পাবনার সিংহ পুরুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল এর সাক্ষাৎকার -১০

এবাদত আলী
(পুর্ব প্রকাশের পর)
(পাবনার মক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জল নক্ষত্র, পাবনার সিংহ পুরুষ নামে খ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল মৃত্যুবরণ করেন ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। তার এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয় ১৯৯৫ সালের ২৭ ও ২৮ মে তারিখে। যা নি¤েœ হুবহু তুলে ধরা হলো।)।
“সাক্ষাৎকার”
কোরিয়ার হিসাবে পাবনার মকবুল স্যারের ছেলে ফারুক, কাচারীপাড়া সাহারা ক্লাবের মুনু সরদার, সাধুপাড়ার লেবু, কোমরপুর চরের জনৈক মালিথা সংবাদ আদান প্রদান করতো। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর মধ্যে অনেক স্থানে মতবিরোধ থাকলেও পাবনা জেলায় মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর মধ্যে কোন দ্বন্দ ছিল না।
আমার নেতৃত্বে সকলেই এক মন নিয়ে কাজ করেছে। এই গ্রুপটিতে মোঃ ইকবাল, আব্দুর রাজ্জাক মুকুল, গোলাম মাহমুদ, জহুরুল ইসলাম বিশু, রিদ্দিক, ফজলুল হক মন্টু, শাহজাহান, রেজা, চঞ্চল, ও লাল (স্বাধীনতার পর পাবনা বাণী সিনেমা হলের নিকট চঞ্চল নিহত হয়)। আব্দুস সামাদ, গোলাম মোর্শেদ হেড মাষ্টার আমির মান্নু, নুরুজ্জামান বিশ্বাস প্রভৃতি মুক্তিযোদ্ধাগণ ছিল জলঙ্গী বর্ডারের নিকটে। একটি ইক্ষু ফার্ম হতে রাতের বেলা তাদেরকে অস্ত্র শস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ নৌকা যোগে পাঠিয়ে দিয়ে আমরা রাতের বেলা সেই মসজিদে সামরিক পয়েন্টে চলে যাই। কিন্তু ভোর বেলা আমাদের কাছে খবর আসে যে, মুক্তিযোদ্ধাগণ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পেরে ফিরে এসেছে। ১৪ই আগষ্টে বাংলাদেশে অবস্থানকারি পাকিস্তানিদের উপর একটি বড় ধরনের হামলা হতে পারে আশংকায় তারা সকল স্থানে পাহারা জোরদার করে। মুক্তিযোদ্ধাগণ পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিকট না পৌঁছাতেই টহলরত গানবোটের সার্চ লাইট গিয়ে তাদের নৌকার উপর পড়ে। তখন অবস্থা বেগতিক দেখে তারা নৌকা নিয়ে জলঙ্গী সিমান্তে ফিরে আসে। এ ধরনের প্রস্তুতি কোরিয়দের জানা ছিল না। অগত্যা তাদেরকে মসজিদের নিকট সেই পয়েন্টে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। পানিপথ বাতিল করে পরদিন পায়ে হাটা পথে প্রায় ১শ ৫০ জনের এই দলটিকে বাংলাদেশে পাঠাবার সুব্যবস্থা করা হয়। পুনরায় কোরিয়ার দ্বারা কড়িডোর গুলোর সর্বশেষ অবস্থা জানার পর প্রতি ১০ জনের জন্য ১টি করে গ্রুপ তৈরী করা হয়। সেই গ্রুপে ১জন কমান্ডার, ১জন ডেপুটি কমান্ডার ও বাকি ৮ জন সাধারণ সোলজার ছিল। তারা প্রথমে তালবাড়িয়া, তারপর ডিগ্রির চরে জফির ডালিকি সেলটার মাষ্টারের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। সেখানে ২/১ দিন অবস্থান করে রাস্তা পথের অবস্থা ভাল করে রেকি করে তার পর খন্ড খন্ড দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিবাহিনী পাবনা জেলায় বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পর্যায়ক্রমে গোটা পাবনা জেলায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার এফ, এফ, ও মুজিব বাহিনী ঢুকে পড়ে। এদের কাছে যে সকল অস্ত্র ছিল তা হলো এস এল আর, এস এম জি, সেভেন পয়েন্ট সিক্সটু, জি এফ রাইফেল, আর সি এল গান, ইন্ডিয়ান রিভালবার, হ্যান্ড গ্র্যানেড, মাইন, এক্সপে¬াসিভ ইত্যাদি ইত্যাদি।
