ইয়ানূর রহমান : প্রধান শিক্ষক পদের দায়িত্ব পালনসহ অভ্যন্তীরণ দ্বন্দ্বে ৩১ শিক্ষক -কর্মচারির বেতন পাচ্ছেন না গত ৪ মাস ধরে। যশোরের মনিরামপুরের রাজগঞ্জ শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক- -পরিচালনা কমিটির মধ্যে এ দ্বন্দ্ব চলে আসছে গত দু’বছর ধরে। বর্তমানে বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ২৫ লাখ টাকার দুর্নীতিসহ চাকরির বৈধতা তুলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমকে দায়িত্ব থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় ২০২১ সালের ৫ জুলাই থেকে। বিদ্যালয়ের এডহক কমিটি প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আক্তারুজ্জামানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়। এলাকার জনৈক সোহেল রানা সভাপতির দায়িত্ব থেকে ৫ সদস্যের এডহক কমিটি গঠন করেন।
সূত্র মতে, ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট তারিখ হতে এই সোহেল রানা ৬ মাস মেয়াদী করে এডহক কমিটিতে আসেন। অবশ্য মাঝখানে স্থানীয় কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল লতিফও ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর তারিখে ৬ মাসের জন্য সভাপতি মনোনিত হয়ে এডহক কমিটির প্রতিনিধিত্ব করেন।
জানাগেছে, সোহেল রানা দ্বিতীয় মেয়াদে সভাপতির দায়িত্বে আসার পর প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমকে চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতি চেয়ে ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড যশোরের আপিল এন্ড আরবিট্রেশন কমিটির নিকট প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করেন। অবশ্য বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি এরই মধ্যে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করানোসহ প্রতিবেদনও বোর্ডে দাখিল করা হয়।
সূত্রমতে, এতো কিছুর পরও শিক্ষাবোর্ডের আপিল এন্ড আরবিট্রেশন গত ২০২২ সালের ১০ মে উভয় পক্ষকে নিয়ে শুনানি শেষে জাহাঙ্গীর আলম নির্দোষ প্রমাণিত হলে আরবিট্রেশন বোর্ড তাকে সকল অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন। একই সাথে গত ২৩ মে স্মারক নম্বর-বিঅ-৬/৬৩৩২/৫০৩ পত্রে বিদ্যালয় পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলমকে যোগদান করানোসহ সকল পাওনাদি বুঝে দিতে বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলকে পত্র প্রদান করেন।
শিক্ষা বোর্ডের এই আদেশ বলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আক্তারুজ্জামান ২০ জুলাই জাহাঙ্গীর আলমকে দায়িত্ব বুঝে দেন। এরই মধ্যে সোহেল রানা আবারও তৃতীয় বারের মত ৬ মাসের জন্য এডহক কমিটির সভাপতি হয়ে বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটিতে আসেন। সৃষ্ট জটিলতা নিয়ে গত ১ আগস্ট জাহাঙ্গীর আলমকে আবারও বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সাথে সেই শিক্ষক আক্তারুজ্জানকে পুনরায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তবে আক্তারুজ্জামানকে পরিচালনা কমিটি দায়িত্ব দিলেও বিদ্যালয়ে স্ব শরীরে হাজির হয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন জাহাঙ্গীর আলম। এসবের মধ্যে মোস্তফা কামাল নামের এক অভিভাবক বাদী হয়ে গত ২৫ মে উচ্চ আদালতে (হাই কোর্ট) রিট করেছেন। রিটের শুনানি শেষে গত ২৮ আগস্ট বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সকল কার্যক্রম ৬ মাসের স্থগিত করে আদেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
এদিকে জাহাঙ্গীর আলম এবং আক্তারুজ্জামান যার যার অবস্থানে থেকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন।
এসব দ্বন্দ্বের কারণে বিদ্যালয়ের ৩১ শিক্ষক-কর্মচারী জুলাই মাস থেকে গত ৪ মাসের বেতন পাননি। ফলে সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারী চরম সংকটের মধ্যে পড়েছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আক্তারুজ্জামান মুঠো ফোনে বলেন, আমি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হলেও কোনো শিক্ষক কর্মচারী আমার স্বাক্ষরে বেতন বিল গ্রহণ করবেন না। তারা সাময়িক বরখাস্ত হওয়া প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছেন। তবে এসব বরখাস্তাদেশ মানতে রাজি নন প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি দাবি করেছেন, এডহক কমিটি কোনো শিক্ষক-কর্মচারীর বরখাস্ত করার এখতিয়ার নেই। যে কারণে কথিত ওই সাসপেন্ড আমি মানি না।
মুঠো ফোনে জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের সভাপতি সোহেল রানা জানান, বিধিমালা অনুসরণ করেই জাহাঙ্গীর আলমকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, কোর্টে আদেশ অনুযায়ী আমি এখন আর বিদ্যালয়ের সভাপতি নেই। তাছাড়া দু’জন হেড মাষ্টার দাবি করায় তাদের বেতন হচ্ছে না। এখন তাদের বেতন নিতে ইউএনও এবং মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের অফিস হয়ে যেতে হবে।
বিদ্যালয়ের সৃষ্ট এসব পরিস্থিতি নিয়ে চেইন-অব-কমান্ড ছাড়াও শিক্ষার পরিবেশ ভেঙে পড়েছে। বিদ্যালয়ের অভিভাবক সদস্য হানুয়ার গ্রামের নাদিরা সুলতানা ও আমিনুর রহমান ক্ষোভের সাথে জানান, তাদের মেয়েরা এ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিতে পড়ে।
শিক্ষক-কর্মচারী এবং কমিটির দ্বন্দ্বে স্কুলটারে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে। আমরা বাচ্চাদের নিয়ে এখন নিরুপায়। রাতদিন গোন্ডগোল থাকলে সেখানে শিক্ষার পরিবেশ থাকে না। তবে, বিদ্যালয়ের এসব সৃষ্ট জটিলতা নিরাসন করতে উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র সরকার সাংবাদিকদের বলেন, দু’জন প্রধান শিক্ষক দাবি করায় তার সমাধান না করে বেতন দেয়া যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে নির্বাহী অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার কর্মকার বলেন, প্রতিষ্ঠানের এক আবেদনের প্রেক্ষিতে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে ইউএনও স্যার উদ্যোগ নিয়েছেন। গত ৭ তারিখে স্যার ভারতে যাওয়ার কারণে আপাতত কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে স্যার ফিরলেই বিষয়টি সমাধান করা হবে।