ফেলে আসা দিন গুলো -১৯

এবাদত আলী
উনিশ শ ষাইট সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। সেসময় ১ টাকায় চারটি বড় ইলিশ মাছ পাওয়া যেতো।তাই বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে পদ্মা নদীতে ইলিশ মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। পেশাজীবী মৎস্য শিকারি অর্থাৎ জেলেরা ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার শৌখিন ব্যক্তিগণ পদ্মা নদীর ইলিশ মাছ ধরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের বসতবাড়ি হতে পদ্মা নদীর দূরত্ব মাত্র ১০ মাইল। সেখানে এ এলাকার বহু সংখ্যক ব্যক্তি ইলিশ মাছ ধরার জন্য জাল বুনিয়ে মাছ ধরতে যাবার আয়োজন করতে থাকে। আমার আব্বা দারুন সৌখিন ব্যক্তি। তাই তিনিও ইলিশ মাছ ধরার জন্য জাল তৈরি করতে অনুমতি দিলেন। আমার ফুফাতো ভগ্নিপতি ও প্রতিবেশী আজগর আলী জাল তৈরির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পাবনা শহর থেকে নব্বুই টাকার সুতা কিনে আনা হলো। রাতদিন পরিশ্রম করার পর ইলিশ মাছ ধরার জাল তৈরি শেষ হলো। এবার পদ্মা নদীতে যাবার পালা।
হঠাৎ করেই আমার সখ চাপলো এবং বায়না ধরলাম ইলিশ ধরতে আমিও যাব। প্রথম দিকে আব্বা অমত করলেও বারবার অনুরোধ উপরোধ করায় শেষে রাজি হলেন। আমাদের নৌকায় গাব-কালি দেওয়া হলো। পিছা গলুইয়ের সাথে নতুন রশি দিয়ে শক্ত করে হাল বাধা হলো। আগ গলুই এর দু’পাশে দু’টি দাড় বাধাসহ লগি বৈঠা ও পানি সেচের সেউতি ঠিকঠাক করা হলো। গুন টানার জন্য গুন এর রশি ও কাঠি নৌকায় তোলা হলো। নৌকার টাপ্পর বা ছৈ বাধা হলো। বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে গোটা নৌকায় নতুন চরাট বা মাচান পাতা হলো। ছৈ এর নিচে খেজুর পাতার মাদুর বা সপ বিছিয়ে তার উপর কাঁথা বিছানা হলো। আমাদের বাড়ির তিনজন কামলাসহ মাছ ধরতে যাবার লোকদের জন্য খামিরা তামাক, হুকা, কলকি ও আগুন রাখার আলে এবং সে সাথে গোবরের শুকনা ঘষি ও নারিকেলের ছোবড়াও তারা নৌকায় নিয়ে পিছা গলুইয়ের এক পাশে রাখলো। পাকের জন্য হাড়ি পাতিল, কড়াই, আলোক চুলা, খড়ি, চাল-ডাল, তেল মরিচ সবই নৌকায় উঠানো হলো। ধৃত ইলিশ মাছ কুটে লবণ দিয়ে রাখার জন্য মাটির বড় বড় পাতিল আর লবন হলুদ নেওয়া হলো বেশি করে। সারা বিকাল জুড়ে নৌকা সাজানো হলো।
রাতের খাবার খেয়ে পদ্মা নদীতে মাছ ধরার জন্য আমরা রওনা হলাম। নৌকার হাল ধরলেন আজগর দুলাভাই, দাঁড় টানতে বসলেন আমাদের বাড়ির কামলা আবু তাহের ও মক্কেল আলী। অপরজন সোনা ভাই রইলেন বিশ্রামে। তিনি প্রয়োজনে হাল ধরবেন, দাঁড় টানবেন, সেউতি দ্বারা নৌকার পাটাতনের নিচে জমা পানি সেচবেন। আর আমার কোন কাজ নেই। শুধু খাওয়া ঘুমানো আর মাছ ধরায় অংশ নেয়া। আমাদের গ্রামের আরো পাঁচ-ছয়টি নৌকাও আমাদের নৌকার সাথে এক বহরে রওনা হলো। যেন বেদের বহর।
ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। চারদিকে নিস্তদ্ধতা বিরাজ করছে। বাঙর নদীতে উজানে দাঁড় বাওয়ার শুধু ছলাত ছলাত শব্দ হচ্ছে। বাঙ্গাবাড়িয়া মাদরাসার বটতলার বাশেঁর শাকো পার হয়ে গোঁসাই বাড়ির কাছে গিয়েই সোনাভাই গলা ছেড়ে গান ধরলেন। অন্য নৌকার মাঝি মাল্লারাও তার গানের সুরে সুর মিলিয়ে রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলো। উজানে দাঁড় বাইতে গিয়ে জারি, সারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, বারোমাসি সহ বেহুলা-লক্ষীন্দর, জানে আলম বাদশা ও রূপবান যাত্রার গানের যেন খৈ ফুটলো। এমনিভাবে চলতে চলতে শেষ রাতের দিকে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশে তালবাড়িয়ার ইলশা বাঁকের নিকট পৌছানো হলো। এখান থেকেই ইলিশ ধরার অভিযান শুরু।
