পাবনার সিংহ পুরুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল এর সাক্ষাৎকার -৯

; এবাদত আলী
(পুর্ব প্রকাশের পর)
(পাবনার মক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জল নক্ষত্র, পাবনার সিংহ পুরুষ নামে খ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল মৃত্যুবরণ করেন ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। তার এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয় ১৯৯৫ সালের ২৭ ও ২৮ মে তারিখে। যা নি¤েœ হুবহু তুলে ধরা হলো।)।
“সাক্ষাৎকার”

এমনি করতে করতে একদিন আমার খালু আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি আমাকে তার গাড়িতে করে বাংলাদেশ হাই কমিশনার এম হোসেন আলীর কাছে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এ পর্যস্ত বলে রফিকুল ইসলাম বকুল থেমে গেলেন। কখন যে ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারটা বেজে গেছে তা কারো খেয়াল নেই। সেদিনের মত বিদায় নিয়ে আমরা উঠে পড়লাম। সেসময় কথা হলো আগামিকাল রাত আটটার সময় আবার বসা হবে। সে সময় পাশে বসে থাকা রফিকুল ইসলাম বকুলের একমাত্র পুত্র ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র নুরুল ইসলাম পরদিন যেন আমরা আবার আসি সে জন্য বার বার অনুরোধ করলো।
পরদিন যথা সময়ে আমরা গিয়ে হাজির হলাম। মাগরিবের নামাজ শেষ করে তিনি আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। সালাম ও কুশলাদি বিনিময় হলো। কোন ভুমিকা না করেই বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল বলতে আরম্ভ করলেন। হাই কমিশনার অফিস থেকে আব্দুস সামাদ আজাদ সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী কার্যালয়ে। সেখানে তাজ উদ্দিন সাহেব, ক্যাপ্টেন এম, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের পরনে ছিল ধুতি।
সেখানে গিয়ে তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক এর সঙ্গেও দেখা হয়। তারা আমাকে সঙ্গে করে ভবানীপুরের এম,পি চিত্তরঞ্জন বাবুর ওখানে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে দেখি সিরাজ ভাইয়ের (সিরাজুল আলম খান) দারুন পক্স বেরিয়েছে। তিনি মশারির মধ্যে শুয়ে আছেন। তারা সেখানে মুজিব বাহিনী গঠন সম্পর্কে আলোচনা করে আমাকে পাবনা জেলার জন্য লিডার হিসাবে দায়িত্ব দিলেন। জনৈক গ্রাম পঞ্চায়েতের সহায়তায় শিকারপুর থেকে কেচুয়াডাঙ্গ্ াপ্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের ক্যাম্প স্থানান্তর করা হয়।
আমার সঙ্গে ছিলেন আহমেদ বশির, মন্টু দাস, ইকবাল হোসেন ও জহুরুল ইসলাম বিশু। আমরা কেচুয়াডাঙ্গাতে ক্যাম্প স্থানান্তরের জন্য হাই কমিশনার জনাব এম হোসেন আলীর কাছে গিয়ে আনুষাঙ্গিক জিনিষ চাইলে তিনি হাড়ি পাতিল থেকে শুরু করে চাউল ডাউল ও চিড়া দিলেন। কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে যুবকদের ভিড় বাড়তে লাগলো, পাবনা গোপাল পুরের আব্দুল হাই, পাবনা চরতারাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গেদামনির ভাই ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর যুবকদেরকে পিটি প্যারেড করাতো এবং পাবনার আর, আই আবুল খায়ের এই ক্যাম্পের যুবকদেরকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন।
এর পর ইকবাল বিশু সহ একটি টিমকে হায়ার ট্রেনিং এর জন্য দেরাদুন মিলিটারী একাডেমীতে পাঠানো হয়। এরপর কলকাতার থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ি কার্যালয়ে গিয়ে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে দেখা করি। তিনি এক পর্যায়ে বলে¬ন এ যুদ্ধ ভিয়েতনামের যুদ্ধের মত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। তাই স্থায়ীভাবে ক্যাডার তৈরী করতে হবে। জনগনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে আমাদের পক্ষে থাকার জন্য। মুজিব বাহিনীর কমান্ডারকে ৪টি সেক্টরে তখন ভাগ করা হয়। এসব ব্যাপারে মূল উদ্যোক্তা যারা ছিলেন, তারা হলেন তোফায়েল আহমেদ, নুরে আলম জিকু, ইলিয়াস ও ফজলুল হক মনিভাই। কেচুয়াডাঙ্গাকে মুল ক্যাম্প রেখে সেখান থেকে প্রায় এক মাইল দুরে জঙ্গলের মধ্যে একটি পরিত্যক্ত মসজিদের চারিদিকের ঝোপ জঙ্গল পরিস্কার করে সেখানে একটি গোপন পয়েন্ট করা হয়। এই পয়েন্টের কথা স্থানীয় লোকজনও জানতো না। জঙ্গলের মাঝে মসজিদে আমরা নামাজ পড়তাম বলেই লোকজন জানতো। এই মসজিদ সশস্ত্র পয়েন্ট। ভারতের বিভিন্ন আর্মি ট্রেনিং একাডেমি থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র শস্ত্র সহ চলে আসতো তাদেরকে কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে না রেখে সরাসরি এ পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হতো। এই পয়েন্ট হতে পাবনা জেলা পর্যন্ত অনেকগুলো সেলটার মাষ্টার ছিলো। ভারত থেকে বেরিয়ে সেলটার মাষ্টারদের কড়িডোর ধরে মুক্তিযোদ্ধাগণ পাবনার দিকে অগ্রসর হতো। প্রথেমে এক সেলটার মাষ্টারের বাড়ীতে গিয়ে উঠে সেখান থেকে পরবর্তী সেলটার মাষ্টারের বাড়ি পর্যন্ত যেতে পথে কোন অসুবিধা হবে কিনা এ সম্পর্কে কোরিয়ার (সংবাদদাতা মুক্তিযোদ্ধা) কর্তৃক নিশ্চয়তা প্রদানের পরই মুক্তিযোদ্ধারা মুভ করতো। এই ধরনের একটি সবচেয়ে বড় সেলটার ছিল ঈশ্বরদী থানার ডিগ্রিচর তালবাড়িয়া গ্রামের জফির উদ্দিন ডালিকি (জফির ডালিকি) তার অপর একটি বাড়ী ছিল চর গড়গড়ি। সেখানে মুক্তি যোদ্ধাগণ অবস্থান করতো।
আগষ্ট মাসের ১২ তারিখে (১৯৭১) ট্রেনিং শেষ করে প্রথম একটি ব্যাচ ব্যারাকপুর পৌছে। ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে এই ব্যাচকে বাংলাদেশে পাঠানো হবে। এ সম্পর্কে আলোচনা হলো। সিদ্ধান্ত হয় যে তাদেরকে জলঙ্গী বর্ডার দিয়ে পাঠানো হবে। কেচুয়াডাঙ্গা হতে জলঙ্গীর দূরত্ব ৬ মাইল মত হবে। তাদেরকে সেই মসজিদের সেলটার পয়েন্টে রেখে নৌকা ঠিক করা হলো। কোরিয়ারগণের মাধ্যমে রাস্তাঘাটের খবরা খবর নেওয়া হলো। কোরিয়ারগণ ভারত হতে বাংলাদেশ পর্যন্ত করিডোর নিরাপদ বলে জানায়।
(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।