বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুিজবুর রহমান ছিলেন বাংলার বন্ধু বাঙালির বন্ধু সোনার বাংলার স্থপতি। তিনি এই বাংলাদেশের অবহেলিত নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার দাবির সফল বাস্তবায়নের এক মহারথি-মহাপুরুষ। একটি শোষনহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলে দেশটিকে সোনার বাংলায় পরিণত করার অভিপ্রায়ে তাঁর লালিত সপ্ন সফল করার জন্য আজীবন আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছেন।
ক্ষনজন্মা এই মহানায়ক জন্মগ্রহন করেছিলেন তৎকালিন ফরিদপুর (বর্তমানে গোপালগঞ্জ) জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। ১৯৪১ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে আইএ এবং ১৯৪৭ সালে তিনি বিএ পাশ করেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু ১৯৪০ সালে। বহুবিধ চড়াই- উৎরাই পাড়ি দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন চলতে থাকে। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি হলে তাঁর উপর নিপীড়নের মাত্রা তীব্রতর হতে থাকে।
১৯৬৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৬৬ সালে বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসুচি ঘোষণা করেন। এসময় তাঁকে নিরাপত্তা আইনে আটক করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তাঁকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু ‘৬৯ গণঅভ্যুত্থানের প্রভাবে পাকিস্তানের শাষকগোষ্ঠি সে মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি উক্ত মামলা প্রত্যাহারের পরদিন অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের নাগরিক সংবর্ধনা প্রদানের মাধ্যমে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভুষিত করা হয়।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একক বিজয় অর্জিত হয়। কিন্তু সরকার গঠনের সুযোগ না দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের আহŸান জানান। তাঁর আহŸানে সাড়া দিয়ে সারা দেশ অচল হয়ে পড়ে। তিনি ৭ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। তিনি লাখো জনতার উপস্থিতিতে বজ্রকন্ঠে উচ্চারণ করেন“ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের বেলা বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে বসে। তারা নির্বিচারে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। বাংলার অকুতভয় জনগণ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। বাংলার দামাল ছেলেরা জীবন বাজি রেখে স্বেচ্ছায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের নাম লিপিবদ্ধ করিয়ে প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দীর্ঘ নয় মাস একটানা যুদ্ধ করে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহায়তায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর উদিত হয় বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য।
বাংলাদেশের এই স্বাধীনতার স্থপতি বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। দেশ স্বাধীন হলো অথচ স্বাধীনতার স্থপতি দেশে ফিরে এলেননা এটা বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে অসহ্য বেদনাদায়ক। তাই সবার কন্ঠই সোচ্চারিত হয়ে উঠলো ‘ আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে ফেরত চাই। বাংলার মা-বোনেরা তাঁর মুক্তি ও সুস্থ্যতা কামনায় নফল রোজা পালন করলো। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই তাঁর মুক্তির জন্য মহান আলল¬াহর দরবারে দো‘য়া প্রর্থনা করতে লাগলো।
১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বাঙালি জাতির নয়নমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্তিলাভ করে প্রথমে লন্ডন ও পরে দিল্লী হয়ে স্বাধীন বংলাদেশে আগমণ করলেন। বাংলার ঘরে ঘরে সেদিন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। বাংলার জনগণ তাঁকে এক ঐতিহাসিক সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। বাংলার মানুষ মহা খুশিতে তাঁকে বরণ করে নিলো। অথচ মাত্র ৩বছর ৮মাস যেতে না যেতেই সেই রাষ্ট্রনায়ককে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। সেই সাথে তাঁর নিকট আত্মীয় স্বজনকেও হত্যা করা হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট ভোরবেলা সু-পরিকল্পিতভাবে পৈশাচিক এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়।
সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহনকারী সেই পুরুষটিকে সাড়ে তিনবছর আগে সিংহাসনে বসানো হলো ; অথচ তাঁর মৃত্যু সংবাদে করা গেলনা কোন প্রতিবাদ। অনুষ্ঠিত হলোনা কোন মিটিং মিছিল কিংবা শোকসভা। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থানকারি বাংলার নয়নমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এমন কি অপরাধ করেছিলেন যে, তাঁকে এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে অকাতরে জীবন দিয়ে মাশুল দিতে হলো?
অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, শেখ মুজিব রাষ্ট্রনায়ক হবার পরপরই সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশকে রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মান, মিশর, ইরাক ও আমেরিকাসহ ১০৪টি দেশ স্বীকৃতি দান করে।
শেখ মুজিব কিছুদিন রাষ্ট্রনায়ক থাকার পর দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পার্লামেন্টারি সরকার প্রবর্তন করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচিত হন এবং দলীয় নেতা হিসাবে শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হন।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভে সর্বোতভাবে সাহায্য সহযোগিতা করলেও ভারতীয় মিত্র বাহিনী তখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করছিল। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে ঢাকায় আগমণের আমন্ত্রণ জানালে ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় আসেন। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে ভারতীয় মিত্র বাহিনী একে একে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। এ সময় অসংখ্য বাঙালি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে। মুজিব সরকার তাদের পুনর্বাসনের ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার, আহত মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ সরূপ অর্থ মঞ্জুর করা হয়। এ সময় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হয়। এতে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ এই চারটি রাষ্টীয় মূল নীতির কথা স্বীকৃত হয়। গঠিত হয় নতুন মন্ত্রীসভা।
নির্বাচনী ওয়াদার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হয় এবং পি,ও,৯৮/৭২ নং আদেশ মূলে ১০০ শ বিঘা পর্যন্ত জমির সিলিং ধার্য করা হয়। ১০০শ বিঘার ঊর্ধের পরিবারের জমির মালিকদের উদ্বৃত্ত জমি সরকারের হেফাজতে নিয়ে তা ভুমিহীন কৃষকদের মাঝে বন্দোবস্ত প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পি,ও, ১৩৫/৭২ আদেশে নদী-ভাঙ্গা জেগে ওঠা চরের জমি পুন:বন্দোবস্ত প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কৃষকের কৃষি খাতের উন্নতির জন্য স্বল্পমূল্যে সার ও কীটনাশক বিতরণ করা হয়। কৃষকের মাঝে তাকাবি লোনের ব্যবস্থা করা হয়। পল¬¬ী অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বনির্ভর আদর্শ গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হতে থাকে। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরো শক্তিশালী করার মানসে এবং শ্রমিকদেরকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহে সরাসরি সম্পৃক্ত করার লক্ষে মুজিব সরকার দেশের ভারি শিল্প-কারখানা সমূহকে জাতীয়করণ করে।
দেশে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ সরকারি করণ ও শিক্ষকগণকে সরকারি কর্মচারি হিসাবে মর্যাদা প্রদান করা হয়। স্বাধীনতা লাভের অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য শেনীভুক্ত হতে সক্ষম হয়। পাক-ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি ত্রি-পক্ষীয় বৈঠকও ইতোমধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। লাহোরে বিশ্ব ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার প্রাক্কালে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান উক্ত ইসলামী সম্মেলনে যোগদান করেন।
যে নব্বই হাজার যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনা সদস্য যাদেরকে ভারতের কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল তাদের বাংলার মাটিতে বিচার করা হবে বলে ঘোষণা করা হলেও প্রায় ২ বছর পর তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর বিনিময়ে পাকিস্তানে আটক কয়েক লাখ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি বহুদিন পর স্বাধীন বাংলায় নিজ মাতৃভুমিতে ফিরে আসার সুযোগ পায়। আটক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের মুক্তির পর শেখ মুজিব ৮নং আদেশ বলে আটক কৃত অধিকাংশ রাজবন্দীকে আস্তে আস্তে মুক্তি দান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাকারি রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও পিসকমিটির লোকেরা যারা খুন, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য ও সহযোগীতা করেছিল সেই সকল ব্যক্তি বাদে ছোট-খাটো অপরাধ সংঘটনকারিদেরকে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তাঁর এই মহানুভবতার সুযোগে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ও তাদের অনুসারীরা শেখ মুজিবকে চিরতরে উৎখাত করার জন্য বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে দেশে চুরি-ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, অপহরণ, লুটপাট ইত্যাদি সংঘটিত হওয়ায় দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে।