শত শত নৌকা ভিড়ে আছে তালবাড়িয়ার ঘাটে। ভোর হতে না হতেই শুরু হলো মাছ ধরার প্রতিযোগীতা। প্রায় এক সঙ্গে সকল নৌকা ভাটির দিকে চলছে। প্রবল স্রোতের টানে দ্রুত গতিতে চলা নৌকার গলুইয়ের বরাবর সামনে গভীর পানিতে নামানো আছে জাল। একে বলে কোনা জাল। দেখতে অনেকটা খোঁড়া জালের মত। ভি আকৃতির এই জালের শেষ প্রান্তে থাকে অনেক খানি চিকন জাল যাকে বলা হয় টোন। এই টোনের সঙ্গে থাকে সুতলি বাঁধা। হাতের কবজিতে ঐ টোনের সুতা বেঁধে রাখা হয়। কোনা জালে ইলিশ মাছ পড়লেই জালের শেষ প্রান্তে গিয়ে তা বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং টোন নড়ে ওঠে। তখনই বিশেষ কায়দায় টোনের অংশ পানির উপরে উঠানো হয়। আর এভাবেই ইলিশ মাছ ধরা হয়।
প্রথম খ্যাপে আমাদের জালে কোন ইলিশ ধরা পড়লোনা। তালবাড়িয়ার বাঁক হতে চর নিয়ামতউল্লা-াপুর ক্যানেলের মুখ পর্যন্ত এসে আবার ফিরে যেতে হলো। এটা ইলিশের বাঁক। এই বাঁকেই আমাদের ইলিশ ধরার কাজ। জাল উঠিয়ে নৌকার উপর রাখা আছে। এখন উজানে যাত্রা। দু’টো দাঁড়ই সমান তালে টানা হচ্ছে। উপরস্তু বাতাস উজানে থাকায় বাদামও তুলে দেওয়া হয়েছে। ভাটিতে ভাসতে যেখানে সময় লাগে আধঘন্টা, সেখানে উজানে যেতে সময় ব্যয় হয় ঘন্টা দুয়েক। যাদের ভাগ্যে ইলিশ জোটে উজানে নৌকা বাইতে গিয়ে তাদের মন মেজাজ উৎফুল্ল থাকে। আর যারা ইলিশ ধরতে ব্যর্থ হয় তাদের মেজাজ মর্জি খুব খাট্রা। পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকে। বিশেষ করে প্রায় সকলেই মাঝিকে দোষারোপ করে। ইলিশের ঝাঁক বুঝে নৌকা বাইতে না পারার কারনেই ইলিশ মাছ ধরা পড়ে না।
দ্বিতীয় বার আবার পানিতে জাল ফেলে জালের গায়ে কিছু পানি ছিটিয়ে থুম্বরি থু বলে জালের টোন ধরলেন আজগর দুলাভাই, দশগজ নাই যেতে দু’টো ইলিশ টেনে তুললেন। নৌকার পাটাতনে তা ছেড়ে দিয়ে আবার জালের টোন নামিয়ে দিলেন। দেখতে দেখতে নৌকা ক্যানেলের ঘাটে এসে পৌছে গেল। নৌকা উজানে চলছে এবার পালে বাতাস বেশি তাই দাঁড় বাওয়া বন্ধ। রান্নার আয়োজন চলছে। আমি নৌকার পাটাতন থেকে বাছাই করে দু’টো ইলিশ তুলে দিলাম যা দুপুরে রান্না হবে। রান্না হতে হতে আরেক খ্যাপ মারা যাবে ততক্ষনে তালবাড়িয়ার বাঁকে পৌছে গেছে নৌকা। এবার জাল আমার হাতে দেওয়ার জন্য বায়না ধরলাম। কাঁচা মাছের লোভ নাকি সহজে কেউ ছাড়তে পারে না। আমার হাতে জাল ছেড়ে দিলে মাছ ধরায় বিঘœ ঘটতে পারে বলে নৌকার মাঝি-মাল্লারা মুলত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। যেহেতু আমি মালিকের পুত্র তাই আমারই জিত হলো। বিসমিল্লাহ বলে উজান থেকে জাল হাতে নিলাম। নৌকা চলছে ইলিশ ধরবো বলে দারুন উত্তেজনায় দেহ-মন শিহরিত হচ্ছে। গোল পোষ্টের কাছে গিয়ে সামান্য লাথিতে যেন গোল করার অবস্থা। সত্যি সত্যি হাতের সূতায় টান অনুভব করালাম। জালের টোন উপরের দিকে উঠাতে লাগলাম। একসঙ্গে দু-দুটি ইলিশ। নিচ থেকে টেনে পানির উপর তুললাম ঠিকই কিন্তু পানি থকে মাছগুলো নৌকায় তুলতে পারলাম না। আজগর দুলাভাই ছুটে এসে আমাকে শুদ্ধ জড়িয়ে ধরে আনন্দে মাছ শুদ্ধ জাল নৌকায় তুলে ফেলে¬ন। আনন্দে আমি তখন কেঁদে ফেলেছি আর কি ?
মাছ ধরা বিরতি দিয়ে টাটকা ইলিশ মাছ দিয়ে দুপুরে খাবার খাওয়া হলো। মাছের পাতিল মাঝখানে রেখে চারদিকে গোল হয়ে বসা। ভাত যেনতেন সবাই ইলিশ খাওয়ায় ব্যস্ত যেন ইলিশ মাছ খাবার মিনি প্রতিযোগীতা। খাবার শেষে সামান্য সময় বিশ্রাম নিয়ে রাত অবধি আবার ইলিশ ধরা।
পরদিন ভোর বেলায় আবার শুরু। এদিন আমার হাতে উঠলো চারটি ইলিশ। সারাদিন ইলিশ ধরা শেষে বিদায়ের পালা। আগের দিনের ইলিশ কেটেকুটে হলুদ লবণ দিয়ে পাতিলে রাখা হয়েছে। সবগুলো পাতিলই ইলিশ মাছে ভর্তি । পরদিনের ইলিশে নৌকার পাটাতন ভর্তি। এ অবস্থায় রাখা হলে মাছ পচে যাবে। তাই বলতে গেলে রাখার জায়গায় না থাকায় ইলিশ মাছ ধরার ইতি টেনে সেবারের মত আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট