ফেলে আসা দিন গুলো-এগারো

এবাদত আলী
১৯৬৬ খ্রীষ্টাব্দের কথা। সবেমাত্র এস,এস,সি পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। হাতে প্রচুর সময়। সহপাঠি বন্ধু নজরুল ইসলাম রবি, আব্দুস সাত্তারসহ আমরা কয়েকজন পুর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা শহরে বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা করলাম। তবে আমার মুল উদ্দেশ্য ছিল টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখা। দিনক্ষণ ঠিক হলো। সকাল বেলা বাড়ি থেকে বের হয়ে মটর গাড়িতে চেপে ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনে গেলাম। বিশ্বাস কোম্পানীর মটর গাড়ি যেন মুড়ির টিন। তার আবার দুটি দরজা। ড্রাইভিং সিটের পরেই লোহার রড দিয়ে ঘিরে প্রথম শ্রেনীর কেবিন। এর পর দ্বিতীয় শ্রেনী। অবশিষ্ট সিটগুলি থার্ড ক্লাশ। প্রথম শ্রেনীর ভাড়া একটু বেশী। আমরা তিনজন বেশী ভাড়া দিয়ে প্রথম শ্রেনীতেই গেলাম। ঈশ্বরদী বাস ষ্ট্যান্ডের সাথে লাগোয়া রেলের টিকিট কাউন্টার। ঢাকা পর্যন্ত টিকিট কেটে ট্রেনের অপেক্ষায় দীর্ঘ সময় কাটানোর পরে ট্রেন এলো। নাম ঢাকা মেইল।
কিন্তু প্রায় প্রতিটি ষ্টেশনেই যাত্রা বিরতি দিতে লাগলো। বিকালের দিকে আমরা সিরাজগঞ্জ ঘাটে পৌছলাম। সিরাজগঞ্জ ঘাট থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ষ্টিমারে যেতে হবে। সময় কমছে কম সাড়ে তিন ঘন্টা। কি আর করা। ষ্টিমারের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করে বসে সময় কাটানোর পর সন্ধ্যা সাতটার দিকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে পৌছানো হলো। শুরু হলো হুড়োহুড়ি দৌড়াদৌড়ি যে যার আগে পারে ঘাটে তীরে প্রায় আধা মাইল দূরে দন্ডায়মান ট্রেনে চড়তে হবে। সঙ্গে যাদের মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাদের জন্য নির্ঘাত রোজ-কেয়ামত। আমাদের কাছে একটি করে ব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই। তাই বালি ডিঙ্গিয়ে ড্যাং ড্যাং করে ট্রেন পর্যন্ত পৌছে গেলাম। বিভিন্ন ধরনের যাত্রীতে ট্রেনের কামরায় ঠাসাঠাসি, সিরাজগঞ্জ ষ্টেশন ঘাট হতে কয়েকটি ষ্টিমারের যাত্রী একত্রিত করে তবে ট্রেন ছাড়ে। একটু পরেই শেষ ষ্টিমার এসে ঘাটে ভিড়লো। ঐ ষ্টিমারের যাত্রীরা আসার পর ট্রেন ছেড়ে দিলো।
সরিষাবাড়ী হয়ে জামালপুর। জামালপুর থেকে ময়মনসিং গিয়ে শেষ রাতের দিকে গাড়ি বদল করতে হলো। জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হতে ছেড়ে আসা মেইল ট্রেনটি এখান থেকে সোজা আখাউড়া হয়ে চট্রগ্রাম চলে যায়। ময়মনসিং জংশন থেকে ট্রেন বদলের জন্য যাত্রী সাধারণ নির্ঘুম রাত কাটায়। অনেক যাত্রী আবার টের না পেয়ে ট্রেন বদল করতে না পেরে ভিন্নপথে চলে যায়। আমরা এ ব্যাপারে আগে থেকেই শতর্ক ছিলাম। ভোরবেলা ট্রেন গিয়ে থামলো ফুলবাড়িয়া রেলষ্টেশনে। সেখান থেকে তিন জন তিন দিকে যাওয়া। ওরা দুজন আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেল, আর আমি উঠলাম ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হোষ্টেলে। কুষ্টিয়ার ওয়াজেদ মাষ্টারের ছেলে আব্দুল কাদের যিনি এস,এস,সি তে ঢাকা শিক্ষাবোর্ড থেকে ৩য় স্থান অধিকার করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছেন। পাবনা জেলা স্কুলে লেখাপড়া করার সময় তিনি আমাদের বাড়িতে জায়গির থাকতেন। আমাকে পেয়ে কাদের ভাই মহা খুশি।
তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালেন। সন্ধ্যায় টেলিভিশন দেখার জন্য নানান প্রস্তুতি নিয়ে রাখলেন। পুর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় সর্ব প্রথম ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর পাস্তিান টেলিভিশনের যাত্রা শুরু। ( বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর এর নাম পরিবর্তন করে ‘ বাংলাদেশ টেলিভিশন’ নাম করণ করা হয় এবং ১৯৮০ সাল থেকে এটি রঙিন সম্প্রচার শুরু করে।)
যাক সেসময় কেবলমাত্র কিছু সংখ্যক প্রতিষ্ঠান ও সৌখিন ব্যক্তির বাসায় টেলিভিশন সেট স্থান করে নিতে শুরু করেছে। তাও আবার সাদা কালো। এ সময় ঢাকা শহরের ১০ বেসার্ধ মাইলের মধ্যে কেবল অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো।
সন্ধ্যা ছটায় টেলিভিশনের অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হবে তাই আগে ভাগে বিকাল সাড়ে পাঁচটায় আমাকে নিয়ে কাদের ভাই হলরুমে ঢুকলেন। তখুনি প্রায় হলরুম দর্শকে ভর্তি। বিরাট হলরুমের মঞ্চের মাঝামাঝি জায়গায় একটি জলচৌকির উপর বসানো যে যন্ত্রটি তা কাপড় দিয়ে সযতনে ঢাকা রয়েছে। আমি তখনো পর্যন্ত টেলিভিশন কি জিনিস দেখিনি। আর দেখার কথাও নয়। সকলেই উৎসুক দৃষ্টিতে অপেক্ষা করছেন টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখার জন্য। সময় গড়িয়ে যায় তবু অপেক্ষার পালা যেন শেষ হতে চায় না। ছোট বেলা আমাদের পাশের গ্রামের দাপুনিয়া হাটে যেতাম। হাটের এক কোনে সর্ব রোগের মহৌষধ বিক্রতা দর্শকদের জন্য মজমা লাগাতো। লাল কাপড় দিয়ে একটি বস্তু ঢেকে রেখে বলতো মানুষের কাটা মাথা আছে ওর ভেতরে। ঐ কাটা মাথা একটু পরে নড়া চড়া করবে। একথা শুনে দর্শকেরা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতো। সেই কাটা মাথার নড়াচড়া দেখার জন্য। তবে মাঝে মধ্যেই দর্শকদেরকে আনন্দ দেয়ার জন্য ঐ মাথা নড়াচড়া করতো। কিন্তু ঔষধ বিক্রি শেষ হলেও কাটা মাথার লাল কাপড় সরানো হতো না। আসলে সেখানে খুঁটি পুতে তাজা কচ্ছপ বেধে রাখা হতো। আর সে কারনে র্দশকদের ভিড় সারাক্ষনই লেগে থাকতো।
টেলিভিশনের দর্শকদের জন্য কাটা মাথা না রাখা হলেও তার চেয়ে কৌতুহল ছিলো অনেক বেশি। মিনিট দশেক সময় বাকি থাকতে টেডি প্যান্ট পরা ও তিন পকেট ওয়ালা কাবুলি শার্ট গায়ে এক ভদ্র লোক এলেন। তিনি মঞ্চে বেশ খানিক সময় ঘোরাঘুরি করলেন।
পরে জেনেছিলাম তিনি একজন পিয়ন। যাক ভদ্রলোক হাত ঘড়ি দেখতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর টেলিভিশন নামক বস্তুটির কাছে এসে ম্যজিশিয়ানের ভঙ্গিতে টেলিভিশনের উপরের কাপড়টা সরিয়ে ভাঁজ করে পাশে রেখে দিলেন। জীবনের প্রথম আমি টেলিভিশন দেখলাম। প্রান ভরে দেখলাম, আর ভাবলাম আমার মত সৌভাগ্যবান ব্যক্তি আর কজন আছে এ জগতে ? ভদ্রলোক টেলিভিশনের নব ঘোরাতেই ফটফট কটকট শব্দ। এর পর শো শো শব্দ হতে হতে এক ব্যক্তির ছবি ভেসে উঠল পর্দায়। সঙ্গে সঙ্গে কন্ঠস্বর আচ্ছালামু আলাইকুম। ভাই আত্তর বাহিনে লিজিয়ে মেরা সালাম। সারা হলরুম তখন দর্শকে ঠাসাঠাসি গাদাগাদি। পিন পতনের শব্দ নেই। সকলেই গভির মনযোগসহ দেখছে ও কথা শুনছে।
রোমাঞ্চে আমার শরীর শিহরিত ও মন আন্দোলিত। এর পর ইয়ে পাকিস্তান টেলিভিশন হায়। আপ থোড়া দেরকে বাদ খবর শুনিয়ে বলতে বলতেই পাঞ্জাবী গায়ে এক ভদ্রলোক হাতে কিছু কাগজ নিয়ে খবর পাঠ শুরু করলেন। উর্দু ভাষায় খবর পাঠ হতে লাগলো। আখবারে নুমায়েন্দুনে কাহা ইত্যাদি ইত্যাদি পাঠ শুনে জীবন ধন্য মনে হতে লাগলো। উর্দু ভাষা যারা বুঝে তাদের জন্য বিষয়বস্তু হুদয়ঙ্গম করা সম্ভব হলো। আর যারা সমঝদার নয় তারা শুধু হায় হুই শব্দ শ্রবন ছাড়া কিছুই বুঝলো না। না বুঝলে কি হবে। অধীর আগ্রহ ভরে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানতো দেখা হচ্ছে। মওসুম কা হাল অর্থাৎ আবহাওয়া বার্তা পড়া শেষ করে খবর পাঠক পর্দা থেকে বিদায় নিলেন। এরপর অপর ব্যক্তি কর্তৃক পাকিস্তানি গভর্নমেন্ট তরিকা কি হালচাল ও অন্য একটি উর্দু কথিকা পাঠ শেষে অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেল।
দেশ জয় করলে যেমন আনন্দ হয় আমার প্রথম টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখার আনন্দও যেন ঠিক তেমনি। তিনদিন ঢাকায় অবস্থানের পর তিন বন্ধু যখন ফুল বাড়িয়া রেল ষ্টেশনে মিলিত হয়ে ট্রেনে চড়ছিলাম তখন ওদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোরা কি টেলিভিশন দেখেছিস? ওরা আমার কথায় থ-বনে গেল। তার মানে ওরা এমন মজার জিনিষ দেখার সুযোগই পায়নি। আমি তাই মনে মনে
বল্ল¬াম ঢাকায় এসে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান না দেখে বাড়ি ফিরছিস ওরে হতভাগা তোদের জীবনটাই তবে মিছে।
(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।