দ্রুত যোগাযোগের জন্য কোন কোন টিমের সাথে ওয়ারলেস সেট ছিল। যোগাযোগ হতো বারাকপুর ক্যান্টমেন্টর সঙ্গে ওয়ারলেস অপারেটরদেরকেও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। ভারত হতে ট্রেনিং নিয়ে যারা পাবনায় প্রবেশ করতো তাদেরকে মাসিক ২শ টাকা করে ভাতা প্রদান করা হতো। তালবাড়ীয়া ডিগ্রীর চরের সেলটারে জফির ডালিকীর বাড়ী পর্যন্ত আমি নিজে গিয়ে সেই টাকা পৌছে দিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যেতাম। মসজিদ পয়েন্ট ক্যাম্পে থেকে পাবনার মুক্তিযোদ্ধাদের রুট মাষ্টার বা অবস্থান এবং আক্রমনের স্থান চিহ্নিত করনের যে বিশেষ নকশা প্রস্তুত করা হতো। পাবনা জেলা পরিষদের রমেন বাবু আমাদের ক্যাম্পে বসে সেই নকশা প্রস্তুত করে দিতেন।
তখন রমজান মাস। একটা বড় ধরনের অপারেশনের প্রস্তুতি চলতে থাকে। সে মোতাবেক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অতিরিক্ত অস্ত্র পাঠানো প্রয়োজন। এবারে আমি মেছের ও হাশেম সহ একটি বড় দল নিয়ে তালবাড়ীয়া ডিগ্রীর চর পার হয়ে প্রথমে জফির ডালিকীর বাড়িতে উঠি এবং সেখান থেকে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে মাধপুরের আবুল ডাক্তারের বাড়িতে যাই।
অস্ত্র শস্ত্র বোঝাই বাক্সগুলো যথারীতি গর্ত খুড়ে মাটির নীচে পুতে রাখা হয়। ঐ রাতে ভোর বেলা পাক আর্মিরা মাধপুর গ্রাম অতর্কিত আক্রমণ করে বসে। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আসা পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধাগণ তখন ঘুমে অচেতন। এইচ, এম, জির ফায়ারে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। এলাকাটি পুর্ণ নিরাপদ বলে আমাদের পক্ষ থেকে কোন পাহারারও ব্যবস্থা করা ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে আত্মরক্ষামুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো। পাক আর্মিরা গুলি ছোড়ার পাশাপাশি বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দিতে লাগলো। আবাল-বৃদ্ধ বনিতা সকলেই প্রাণভয়ে পালাতে আরম্ভ করলো। তারা প্রায় ১১/১২জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে চলে যায়। পাক হানাদার বাহিনী চলে যাবার পর আমরা অস্ত্র তুলে নিয়ে আওতাপাড়া ফেরুর বাড়িতে অন্য সেলটারে চলে যাই।
এ সময় পাক হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি নকশাল বাহিনীর অত্যাচার আরো চরমে পৌছে যায়। তারা তিনগাছা বাবুর বাগানের কাছে মুক্তিযোদ্ধা মহরমকে হত্যা করে। নকশাল বাহিনী পাবনার শিলু মাষ্টার, নুরুল, ইউনুছ খানকে হত্যা করে। এ ছাড়া নাজিরপুরের হাবু চেয়ারম্যানের ছোট ভাই সাবু নকশালদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করায় তারা হাবু চেয়াম্যানের উপর নানা ভাবে অত্যাচার আরম্ভ করে। চরের আব্দুল হাই এর উপরও তারা নানা ভাবে অত্যাচার চালাতে থাকে। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।