মহান বিজয়, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন

মাজহার মান্নান , কবি ও কলামিস্ট
আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথটি মোটেও সহজ ছিল না। বছরের পর বছর আন্দোলন করতে হয়েছে। রক্তপাত হয়েছে। জেল জুলুম আর নির্যাতনের দাবানলে পুড়তে হয়েছে। ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ মানুষের প্রাণ দিতে হয়েছে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য। আমাদের এই স্বাধীনতার দরকার ছিল আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র এবং উন্নায়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য। প্রশ্ন হল স্বাধীনতার ৫২ বছরে আমরা সেটার কতটুকু পেয়েছি। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মধ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র রয়েছে। একটি দেশের উন্নয়ন মানে সেই দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। গণতন্ত্র একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য একটি সবচেয়ে বড় অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে এবং পাকিস্তান তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছিল যার ফলস্বরূপ বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল।

গণতন্ত্রের কোনো সার্বজনীন সংজ্ঞা নেই। কারণ এটি স্থানভেদে পরিবর্তিত হয়। তবে গণতন্ত্রকে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয় যেখানে জনগণ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। পদ্ধতিগত গণতন্ত্রের তিনটি দিক অনন্য বলে বিবেচিত হয়। সেগুলি হল: ১. সর্বজনীন ভোটাধিকার ২. প্রতিযোগিতামূলক এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ৩. বাক স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। গণতন্ত্রের ধরন সব দেশে এক নয় এবং গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য রাষ্ট্র ভেদে ভিন্ন হয়। তাই গণতন্ত্র শব্দের আগে বিভিন্ন বিশেষণ যুক্ত হয়। সেগুলি হল: ১. আধা-গণতন্ত্র ২. ভার্চুয়াল গণতন্ত্র ৩. নির্বাচনী গণতন্ত্র ৪. ছদ্ম গণতন্ত্র ৫. উদার গণতন্ত্র ৬. হাইব্রিড গণতন্ত্র। কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো সুশাসন, রাজনৈতিক জবাবদিহিতা, আমলাতান্ত্রিক সততা, জনগণের ক্ষমতায়ন, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, তথ্যের অবাধ প্রবাহ, স্বাধীন বিচার বিভাগ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু 1975 সালের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘকাল গণতন্ত্র চাপা পড়ে যায়। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সূচনা হয় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে। স্বৈরাচারের পতনের পর জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পায়, যা গণতন্ত্রের অন্যতম সৌন্দর্য। বাংলাদেশের মাটিতে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের মাটিতে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বহু দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনী সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তবে নির্বাচনী সহিংসতা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়া এখনও সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকারের অনেক অসাধারণ অর্জন রয়েছে, কিন্তু গত কয়েক বছরে নির্বাচনী সহিংসতা সরকারের এই উজ্জ্বল ভাবমূর্তিকে কিছুটা হলেও ম্লান করেছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং কয়েক বছরের মধ্যে উন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে এই ইতিবাচক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়োজন দুর্নীতি নির্মূল এবং নির্বাচনী সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করা। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা অপরিহার্য এবং এই প্রতিযোগিতা সাংবিধানিক, শান্তিপূর্ণ ও অহিংস হওয়া দরকার। গণতন্ত্র সাংবিধানিকভাবে এগিয়ে গেলে দেশের জন্য সেটা সু বার্তা বয়ে আনে। সংবিধান একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং জনগণই এখানকার সকল ক্ষমতার উৎস। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, সুশাসন, শক্তিশালী সুশীল সমাজ, স্বাধীন বিচার বিভাগ, বাক স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রকৃত গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মধ্যে একটি শক্তিশালী যোগসূত্র রয়েছে। গত কয়েক বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অকল্পনীয় উন্নয়ন করেছে। তার নেতৃত্বে অর্থনীতির চাকা অনেক বেশি গতিশীল হয়েছে। পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল বাংলাদেশকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। গত এক দশকে বিপুল সংখ্যক নতুন রাস্তা, ব্রিজ, ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে এবং একই সঙ্গে অনেক রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