মুক্তিবাহিনীর ছদ্মাবরণে বিভিন্ন দুস্কৃতকারি দেশের বিভিন্ন স্থানে অপকর্মে লিপ্ত হয়। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হতে থাকে। এ ছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন জেলখানার সাজাপ্রাপ্ত আসামী ও বিচারাধীন মামলার আসামীগণের হাতে অস্ত্র ওঠে যা নাকি স্বাধীনতার পরেও জমা দেওয়া হয়না। স্বভাবত:ই সেই সকল অস্ত্র নিরীহ জনগণের অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষে মুজিব সরকার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পাশাপাশি জাতীয় রক্ষী বাহিনী নামে একটি আধা সামরিক বাহিনী গঠন করে। এই আধা সামরিক বাহিনী সৃষ্টি পুলিশ ও সামরিক বাহিনী ভালো চোখে দেখেনা।
যুদ্ধবিধ্বস্থ এই বাংলায় রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করে যাতায়াত ব্যবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠা করতে ও অন্যান্য কারণে অর্থনৈতিক কাঠামো কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়্।ে মুদ্রাস্ফিতির জন্য বাংলাদেশের টাকার মান সর্বনিম্নে গিয়ে দাঁড়ায়। এক শ্রেণির অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ী মুনাফা লাভের আশায় মত্ত হয়ে বাজারে কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করে। দেশে চোরাচালান চক্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সীমান্ত পথে অবাধে চোরাকারবার চলতে থাকে। দেশে চোরাচালানের মাধ্যমে পাট ও ধান-চাল দেশের বাইরে চলে যায়। সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের উপর কন্ট্রোল প্রথা জোরদার করে। লবন, কেরোসিন, চাল,ডাল,বস্ত্র প্রভৃতি জিনিষের অগ্নিমুল্যের কারণে গণ অসন্তোষ ধুমায়িত হতে থাকে।
সরকারের প্রশাসন যন্ত্রে দুনীতির অভিযোগ ওঠে। দলীয় নেতা-কর্মীগণও এ থেকে বাদ যায়না। দলীয় সদস্য ও যুব কর্মীদের মধ্যে নৈতিক অধঃপতন ও উশৃঙ্খলতার অভিযোগসহ স্বজনপ্রীতি ও দলীয় প্রীতির অভিযোগের ফলে গণ অসন্তোষ বাড়তে থাকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশের কল্যানে নতুন নতুন আইনের প্রবর্তন করেন। তিনি “ লালঘোড়া দাবড়ায়ে দেবো ”বলে বজ্রকন্ঠের ভাষনে হুসিয়ারি উচ্চারণ করেন। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। এ হেন নাজুক পরিস্থিতি এড়াবার লক্ষ্যে সুখি ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলে সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির বদলে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি চালু করা হয়। দ্বিতীয় বিপ¬লব ঘোষনা করা হয়। রাজনৈতিক দলের নামকরণ করা হয় ‘ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা “বাকশাল”।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালির সন্তান। বাংলার কৃষক শ্রমিক মেহেনতি মানুষদের নিয়ে তিনি সারাজীবন স্বপ্ন দেখেছেন। তাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করেছেন। যৌবনের অধিকাংশ রোমাঞ্চকর বছরগুলো তিনি কারগারের নিভৃত প্রকষ্ঠে নিঃসঙ্গ কাটিয়ে দিয়েছেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাতে চেয়েছিল , কিন্তু বাংলার জনগণ ব্যাপক আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁকে মুক্ত করেছিল।
বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য তিনি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষন দিতে গিয়ে বজ্রকন্ঠে উচ্চারণ করেন “ আমাদের সংগ্রাম-মুক্তির সংগ্রাম। আমাদের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম। ” পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি এই বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরকে চিরদিনের তরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে তাঁকে আটক করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। দীর্ঘ নয়মাস কারাগারে বন্দি অবস্থায় তাঁর উপর প্রতিমূহুর্তে চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। কিন্তু বাংলার মানুষের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার লক্ষে তিনি সকল অত্যাচার বরণ করে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে সেখানে কবর পর্যন্ত খনন করা হয়েছিল। সে সময়ও তিনি অবিচলভাবে বলেছিলেন, “ তোমরা আমাকে হত্যা করো তাতে আমার আপত্তি নেই: কিন্তু তোমাদের কাছে আমার শেষ অনুরোধ আমাকে হত্যা করার পর আমার লাশটি বাংলার মাটিতে পৌঁছে দিও।”
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে ব্যক্তি বাংলার মানুষকে ভুলতে পারেননি সেই ব্যক্তির এহেন বিষাদময় শেষ পরিণতি সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে।
বাংলার বন্ধু বাঙালির বন্ধু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশকে সুখি ও সমৃদ্ধশালী একটি দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এই বাংলাকে তিনি “সোনার বাংলা” হিসাবে গড়ে তুলে এ দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সাধ তার অপূর্ণই থেকে যায়। ঘাতকেরা তা হতে দেয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট সুবেহ সাদেকের সময় তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের বুক বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। ফলে চিরতরে ধুলিস্মাৎ হয়ে যায় এদেশকে সুখি সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।