ফেলে আসা দিন গুলো – ১৭

এবাদত আলী

বিয়ের আড়ির সদায় ও শিংরানোর সদায়-পাতি তার সঙ্গে কয়েক বেড়ি পান বেশ কিছু আস্ত শুপারি এবং বিয়ে পড়ানোর পর ঝালের লাড়– যা গ্রামের মাতব্বরের নিকট আয়-দায় হিসেবে বুঝে দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে মোল্লার বিয়ে পড়ানোর খরচ বাবদ টাকা, এলাকার মসজিদ, মাদরাসা, গোরস্থান এবং যুবকদের সমিতি বা ক্লাবের জন্য নগদ টাকাও তার হাতে বুঝে দিতে হলো।
বিয়ে পড়ানোর জন্য আগে থেকেই একজন মৌলবী সাহেব উপস্থিত ছিলেন। তিনি গ্রামের মসজিদের ইমাম। পরনে একটি ময়লা পাজামা, চিতাপড়া এবং তালি দেয়া বুতাম বিহিন হাতাওয়ালা একটি জুব্বা পরা, মাথায় একটি ঝুল ওয়ালা পুরাতন টার্কিস টুপি পরে মোল্লা এলেন বিয়ে পড়নোর জন্য। মুখ ভর্তি পান তার সাথে জর্দা। এসেই এক বোগলা পিক ফেল্লেন চৌকির উপর বসে। আগে থেকেই ঘটকের মাধ্যমে বিয়ের কাবিন বাবদ ২ হাজার ১ টাকা ধার্য করা ছিলো তাই মৌলবৗ সাহেব উপস্থিত মেয়ের নিকট আত্মীয়কে উকিল এবং ছেলে পক্ষের লোকদের স্বাক্ষী হতে বল্লেন। বিয়ে রেজিষ্টারি কাজ তিনিই সমাধা করলেন একটি কাগজে বর, কন্যা এবং উকিল স্বাক্ষির সই স্বাক্ষর নিয়ে। উকিল স্বাক্ষি নিযুক্ত হলে উকিলের উদ্দেশ্যে তিনি কিছু কথা শিখিয়ে দিলেন যা তাকে পাত্রির নিকট গিয়ে বলতে হবে। তিনি বলেন অমুক গ্রামের অমুকের পুত্র অমুক নগদ বাকি দুই হাজার এক টাকা দেন মোহরের এওয়াজে আপনাকে সাদি করিতে আসিয়াছে, আপনি আমাকে উকিল নিযুক্ত করিয়া তাহাকে স্বামী হিসাবে কবুল করুন। এইভাবে তিনবার বলতে হবে। তিনবারই কন্যা বলবে কবুল। এই কথা স্বাক্ষীরা শুনে তারপর তার কাছে এসে রিপোর্ট করতে হবে। যথারীতি উকিল স্বাক্ষীরা কন্যার নিকট গিয়ে কন্যার স্বীকৃতি নেওয়ার জন্য উকিল তার কথা পেশ করলেন কিন্তু কন্যা কবুল বলছেনা। আশে পাশে জড়ো হওয়া মেয়েরা বলছে বলো কবুল। কিন্তু কোন কাজ হলোনা। কিছুতেই কবুল বলছেনা। সে শুধু কেঁদেই চলেছে। উপস্থিত বয়স্ক মহিলারা তাকে অনেক জ্ঞান দিলো নসিহত করলো। অনেকক্ষণ পর ক্ষীণকন্ঠে শোনা গেল কবুল শব্দ। তিনবার বলার পর উকিল স্বাক্ষীগণ মৌলবী সাহেবের নিকট ফিরে এলে তিনি বিয়ে পড়িয়ে দিলেন।
বিয়ে পড়ানোর পর মিলাদ শরীফ পাঠ অন্তে সংক্ষিপ্ত মোনাজাত করলেন এবং বরকে নামাজ-কালাম আদায় এবং বউকে পরদা পুশিদার মধ্যে রাখার জন্য বেশ কিছু নছিহত করলেন। বর তাতে সম্মতি জ্ঞাপনান্তে উঠে সকলের উদ্দেশ্যে সালাম জানালেন।