শিক্ষার হার বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার কমানো, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্যের অংশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাপক সাফল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় মাইলফলক এবং একটি যুগান্তকারী ঘটনা। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার এবং একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দেশবাসিকে ইতোমধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছেন। স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট গণতন্ত্র থাকবে এটাই প্রত্যাশা

উন্নয়ন মানে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়াও, এটি আরও অন্যান্য উন্নয়নকে বোঝায় যেমন সংস্কৃতির উন্নয়ন, মানবাধিকারের উন্নয়ন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও রাজনীতির উন্নয়ন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিকাশ। গণতন্ত্র একটি চলমান প্রক্রিয়া যা রাতারাতি কখনই ফলপ্রসূ হয় না। একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বয়স মাত্র ৩২ বছর। এই ৩২ বছরে আমাদের যা পাওয়ার কথা ছিল তা আমরা নাও পেতে পারি, তবে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে আমরা ভবিষ্যতে পাব না। প্রকৃত গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দল গুলির আগ্রহের জায়গাটি খুব গুরুত্বপূৃণ। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন মানবাধিকারের উন্নয়ন এবং বৈষম্য হ্রাসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাই নাগরিক অধিকার এবং সুশাসন নিশ্চিত করার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশকে মুক্ত বাণিজ্যে আরও মনোযোগ দিতে হবে এবং কর সংগ্রহ ও বিদেশী বিনিয়োগের দিকে আরও বেশি মনোযোগ বাড়াতে হবে। অর্থ পাচার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন করা প্রয়োজন। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, জলবায়ু কর্মপরিকল্পনা এবং জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি এজেন্ডা বাস্তবায়নের মতো অন্যান্য বিষয়েও বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিয়ে আগাতে হবে।

সবাই স্বপ্ন দেখে আগামী দিনে বাংলাদেশে একটি সুন্দর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে রাজনৈতিক ডামাডোল, নির্বাচনী শঙ্কা, সংসদ থেকে বি এন পির পদত্যাগ সহ অন্যান্য কিছু বিষয় প্রকৃত গণতন্ত্রের যাত্রায় কিছুটা ছেদ ফেলেছে । বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী তিন দশকে বাংলাদেশ জিডিপি ও পিপিপির দিক থেকে মালয়েশিয়ার চেয়ে এগিয়ে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হবে। বিশ্বের ৩২ টি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশ স্থান পেয়েছে যা একটি বড় অর্জন। নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকা অনুকরণীয়। নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকা অনুকরণীয়। এমনকি এক দশক আগেও মাথাপিছু আয় ছিল ১০০০ মার্কিন ডলারের নিচে, অথচ সেই মাথাপিছু আয় আজ অনেক বেড়ে গেছে। জাতিসংঘের কিছু শর্ত পূরণের কারণে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে 1975 থেকে 1991 সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বৈরাচারী ভূমিকায় ছিল এবং সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা একই সঙ্গে উন্নয়ন ও গণতন্ত্র কামনা করি। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন যদি সমানতালে এগিয়ে যেতে পারে তাহলে বিশ্বে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বড় উদাহরণ। প্রকৃত উন্নয়নের উপহার দিতে হলে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, সুশাসন এবং জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন অনস্বীকার্য। নিখুঁত গণতন্ত্রের পথ মসৃণ নয়। ভৌগলিক অবস্থান, সংস্কৃতি, দর্শন, ঐতিহ্য, আদর্শ, রাজনৈতিক সততা, জনগণের ভূমিকা, সুষ্ঠু সাংবাদিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা একটি দেশের গণতন্ত্রের যাত্রাকে মসৃণ রাখে। বঙ্গবন্ধু যে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূরণ করবেন বলে সবাই বিশ্বাস করেন। সুষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনে দেশের গণতন্ত্র আরো মজবুত হবে বলে সবার প্রত্যাশা।