা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার প্রতিকৃতিও আবার পুনঃস্থাপন হবে যথাস্থানে। কি বিচিত্র এই দেশ?
যাক আমরা এক সময় টাংগাইল বাইপাস হয়ে গাজীপুরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। চন্দ্রাতে পৌঁছতেই পাবনা প্রেসক্লাবের সদস্য সৈকত আফরোজ আমাদের সঙ্গী হলেন। আমাদের সঙ্গে আরো যোগ দিলেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হাসনাতুজ্জামান হিরা। এক সময় গাজীপুর চৌরাস্তা পেরিয়ে সোজা উত্তরে ময়মনসিংহ রোড ধরে আমাদের কোচ এগিয়ে চল্লো। কিছুদুর যাবার পরই আমাদের বহু প্রতিক্ষিত গন্তব্যস্থল গাজীপুর জাতীয় উদ্যান ও ভাওয়ালের গড়।
প্রবেশ পথে কোচ থামিয়ে জনপ্রতি দশ টাকা এবং কোচ প্রতি দুশ টাকা দিয়ে তা সংগ্রহ করা হলো। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বন এই জাতীয় উদ্যান ভাওয়ালের গড়। ভিতরে প্রবেশ করে যেন খেই হারিয়ে ফেল্লাম। বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে ঘন শাল বন। গজারী শালবনের মাঝ দিয়ে বৃত্তাকার ও আঁকা বাঁকা পথ চলে গেছে। কোথাও বা হেরিংবন বন্ড আবার কোথাও বা পাকা রাস্তা। মাঝে মাঝে একেকটি পিকনিক স্পট। কিছুদুর যাবার পর একটি জায়গা বেছে নিয়ে রান্নার আয়োজন করা হলো।
সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি দুর- দুরান্ত হতে আগত হাজারো মানুষের পদচারনায় নিস্তব্ধ শালবন যেন প্রান চঞ্চলতায় সজিব হয়ে ওঠে। প্রকৃতির সাজ গোজ বদলাতে শুরু করেছে ফাগুনের প্রথম দিনে। ঋতুরাজ বসন্তের আগমণে গহীন বনের শালগাছের নিচে ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা প্রশাখায় হাসিমুখে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে কচি সবুজ পাতা। পাখ পাখালীর মধুর কল কাকলিতে মুখর সারা বন। কবি গুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ভাষায় যেন গাইতে ইচ্ছা করে “আহা আজি এ বসন্তে -কত ফুল ফোটে ,কত বাঁশি বাজে, কত পাখি গায়।’’ এমনি গহীন বনের মাঝে পথ চলতে গিয়ে কবি গুরুর কথা আবারো মনে পড়ে ‘‘ কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা। ” আমরা এক সময় গহীন অরন্যে যেন হারিয়ে গেলাম। এই গহীন অরন্য সহ বিশাল ভুন্ডের মালিক ছিলেন ভাওয়ালের মহারাজা। জনশ্রুতি আছে ভাওয়ালের মহারাজা সহধর্মিনীর চক্রান্তের শিকার হন। তাকে হত্যার জন্য আর্সেনিক বিষ প্রয়োগ করা হয়। রাজার মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তাকে দাহ করার জন্য শশ্মান ঘাটে নিয়ে চিতা সাজানো হয়। সাজানো চিতায় আগুন দিতেই শুরু হয় প্রবল বেগে দমকা বাতাস ও সেই সাথে প্রচন্ড ঝড় এবং মূষলধারে বৃষ্টি। চিতা প্রজ্জলন কারিরা প্রান ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায় এবং রানীর নিকট রাজার শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্নের কথা জানায়। এদিকে প্রবল ঝড় বৃষ্টির কারনে চিতার আগুন নিভে যায় এবং ভাওয়াল মহা রাজা সম্বিত ফিরে পান। এমন সময় এক দল সন্যাসী সেখান দিয়ে যাবার সময় তারা অর্ধমৃত রাজাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যান। সেই থেকে ভাওয়াল মহারাজাও সন্যাস ব্রত পালন করতে থাকেন। তিনি ক্ষোভ, দুঃখ ও অভিমানের কারনে নিজের পরিচয় গোপন রাখেন। তিনি মনে মনে প্রতিঞ্জা করেন যে ওই পাপ রাজ্যে আর কখনো তিনি ফিরে যাবেননা।
কথিত আছে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে শেষ জীবনে সন্যাসী বসন পরিধান করে তিনি তার রাজবাড়িতে ফিরে এলে রাজরানী সহ অন্যান্য পারিষদ বর্গ তাকে পাগল আখ্যায়িত করে রাজ দরবার থেকে বের করে দেয়, কারন বহু বছর আগেই ভাওয়াল রাজা মৃত্যু বরন করেছেন এবং তাকে যথারীতি দাহ করা হয়েছে। আরো জনশ্রুতি আছে ভাওয়াল মহারাজা তার যাবতীয় সম্পত্তি উদ্ধার ও রাজত্ব ফিরে পেতে আদালতে মামলা করলে আদালত উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তার পক্ষে রায় দেন। এ সংবাদ জানার পর রানী গলায় কলসি বেধে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
পরবর্তীকালে ভাওয়ালের মহারাজা মৃত্যু বরন করলে তাঁর অবর্তমানে রাজবাড়ির জৌলুস ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কালের বিবর্তনে ভাওয়ালের রাজবাড়ি এখন গাজীপুর জেলাসদরের অফিস আদালত হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং বিশাল বনভুমিকে সরকার হতে সংরক্ষণ করে জাতীয় উদ্যানে পরিণত করা হয়েছে। সেই সাথে গড়ে তোলা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পিকনিক স্পট। একটি চিড়িয়া খানাও রয়েছে এই জাতীয় উদ্যানে। ভাওয়াল গড়ের অভ্যন্তরে অসংখ্য লেক রয়েছে। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য বোটে চড়ে লেকে ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে।এখানে বেড়ানোর বাহন হিসাবে রিকসা ও রিকসা ভ্যান ওয়ালাদের শরনাপন্ন হওয়া যায়, তবে গাঁটের পয়সার পরিমান দিগুন গুনতে হয়। কয়েকটি তেজি ঘোড়া ও এখানে ভাড়ায় পাওয়া যায়। ইচ্ছা করলে ঘোড়ায় চড়ে গহীন বনের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে ঘুরে বেডানো যায়। এখানে পর্যটক দের সুবিধার্থে,রেষ্টহাউস, নামাজের জন্য মসজিদ এবং শালবনের মধ্যে গোলপাতার ছাউনির কিছু দোকান রয়েছে, তাতে অতি চড়া মুল্যে চা, পান সহ টুকি টাকি জিনিষ পত্র পাওয়া যায়।
গাজীপুর জাতীয় উদ্যান ও ভাওয়ালের গড়ে ঘোরা ঘুরি করতে করতে এক সময় বিকাল হয়ে এলো। বনভোজনের রসনাতৃপ্ত ভোজন শেষে আমরা নিজ গন্তব্যে ফেরার জন্য কোচে উঠে বসলাম। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট তাং ০১ /০১/ ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।