এরপর মিষ্টি মুখ করার নিয়ম। এ অঞ্চলে মিষ্টি মানে ঝালের লাড়–। বিয়েতে যারা বেশি বেশি ঝালের লাড়– দিতে পারে তারা ততটাই বনেদি। তবে এখানে যে ঝালের লাড়– তা হলো বড় বড় বাতাসা। বিয়ের গাড়ি আসবার সময় একটি গাড়িতে করে শুধু এই বাতাসা নিয়ে আসা হয়েছে। তাও আবার ধান রাখার জন্য ডোলে করে। ডোল অর্থ চাটাই বা খলপা দ্বারা নির্মিত গোলাকার বস্তুু। এবার খাবারের পালা । খাবার পরিবেশন করার জায়গায় হ্যাজাক জালিয়ে আলোকিত করা হয়েছে। বরের জন্য আলাদা খাবার। আস্ত মুরগি আসÍ মাছ ভাজি আরো কত কি।
বরযাত্রিদের জন্য কাঁসার থালা কাঁসার গেলাস এবং সাধারণ দাওয়াতিদের জন্য উঠানে বা খোলার উপর ধানের খড় এবং মাছ ধরার বানা বিছিয়ে পদ্ম পাতায় ভাত দেওয়া হলো। এরপর কচুর শাক ঘাঁটি যার নাম স্থানীয় ভাষায় সজি বা সব্জি। এরপর মহিষের গোশত। যে যত খেতে পারে তাকে তাই দেয়া হলো। কেউ যদি মহিষের গোশত খেতে না চায় তার জন্য খাসির গোশত। আমাদেরকে দুধরনের গোশতই খেতে দেয়া হলো। এরপর মাশকালাইয়ের ডাউল। তারপর ফিরনি মিষ্টি।
খাওয়া শেষে কন্যা বিদায়ের প্রস্তুতি। বাড়ির উঠানে একটি মাদুর বিছিয়ে বর কনেকে একত্রে দাঁড় করিয়ে কন্যার পিতা একটি কাঁসার থালার উপর কয়েকটি পান ও আস্ত সুপারি নিয়ে দাড়ালেন। বরের পিতার হাতের উপরে তার হাত তারউপরে বরের হাত এবং সবশেষে কন্যার হাত। কন্যার পিতা কাতর কন্ঠে বলেন আজ হতে আমার মেয়েকে আপনাদের হাতে সঁপে দিলাম। এরপর বর ও কন্যা কর্তৃক মুরুব্বিদেরকে সালাম করার পর্ব। দীর্ঘ সময় ধরে এই পর্ব সমাধার পর রওনা হবার প্রস্তুতি। এদিকে বরের শ্যালক- শ্যালিকারা আঁচলা-আঁচলি বেঁধে ফেলেছে। অর্থাৎ বরের পাঞ্জাবীর সঙ্গে কন্যার শাড়ির আঁচলে গিরা দিয়ে রেখেছে যা কিছু পয়সার বিনিময়ে কোলদারি তাদেরকে ছাড়িয়ে নেন।
এরপর ফিরবার পালা। আবার বিয়ের গাড়িতে চড়া হলো। আঁধার রাতে সকল গাড়িতেই একটি করে মশাল। অনেক রাতে আমরা আবার সাঁতইল গ্রামে ফিরে আসি। পরদিন ছেলের বাড়ি অর্থাৎ ফরজ আলীর বাড়িতে খাবারের বিরাট তামদারি। কন্যা পক্ষ আসবে ফিরনিতে তাদের মেয়েকে নিয়ে যাবার জন্য। সঙ্গে আসবে অনেক আত্মীয় স্বজন। অপর দিকে নিজেদের আত্মীয় কুটুম এবং পাড়া-প্রতিবেশিতো আছেই। ।(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট তাং১৪ /১ ২/২০২২