পাবনা প্রতিনিধিঃ
দিনে আশপাশে কেউ থাকেন না, যেন সুনসান নিরবতা। কিন্তু দিনের আলো ফুরিয়ে গেলেই শুরু হয় জোর প্রস্তুতি, আর রাতের অন্ধকার নামতেই শুরু হয় বালু (লোকাল) উত্তোলনের বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এভাবেই পাবনার সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া এলাকার পদ্মানদীতে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলনের এই মহাউৎসব। এতে বর্ষাকালে পদ্মা নদীতে ভাঙনের আশঙ্কা করছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা। শত শত বিঘা ফসলি জমিও হুমকির মুখে।
কাঞ্চন পার্ক সংলগ্ন এই বালু পয়েন্টের কয়েকশ মিটার দূরেই পাবনা-২ (সুজানগর-বেড়ার একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবিরের বাড়ি। আর এই বালু উত্তোলনের কর্মযজ্ঞের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পাবনা জেলা পরিষদের সদ্যনির্বাচিত সদস্য ও সংসদ সদস্যের ভাই ফররুখ কবির বাবু। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক বাবু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহিনুজ্জামান শাহিনেরও ঘনিষ্ট।
জানা গেছে, প্রশাসনের অনুমোদন না থাকলেও উপরের মহলকে ম্যানেজ করে এই কর্মযজ্ঞ চলছে। তারা অত্যন্ত প্রভাশালী হওয়ায় নদীপাড়ারের বাসিন্দা ও কৃষকরা ভয়ে মুখ খুলছেন না। দিনের বেলায় সেখানে কেউ থাকেন না, সন্ধ্যার পরপরই সাতবাড়িয়া বাজারে চলে প্রস্তুতি। বিভিন্ন জায়গা থেকে ছোট-বড় ৩০-৪০টি ট্রাক এনে সারিবদ্ধ করে রাখা হয় সাতবাড়িয়া বাজারের আশপাশে। এশার নামাজের পরপরই শুরু হয় বালু উত্তোলন। আশপাশের কঠোর নিরাপত্তার বলয়ে এই ট্রাকগুলো নির্ধারিত স্থানে বালু পৌছে দেয়।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কৃষকরা জানান, ‘দিনের বেলায় বোঝার উপায় নেই, এখানে বালু উত্তোলন হয় কিন্তু রাতে তারা এই কাজ করে। আমরা কিছু বলতে পারি না। অথচ যেখানে থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তার সঙ্গেই আমাদের কৃষি জমি-জমা। সেখানে আমরা চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করি। জিওব্যাগ দিয়ে ভাঙন রোধ করা চেষ্টা করলেও তাদের এইভাবে বালু উত্তোলনের ফলে সেটি ভেঙে যাচ্ছে। তাতে আগামী বন্যায় এখানে নদী ভাঙন দেখা দিতে পারে।’
বিষয়টি স্বীকার করেন ফররুখ কবির বাবু। তিনি বলেন, ‘এখানে কিছু গরিব মানুষ ড্রাম ট্রাক-মাক দিয়ে এইগুলো করে। রাতের বেলা তারা একটু টুকটাক (বালু) কাটে। তাও আবার কালকে (সোমবার) নিজেরা নিজেরা ঝামেলা করে বন্ধ হয়ে আছে। কে আগে কাটবে কে পরে কাটবে- এটা নিয়ে নিজেরা নিজেরাই ঝামেলা করেছে।’
তবে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘এই সবের পেছনে আমরা জড়িত নয়, ওরা নিজেরা নিজেরাই কাটে, মাঝে আমাদের একটু বলে যে ভাই একটু দেইখেন, প্রশাসনকে একটু বলে দিয়েন আমাদের যেন ধরেটরে না নিয়ে যায়- এই আরকি, অন্য কিছু না। মানুষ তো মনে করে এরাই তো সব, এরাই সব করছে। কিন্তু আমরা বালু ব্যবসা করলে তো কোটি কোটি টাকার মানুষ হয়ে যেতাম। আমরা এইসব বালুর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই।’
এব্যাপারে সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল ওয়াহাব বলেন, ‘সেখানে বালু উত্তোলনের কোনও অনুমোদন নেই। হয়তো সে (বাবু) এমপির ভাই, এই ক্ষমতা বলেই জোর করেই বালু তুলছেন। এছাড়াও আরও অনেকেই তার পেছনে আছেন। অবৈধভাবে বালু তুলছেন এটা সম্পূর্ণ সত্য।’
বিষয়টি স্বীকার করে সুজানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হান্নান বলেন, ‘সাতবাড়িয়ার মাছের আরতের পেছন দিয়ে রাতে এটি চলছিল, আমাদের কাছে তথ্য ছিল। কিন্তু আমরা গতকাল (সোমবার) রাত সাড়ে ৮টার দিকে ওখানে গিয়ে ধরেছি এবং ভ্যাকুসহ কারেন্টের তার ছিড়ে সেখানে বালু উত্তোলন বন্ধ করে এসেছি, আপাতত বন্ধ আছে।’
কিন্তু একই সময়ে এই প্রতিবেদকরা উপস্থিত থাকার বিষয়টি জানালে ওসি বলেন, ‘আপনারা (সাংবাদিকরা) ওইখানে থাকলে তো আমাদের সঙ্গে দেখা হতো। আপনারা যতটুকু প্রেজেন্ট ছিলেন সেই টুকুর রিপোর্ট করেন, আর আমার বন্ধ করে রেখে আসার দরকার বন্ধ করে রেখে আসছি।’
এব্যাপারে পাবনা-২ (সুজানগর-বেড়ার একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির বলেন, ‘আমি আজ সকালে শুনছি- আসলে ওখানে কিছু জমিতে জলাবদ্ধতা ছিল, সেই জলাবদ্ধতা দূর করতে একটি ক্যানাল কাটতে লাগছিল। কিন্তু নিজেরা নিজেরা মারামারি করায় ওসিকে বলে বিষয়টি বন্ধ করে দিয়েছি।